Home জাতীয় খোঁড়াখুঁড়ির অস্বস্তিতে নগরবাসী

খোঁড়াখুঁড়ির অস্বস্তিতে নগরবাসী

27

ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকার দুই সিটিতে মেট্রোরেল, বিআরটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ চলছে ১০ বছর ধরে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হতে লাগবে আরও তিন থেকে পাঁচ বছর। পাশাপাশি বছরজুড়ে থেমে থেমে চলে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, টেলিফোনসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ। এছাড়া সড়ক, ফুটপাত, ড্রেনেজব্যবস্থার উন্নয়নে মাসের পর মাস ব্যস্ত সময় কাটায় সিটি করপোরেশন। আর এসব কাজ করতে গিয়ে খোঁড়াখুঁড়িতে এই মুহূর্তে সিটির প্রায় ৬০০ কিলোমিটার সড়ক এখন ভাঙাচোরা। বছরের পর বছর এসব উন্নয়ন কাজের কারণে ঢাকার সড়কগুলো বেহাল। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বড় বড় গর্তের মধ্যে পড়ে রিকশা, অটোরিকশসহ বিভিন্ন যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয়। পাশাপাশি প্রতিদিনই কোনো কোনো সড়কে থাকে তীব্র যানজট। এমন যান ও জলজটে রীতিমতো অস্বস্তিতে আছেন নগরবাসী।

সড়ক খনন নীতিমালা প্রণয়ন, নানা ধরনের প্রজ্ঞাপন ও নির্দেশনা প্রদান করলেও সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি কমছে না। সড়ক খননের সমন্বয়ের দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। অন্যান্য সেবা সংস্থার জরুরি প্রয়োজনে বাধ্য হয়েই অনুমোদন দিচ্ছে করপোরেশন। সড়ক খোঁড়ার পর বেঁধে দেওয়া সময়েও প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে না। এরপর দীর্ঘ সময় এসব সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা হয়। এ কারণে মানুষ ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান ও অলিগলি মিলিয়ে সড়কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে বর্তমানে প্রায় ২০ ভাগ বা ৬০০ কিলোমিটার সড়ক ভাঙাচোরা। এসব সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ঢাকা ওয়াসা। বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহের জন্য কয়েক বছর ধরে নতুন পাইপলাইন স্থাপনের কাজ করছে সংস্থাটি। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ঢাকার খোঁড়াখুঁড়ি আরও বাড়বে। বর্ষার কারণে অনেক সংস্থার উন্নয়ন কাজের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। এখন তাদের অনুমোদন দিতে হবে। সেটা না দেওয়া হলে ওইসব সেবা সংস্থার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা দুরূহ হয়ে পড়বে। সেখানে কোনো বিঘ্ন ঘটলেও রাজধানীবাসীকে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়তে হবে। ইতোমধ্যে ঢাকার দুই সিটির কাছে বিভিন্ন সংস্থা থেকে সড়ক খননের ৪১০টি আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি আবেদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলো পর্যালোচনাধীন। বর্ষার কারণে ওই আবেদনের বেশির ভাগই অনুমোদন পায়নি। বাকিগুলো কয়েক মাসের মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হতে পারে।

আরও জানা যায়, ঢাকা অত্যন্ত জনঘনত্বপূর্ণ হওয়ায় খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ভোগান্তিতে নাকাল হয়ে পড়ছেন নগরবাসী। এ ধরনের শহরে সড়ক থাকার কথা ২০ থেকে ২৫ ভাগ। বাস্তবে রয়েছে ৭ ভাগ। একরপ্রতি জনসংখ্যা থাকার কথা ১০০ থেকে ১২০ জন। বর্তমানে ঢাকায় সেটি প্রায় ৪০০ জন। ঢাকার দুই সিটির ৩০৫ বর্গকিলোমিটার বা ৭৭ হাজার ৩৩৫ একর আয়তনে লোকসংখ্যা বসবাস করার কথা ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি। কিন্তু বাস্তবে লোক বসবাস করছে ৩ কোটির বেশি। এ কারণে অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি নগরজীবনকে আরও বিষিয়ে তুলছে।

সরেজমিন দেখা যায়, পুরান ঢাকার লালবাগ, চকবাজার, কতোয়ালি, সূত্রাপুর, মতিঝিল ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব খোঁড়াখুঁড়ি করছে ঢাকা ওয়াসা। আর ফার্মগেট থেকে সাতরাস্তা যেতে রেলগেট সংলগ্ন এলাকায় চলছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। দীর্ঘদিন এ সড়কে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা আর কতদিন লাগবে, সেটা বলতে পারছে না দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো। কারণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে মেগা প্রকল্প। প্রকৌশলগত নানা বিষয় রয়েছে, সেগুলো যাচাই-বাছাই করে দীর্ঘ সময় নিয়ে একেকটি পিলার তৈরি করা হচ্ছে। মিরপুর রোড, আগারগাঁও এলাকায় গভীর ড্রেন ও সড়কের উন্নয়ন কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। তেজগাঁও শিল্প এলাকার বেশির ভাগ সড়ক ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে। এজন্য পুলিশ প্লাজা থেকে গাড়িগুলো তেজগাঁওয়ের দিকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। হাতিরঝিল, রামপুরা এলাকার দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

সরেজমিন আরও দেখা যায়, মিরপুর থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল (এমআরটি-৬) প্রকল্পের কাজের কারণে সড়কের অংশ বিশেষ ক্ষতবিক্ষত। এ প্রকল্পের মতিঝিল থেকে কমলাপুর অংশ বাস্তবায়ন করতে আগামী মাসে ওই অংশের সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করার প্রয়োজন হতে পারে। বিআরটি প্রকল্পের কারণে আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের অংশবিশেষ এলাকায়ও খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কয়েক বছর ধরে ওই সড়কের ভোগান্তির মাত্রা তীব্র হয়েছে। আর ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজের কারণে বনানী থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত রেললাইন কেন্দ্র করে দুপাশে চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। এ কারণে মানুষের চলাচলে অন্তহীন দুর্ভোগ মাড়াতে হচ্ছে। পুরান ঢাকার আবুল হাসনাত রোড, সাতরোজা, আগাসাদেক রোডের খোঁড়াখুঁড়িতে মানুষ ও যানবাহন চলাচলে অসহনীয় ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. তারিক বিন ইউসুফ বলেন, সড়ক খননের নীতিমালা রয়েছে। সেটা অনুসরণ করেই সড়ক খননের অনুমোদন দেওয়া হয়। ‘ওয়ান স্টপ সেল’ নামে একটি সমন্বয় কমিটি রয়েছে। ওই কমিটির সভায় সড়ক খননের অনুমোদন দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, আমাদের শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে। সেবা সংস্থাগুলোর জন্য স্বতন্ত্র কোনো লাইন করা হয়নি। সে কারণে প্রতিটি সংস্থার আলাদা আলাদা সেবা সংযোগ লাইন রয়েছে। কোনো কারণে সেবা সংযোগ বিঘ্নিত হলে সেসব সংস্থার জরুরিভাবে সড়ক খননের অনুমোদন দিতে হয়। এখন যে পরিমাণ সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে, সামনের কয়েক মাসে এর পরিমাণ আরও বাড়বে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শহর গঠনের শুরুতে সেবা সংযোগ লাইনগুলো স্বতন্ত্রভাবে (ইউটিলিটি টানেল) গড়ে তুলতে হয়। একবার শহর গড়ে উঠলে সেখানে এ ধরনের কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা সম্ভব হয় না। ডিএনসিসি নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের প্রকল্পে ওই এলাকার স্বতন্ত্র সেবা সরবরাহ লাইন করার প্রস্তাব করেছে। সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব, বিস্তারিত নকশায় বেরিয়ে আসবে। সম্ভব হলে ওই এলাকায় হবে, অন্য এলাকায় কোনো সম্ভাবনা দেখি না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুনসী মো. আবুল হাসেম বলেন, ঢাকা ওয়াসা, ডিপিডিসি, বিটিসিএলসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার জরুরি সেবামূলক কাজের জন্য সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এখন মোট সড়কের প্রায় ২০ ভাগ সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ভবিষ্যতে খোঁড়াখুঁড়ি আরও বাড়তে পারে।

তিনি বলেন, সড়ক খনন নীতিমালা অনুসরণ করে সড়ক খননের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে জনগণের দুর্ভোগ হয়। মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। যানজট হয়; কিন্তু এরপরও কিছুই করার নেই। ডিএসসিসি সড়ক খনন কার্যক্রমকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছে। কেউ চাইলেই সঙ্গে সঙ্গে সড়ক খননের অনুমোদন পাচ্ছে না। এরপরও সরকারি জরুরি সেবা ও প্রকল্প বাস্তবায়নের বিবেচনায় সড়ক খননের অনুমোদন তো দিতেই হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ঢাকা ওয়াসা সমগ্র ঢাকার পানি সরবরাহ লাইনগুলোকে আধুনিক মানে উন্নীত করছে। সে লক্ষ্যে ঢাকার বেশকিছু এলাকায় নতুন পাইপলাইন বসাতে হবে। ইতোমধ্যে কয়েকটি এলাকায় পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। অন্যান্য এলাকায়ও পাইপলাইন স্থাপন করা হবে। সে লক্ষ্যে আরও বেশকিছু সড়কে পাইপলাইন স্থাপন করতে হবে। বর্তমানে পুরান ঢাকা, মতিঝিল এবং উত্তরা এলাকায় পাইপলাইন স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের শহরে সেবা সংযোগ লাইনগুলোর জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করা হয়নি। এজন্য জরুরি প্রয়োজন এবং সেবা সংযোগ লাইনের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। কেননা সেবা সংযোগ ও সরবরাহ লাইনগুলো তো মাটির নিচ দিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় এখন বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়, তবে জনদুর্ভোগ কমানো সম্ভব।-যুগান্তর