Home সারাদেশ গাছের টমেটো মাঠে এনে পাকানো হয় যেভাবে

গাছের টমেটো মাঠে এনে পাকানো হয় যেভাবে

50

ডেস্ক রিপোর্ট: পাশাপাশি বড় দুটি মাঠ একসঙ্গে করা হয়েছে। এক পাশে সবুজ রঙের টমেটো, আরেক পাশেরটা লাল রঙের। একদল শ্রমিক রং ধরা টমেটো বাছাই করছেন। আরেক দল সেগুলো এক জায়গায় করে প্লাস্টিকের ঝুড়িতে (ক্যারেট) তুলছেন। এরপর বোঝাই করা হচ্ছে মাঠেই ভেড়ানো ট্রাকে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার শ্রীপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেল এই চিত্র। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গোদাগাড়ীর এই টমেটো বিক্রি হয়। এ জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকার ব্যবসায়ীরা এই মৌসুমে গোদাগাড়ীতে এসে অবস্থান করেন।

তবে গাছে টমেটো পাকার আগেই নামানো হয়। এরপর মাঠে বিশেষ প্রক্রিয়ায় জাগ দিয়ে পাকানো হয়। এভাবে টমেটো পাকানোর কাজে হরমোনও ব্যবহার করা হয়। অবশ্য কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পরীক্ষা করে তাঁরা সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক কম মাত্রার হরমোন টেমেটোতে পেয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এ বছর গোদাগাড়ীতে ৩ হাজার ১৫ হেক্টর জমিতে টমেটোর চাষ হয়েছে, যা গত বছরের চেয়ে বেশি। উপজেলায় সবজির মধ্যে টমেটো সবচেয়ে বেশি চাষ হয়ে থাকে। গোদাগাড়ীর টমেটো সারা দেশেই যায়।
শীতের শুরু থেকে টমেটো উঠতে শুরু করে। তবে আগাম বাজার ধরার জন্য চাষিরা সাধারণত কাঁচা টমেটো তুলে মাঠে জাগ দিয়ে পাকিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করে একজন চাষি বলেন, গাছ থেকে কাঁচা টমেটো ওঠানোর পরে মাঠে বিছিয়ে ওষুধ ছিটিয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। তারপরে খড় ও পলিথিন দিয়ে তিন দিন ঢেকে রাখা হয়। যাতে কুয়াশা ও আলো–বাতাস না লাগে। টমেটোর রং আসতে এক সপ্তাহ সময় লাগে। মোট দুবার ওষুধ ছিটাতে হয়। প্রথবার করার পর তিন দিন পরে আরও একবার করতে হয়। এসব করতে ১০ থেকে ১২ দিন সময় লেগে যায়। কখনো ১৫ দিনও অপেক্ষা করতে হয়।

এই মৌসুমে গোদাগাড়ী মাঠে মাঠে টমেটো জাগ দেওয়ার দৃশ্য চোখে পড়ে। যেদিকে তাকানো যায়, দেখা যায় মাঠজুড়ে এক জায়গায় সবুজ রঙের টমেটো মেলে দেওয়া রয়েছে। পাশেই দেখা যায় লাল রঙের টমেটো। প্রতিদিন শ্রমিক দিয়ে লাল রং হওয়া টমেটো বাছাই করে দেশের বিভিন্ন এলাকার মোকামে পাঠানো হয়।
একটি মাঠের টমেটো পাকানোর কাজ তদারকি করতে দেখা যায় শ্রীপুর গ্রামের চাষি মাসুদ রানাকে। তিনি এক ব্যবসায়ীর টমেটো পাকানোর কাজ করছেন। নিজেও দুই বিঘা জমিতে টমেটোর আবাদ করেছেন। মাসুদ রানা বলেন, প্রতিবছর এক বিঘা জমিতে ৭০ থেকে ৮০ মণ টমেটো পেয়ে থাকেন। এবার ফলন কম হচ্ছে। বিঘায় সর্বোচ্চ ৬০ মণ টমেটো উঠতে পারে। সারসংকটের কারণে এবার তাঁরা জমিতে পরিমাণমতো সার দিতে পারেননি। এ জন্য ফলন কম হচ্ছে।
এক বিঘা জমিতে টমেটো চাষ থেকে বাজারজাত পর্যন্ত গত বছর ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে মাসুদ রানার। এবার প্রায় ২২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তিনি বলেন, কাঁচা টমেটো তুলে ১০ থেকে ১২ দিন জাগে রাখতে হয়। অনেক শ্রমিক লাগে। এক দিনে একজন শ্রমিককে দিতে হয় ৪৫০ টাকা। এবার মৌসুমে শুরুতে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ দরে টমেটো বিক্রি করেছেন। বৃহস্পতিবার (৮ ডিসেম্বর) বাজার হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা মণ। বাইরের টমেটো দেশে ঢোকায় দাম পড়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

মাসুদ রানার মাঠে হরমোন ছিটানোর জন্য একজন শ্রমিককে দেখা যায়। ছবি তোলার প্রস্তুতি নিতে দেখেই তিনি মাঠ থেকে বের হয়ে একটি বাড়ির আড়ালে চলে যান। মাসুদ রানার দাবি, রাস্তাঘাটে ঝামেলার কারণে তাঁরা টমেটোতে আর হরমোন দেন না। রোদে জাগ দিয়ে রাখেন। এতেই রং বদলে যায়।
পাশের একটি মাঠে বসে শ্রমিকদের সঙ্গে টমেটো বাছাই করছিলেন ঢাকার ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম। তিনি বললেন, এখান থেকে টমেটো কিনে নিয়ে গিয়ে চট্টগ্রামে বিক্রি করবেন। যে টমেটোগুলো ঝুড়িতে ভরে ট্রাকে তোলা হচ্ছে, এগুলো তিনি ১ হাজার ২০০ টাকা মণ দরে কিনেছিলেন। আজকের বাজার ৭০০ টাকা মণ। তিনি বলেন, কৃষক কাঁচা টমেটোই বিক্রি করেন। ১০-১২ দিন ধরে মাঠে জাগ দিয়ে পাকানোর দায়িত্ব ব্যবসায়ীর।

কুমিল্লার ব্যবসায়ী মিন্টু মিয়া একই মাঠে টমেটো জাগ দিয়েছেন। তিনি বসে টমেটো বাছাই করছেন। তিনি বলেন, গত ১০-১২ বছর থেকে গোদাগাড়ীর টমেটো কিনে কুমিল্লায় নিয়ে যান। তিনিও হরমোন ছিটানোর কথা অস্বীকার করলেন। তবে মাঠে ১০ থেকে ১২ দিন জাগ দিয়ে রাখার কথা বললেন।
তবে গোদাগাড়ীর আরও কয়েকটি গ্রামে মাঠ ঘুরে প্রকাশ্যে ব্যবসায়ীদের কাঁচা টমেটোতে হরমোন ছিটাতে দেখা গেছে।

আগাম বাজার ধরার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই চাষি ও ব্যবসায়ীরা কাঁচা টমেটো তুলে জাগ দিয়ে পাকান বলে জানালেন গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম আহম্মেদ। তিনি বলেন, তাঁরা হরমোন ছিটানো টমেটো পরীক্ষা করে দেখেছেন। তাতে শূন্য দশমিক ৯ পিপিএম মাত্রা হরমোন রয়েছে। আর এই হরমোনের সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ২ পিপিএম। ফলে এটা তারা ব্যবহার করতে পারেন। তবে আগাম আহরণ করার ফলে টমেটোটা কম পুষ্ট হয়। রোদে জাগ দেওয়ার কারণে কিছুটা পুষ্টি হারায়।

মরিয়ম আহম্মেদ বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এবার এই প্রকল্পের অধীনে ১০০ জন চাষি সবজি চাষ করেছে। তার মধ্যে টমেটোচাষিও রয়েছেন। তাঁদের টমেটো গাছেই পাকবে। হরমোন বা অন্য কোনো কীটনাশক ব্যবহার করবেন না।
প্রথমআলো