Home মতামত খারাপ! বড় খারাপ সময় যাচ্ছে!!

খারাপ! বড় খারাপ সময় যাচ্ছে!!

120

সরদার মোঃ শাহীন:

একবার বিবিসির একজন উপস্থাপক দুবাই এর প্রতিষ্ঠাতা শেখ রাশিদ আল মাখতুমকে জিজ্ঞাসা করলেন- দুবাই এর ভবিষ্যত কি? জবাবে ধনকুবের শেখ বললেন, আমার বাবা উট চালাতেন, আমি মার্সিডিস চালাই। আমার ছেলে ল্যান্ড রোভার চালায় এবং আমার নাতি হয়তো বুগাতি ব্যারন চালাবে। কিন্তু আমার পুতি আবারো উট চালাবে! উপস্থাপক অবাক হয়ে তাকে আবার জিজ্ঞেস করলেন- কিন্তু এমনটা হবে কেনো? তিনি উত্তরে বলেন- ‘দুঃসময় শক্তিশালী মানুষ তৈরি করে, আর শক্তিশালী মানুষ সুসময় তৈরি করে। সুসময় দুর্বল মানুষের জন্ম দেয়, আর দুর্বল মানুষ দুঃসময় তৈরি করে।’

তাহলে এই যে পুরো বিশ্বে এখন প্রচন্ড দুঃসময় চলছে এর পেছনে কি সুসময়ের দুর্বল মানুষেরাই দায়ী? দুবাইয়ের প্রতিষ্ঠাতার কথাটির সারবত্তা থাকলে মানতে তো হবেই যে দুর্বল মানুষেরাই দায়ী। না হয় মানলাম। কিন্তু যদি খুঁজে দেখতে চাই এইসব দুর্বল মানুষদের; দেখা কি পাবো তাদের এই সমাজে? দেখা পাওয়ার বিষয়টি হয়ত সহজ হবে না। হয়ত আমার চোখে যিনি বা যারা দুর্বল, অন্যের চোখে তারাই সবল। কিংবা আমার চোখে যারা হিরো, অন্যের চোখে তারাই জিরো।

অবশ্য এইসব জিরো আর হিরোদের নিয়েই তো আমাদের সমাজ। লক্ষ্যনীয় যে, হিরোরা কখনোই জিরো সাজার চেষ্টা করে না। কিন্তু জিরোরা সুযোগ পেলেই হিরো সাজার চেষ্টা করে। রোজা শুরুর প্রথম দিককার কথা। হঠাৎ করে সারাদেশে প্রচন্ড রকমের গ্যাস সংকট দেখা দিল। করোনায় এমনিতেই বিশ্বের ভঙ্গুর অবস্থা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে সেখানে যুক্ত হয়েছে রাশিয়ান যুদ্ধ। যার প্রভাব মারাত্মক ভাবে পড়েছে আমদানী রফতানীর উপর। মিডিয়ার সব খবরের শিরোনাম হয় এই খবর। প্রায় আড়াই বছরের বিশ্ব পরিস্থিতির এই চরম দুঃসময়ে জিনিসপত্রের দামবৃদ্ধি একটি অতীব মামুলী ব্যাপার। চাহিদার তুলনায় বাজারে থাকা পণ্যে ঘাটতি থাকবেই। এবং বাজার হবে অনিয়ন্ত্রিত ।

কিন্তু সমাজের জিরোরা এসব মানতে নারাজ। হিরো সাজার সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাইলো না। মুখ এবং কলম দুটোই খুলে বসলো। কথা তাদের একটাই; এত কথা বুঝি না। রান্নার গ্যাস দিতে হবে। কিন্তু হঠাৎ গ্যাসের এই ঘাটতি কেন হলো, সেদিকে একটি মানুষও একটিবারের জন্যেও তাকালো না। ধর্মত জিরোরা এমন সময়ে কোনদিকে তাকায় না। হুজুগে আগায়। ফলত যা হবার তাই হলো। চারদিকে প্রচন্ড রকমের হাহাকার শুরু হয়ে গেল। কলম ধরার যার যোগ্যতা নেই, সেও কলম ধরে যা মনে আসলো তাই লিখে গেল গ্যাস নিয়ে। লেখার মূল প্রতিপাদ্য একটাই কেবল; সময় খুব খারাপ। দেশটা আর রইলো না। শ্রীলঙ্কা হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লক্ষ্য করলাম, দুর্বল চিত্তের এই মানুষগুলো পুরো দেশের সাধারণ মানুষদের অধিকতর দুর্বল করার জন্যে আদাজল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন। অথচ আসল বিষয়টি ছিল অনাকাঙ্খিত একটি দুর্ঘটনা মাত্র। দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদনশীল গ্যাসকেন্দ্র বিবিয়ানার একটি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় হঠাৎ বালি উঠতে শুরু করে। এ কারণে তৎক্ষণাৎ বন্ধ করে দিতে হয় একে একে ছয়টি কূপের উৎপাদন। এতে প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মারাত্মক সংকট দেখা দেয়।

বিবিয়ানাতে ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের ঘাটতি সৃষ্টি হলেও এলএনজি দিয়ে সেই ঘাটতি মেটানো সম্ভব ছিল। কিন্তু বিশ্ববাজারে জ্বালানি অস্থিতিশীল থাকায় হাতে সেই পরিমাণ সরবরাহ ছিল না। এলএনজিবাহী জাহাজের চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে তখনও দুদিন বাকী। যাই হোক, রাতেই টেকনিক্যাল টিম কূপ মেরামতের কাজ শুরু করে দেয়। পেট্রোবাংলা থেকে একটি মনিটরিং টিমও ফিল্ড এলাকায় যায়। ওইদিন রাতেই তিনটি কূপ থেকে স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন শুরু করে। পরদিন ৪ নাম্বার কূপও উৎপাদনে আসে। ফলে জাতীয় গ্রিডে পর্যাপ্ত গ্যাস যোগ হওয়া শুরু করে এবং মাত্র দুদিনেই সকল কূপ থেকে পূর্ণ গতিতে গ্যাস উত্তোলন শুরু হয় এবং কেটে যায় সার্বিক সংকটও।

মাত্র দুদিনে সংকট কেটে যায়। জিরোরাও চুপ হয়ে যায়। অথচ সামান্য দুটি দিন কেউই ধৈর্য্য ধরেনি। ধরতে পারেনি। দুর্বলদের কী হাম্বিতাম্বি! এতটুকু তর তাদের সইলো না। অথচ কয়েক বছর আগেও দেশে গ্যাস ছিল না পর্যাপ্ত। ছিল না বিদ্যুত। ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন সময় কাটাতাম আমরা। মিটি মিটি গ্যাসের পিদিমে সকালের রান্না বিকেলে শেষ হতো। তখন ওসব দিব্বি সয়ে গিয়েছিল। এখন পর্যাপ্ত গ্যাস আর বিদ্যুতে থাকতে থাকতে সামান্য ব্যারাম আর সহ্য হয় না। দুনিয়া জাহান্নামে যাক, আরামে তাদের থাকা লাগবেই।

আসলেই আরাম মানুষকে ব্যারাম দেয়। যেমনি দেহের ব্যারাম দেয়, তেমনি মনেরও। না হলে কি সামান্য বেগুন নিয়ে কেউ হৈচৈ করে? জন্মের পর থেকেই দেখছি রোজা আসা মানেই বেগুন নিয়ে হৈচৈ, আর হাহাকার। খেলাম না বেগুন, তাতে এমন কি! অথচ রমজানের শুরুতে বেগুন লাগবেই। তাই দলবেঁধে হৈচৈ। মানসিক ভাবে এসব অসুস্থ মানুষদের হৈচৈএ চারদিক কোলাহল পূর্ণ দেখলাম। তাদের বেগুন চাই। চাইই চাই। বেগুনের ব্যবস্থা করে দিতেই হবে। ওসব কুমড়া টুমড়া দিয়ে হবে না।

কুমড়ার কথা সরকার প্রধান সংসদে বলে সারতে পারেননি। আমি নিশ্চিত কথাটা বলে উনি বাসা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি। অমনি ট্রলের পর ট্রল শুরু হয়ে গেল। তথাকথিত হিরো পন্ডিতদের দেখবার মত যত পান্ডিত্য আছে, উজার করে সব দেখাতে লাগলো। যতভাবে কথাটাকে ব্যঙ্গ করা যায় ঠিক ততভাবেই ব্যঙ্গ করলো। মনে হচ্ছিল উনি কুমড়ার কথা বলে মহাভারতকে অশুদ্ধ করে ফেলেছেন। এখন একে শুদ্ধ করতে হবে। গ্রেটার ভারত থেকে বেগুন এনে হলেও শুদ্ধ করতে হবে।

১৯৯৫ সালের জুলাই মাসের কথা। পড়াশুনা করতে আমি সবেমাত্র জাপানে পা রেখেছি। সবকিছুই নতুন লাগতো চোখেমুখে। যা দেখতাম তাতেই অবাক হতাম। বেশি অবাক হতাম রাস্তার পাশে থাকা দোকানের মুখে বস্তায় বস্তায় চাল দেখে। কৌতুহলী মন আমার মানে না। আমি ভাতেমাছে বড় হওয়া মানুষ। চাল আমাদের প্রধান খাদ্য। আর এই চাল বস্তায় বস্তায় ওরা দোকানের সামনে স্তুপ করে রেখেছে।

একদিন কথার ছলে জাপানীজ বন্ধুকে বলেই ফেললাম, এর রহস্য কি! মুহূর্তেই ছেলেটা গম্ভীর হয়ে গেল। আমাকে কিছু বলার জন্যে একটু সময় নিয়ে শুরু করলো। এমনভাব বলা শুরু করলো যেন আমি ছাত্র আর সে শিক্ষক। কঠিন একটা বক্তৃতা সে করে ফেললো। বক্তৃতার মূল কথা হলো, সেই বছর জাপানে ধানের উৎপাদনে ঘাটতি ছিল। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় প্রত্যাশার চেয়ে ৩০ শতাংশ ধান কম উৎপাদিত হয়।

সচেতন সরকার ব্যাপারটি আঁচ করতে পেরে আগেভাগেই থাইল্যান্ড থেকে চাল আমদানী করে ফেলে যেন জনগণ চালের অভাবে না পড়ে। অন্যদিকে সচেতন জনগণ ব্যাপারটা বেশ ভাল করেই বুঝে নিয়ে ভাত খাওয়া কমিয়ে দেয় যেন সমাজ তথা রাষ্ট্র বিপাকে না পড়ে। ফলাফল হয় উল্টো। আমদানী করা চাল তো লাগেইনি, উল্টো উৎপাদিত চালও উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। সেজন্যেই দোকানে দোকানে চালের স্তুপ জমা পড়ে।

এটা ছিল জাপানে পৌঁছার পর আমার নেয়া প্রথম শিক্ষা। আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম শিক্ষা থেকে জাপানীজদের দীক্ষা নেয়ার কৌশল। এমনই হয়। সভ্য সমাজে পণ্যের ঘাটতি হলে, সেই পণ্যের দাম কমে যায় ক্রেতার অভাবে। কেননা সভ্য সমাজে ভোক্তারা খুবই সচেতন থাকে। ঘাটতি পণ্যের দিকে তারা নজর দেয় না। নজর দিলে সেই পণ্যের দাম বাড়তে বাধ্য।

আমাদের দেশে হয় উল্টো। এদেশে ক্রেতারা ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাটতি পণ্যের দিকে। ফলে যা হবার তাই হয়। পণ্যের দাম আকাশচুম্বি হয়। আকাশচুম্বি হয় ভোক্তা মহলের সচেতনতার অভাবে। অসচেতন হয় জিরোরা। তারা চিল্লাপাল্লা শুরু করে। যে সমাজে হিরোদের চাইতে এমনি জিরোদের সংখ্যা বেশি, সেই সমাজে সচেতনতার অভাব থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। বরং না থাকাটাই কি অস্বাভাবিক নয়???

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।