ডেস্ক রিপোর্ট: আগামীকাল বাংলা ১২ ভাদ্র ১৪৩০ রোববার জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটি যতাযথভাবে পালনে বিভিন্ন কর্মসুচি গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় আগামীকাল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
কর্মসূচি অনুযায়ী আগামীকাল কলাভবন প্রাঙ্গণে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে সকাল ৬:১৫টায় মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা সহকারে কবির সমাধিতে গমন, পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। পরে মাননীয় উপাচার্যের সভাপতিত্বে কবির সমাধি প্রাঙ্গণে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভায় নজরুল বিশেষজ্ঞ হিসেবে বাংলা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ স্মারক বক্তৃতা প্রদান করবেন। বিভাগীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ নজরুল সংগীত পরিবেশন করবেন।

জাতীয় কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আগামীকাল ২৭ আগস্ট বাদ ফজর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদ মসজিদুল জামিয়া’য় কোরানখানি অনুষ্ঠিত হবে।

কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার।তার মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুরনারহিত।
তার জীবন শুরু হয়েছিল অকিঞ্চতকর পরিবেমে্ স্কুলের গন্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন।মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হযেিছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে।তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল বিদ্রেহী কবির সত্তা। ১৯২২ খ্রীস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার রাজ্যদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল তাকে।তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে তিনি মারাত্মকভাবে স্নায়ুবিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্সিকভাবে তার সকল সক্রিয়তার অবসান হয়।১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দে তাকে বাঙলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নজরুলের কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তা বাংলাভাষী পাঠকদের মধ্যে এখনও তুঙ্গস্পর্শী। তার মানবিকতা, ঐপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে দ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী-পুরুষের সমতার বন্দনা প্রায় একশত বছর যাবৎ বাঙালীর মানসপীঠে ভূমিকা রেখে চলছে।
১৯৯৯ খ্রীস্টাব্দের ২৪ মে ( ১৩০৬ বাংলা সালের ১১ জৈষ্ঠ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলা মহাকুমার চুরুরিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাবেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার পিতা স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম ছিল।কাজী নজরুলের ডাক নাম ‘দুখু মিয়া’। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন।মকতবে কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত অধ্যায়ন শুরু করেন। ১৮০৮ খ্রীস্টব্দে তার পিতার মৃত্যু হয়।তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর।পিতার মৃত্যুতে পারিবারিক অভাব অনটন দেখা দেয়, বাধাগ্রস্থ হয় শিক্ষাজীবন।মাত্র দম বছর বয়সে কর্মে নামতে বাধ্য হয়।এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিন্ম মাধ্যমিক পাশ করে উক্ত মক্তবে শিক্ষাকতা শুরু করেন।
একই সাথে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের আযানের কাজ শুরু করেন।এর মধ্যে দিয়েই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেন।
নজরুর বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হন। যোগ দেন ভ্রাম্যমান নাট্য দলে। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুরিয়া অঞ্চলের রেটো দলের বিশিষ্ট ওস্তাদ ছিলেন। আরবী, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল।চাচা বজলে মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। এছাড়া নজরুর ঐ অঞ্চলে লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নিয়মিত অংশ নিতেন।লেটো দলেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দরের সাথে বিভিন্ন স্থানে যেতেন অভিনয় শিখতেন এবং গান ও কবিতা লিখতেন।
একই সাথে তিনি হিন্দুধর্মগ্রস্থ অথাৎ পুরানসমূহ অধ্যায়ন করতেন।অল্প বয়সেই বেশ কিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন।একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপরদিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্য জীবনে অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে।নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ করেন – কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না।আমি শুধু হিন্দু মুসরিমকে এক জাযগায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করছি, গালাগারিকে গরাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করছি।
১৯১০ সালে রেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে পিরে আসেন নজরুল।এই নতুন ছাত্র জীবনে প্রথমে রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজী স্কুরে য পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিত লাভ করে। আবার অর্থনৈতিক কষ্টে ষষ্ঠ শ্রেনী পর্যন্ত পড়ার পর কাজে পিরে যেতে হয়।প্রতমে যোগ দেয় বাসুদেবের কবিদলে।এর পর একজন খ্রীস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলা চা-রুটির দোকানে রুটির বানানোর কাজ নেয়। রুটির দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলার দারোগা রফিজউল্লাহ সাথে তার পরিচয় হয়। দোকনে বসে বসে নজরুলের রেখা কবিতা পড়ে রফিজউল্লাহ তার প্রভিার পরিচয় পান।তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করেন।১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে পিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণীতে পড়া শুরু করেন। ১৯১৭ খ্রীস্টাব্দে শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেষ্ট পরীক্ষা না দিযে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।প্রথমে ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য নওশেয়ার যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন।তিনি সেনাবাহিনীতে ১৯১৭ থেকে ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন।মাত্র আড়াই বছর।সেনাবহিনীতে হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন।
এসময এক পাঞ্জাবী মৌলবীর কাছে ফার্সি শেখেন।সৈনিক থাকাকালে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অংশ নেয়।১৯২০ খ্রীস্টাব্দে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হলে সৈনিক জীবন ছেড়ে কলকাতায় ফিরে আসেন।
কলকাতায় ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসরিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন।এখান থেকেই সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মুর কাজগুলো শুরু হয় তার।
১৯২১ সালের অক্টোবরে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ টাকুরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল।১৯২০ খ্রীস্টাব্দের ১২ জুলাই নবযুগ নামক সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা বের হয়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন এ.কে ফজলুল হক।।এই পত্রিকায় নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালিন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজাফ্ফর আহমেদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয় প্রত্যক্ষ সুযোগ পান।
১৯২১ খ্রীস্টাব্দের মুসলিম সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলি আকবরের সাথে পরিচিত হন। তার সাথে কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসনে।এখনেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে প্রণয় ও বিয়ে হয়েছিল।তবে তার আগে আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস খানমের সাথে বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে হলেও কাবিনে ঘর জামাই থাকার শর্ত থাকার কারনে বিরোধ বাধে।নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করে কুমিল্লা শহরেরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চরে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। পরে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
নজরুল সাম্যবাদরে একজন অগ্রদুত চিলেন। মুসলিম হযেও তিনি তার চার সন্তানের নাম রাখেন কৃষ্ন মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং অনিরুদ্ধ।
১৯২২ খ্রীস্টাব্দের ১২ আগষ্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ৮ নভেম্বর পত্রিকায় একটি কবিতা প্রকাশ হওয়া পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়।একই বছর ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণি পত্রিকা নিষিদ্ধ করা হয়। তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়।
১৯২৩ খ্রীস্টাব্দের ১৬ জানুয়ারি নজরুলকে এক বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। তাকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন রবীন্দ্রনাথ বসন্ত গীতিনাট্য গ্রস্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন।
নবযুগে সাংবদিকতার পাশাপামি নজরুল বেতারে কাজ করেছিলেন।এমন সময় অথাৎ ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে প্রড়ন তিনি।১৯৪২ খ্রীস্টাব্দের মেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েে ফেলেন। এরপর ভারতে নিভৃতে সময় কাটাতে থাকেন। এরপর ১৯৫৩ খ্রীস্টাব্দে মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। তার রোগ থেকে মুক্তি অসম্ভব হওয়ায় কলকাতায় পিরে আসেন।
১৯৭১ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ খ্রীস্টাব্দের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে স্বপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে তাকে বাংলাদেশের নাগরিত্ব প্রদান করা হয়।
১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে তৎকালিন পিজি পাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরন করেন।তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রেীয় মসজিদেরপাশে সমাধি করা হয়।
নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক।নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত হিসেবে পরিচিত।
নজরুল ‘ধূপছায়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
সৈনিক জীবন মেষে কলকাতায় মুসলিম সাহিত্য সমিতিতে মুজ্জাফরের সাথে বাস করেছিলেন। মুজফ্ফর ছিলেন এদেমে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রদূত। এখান থেকেই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনা শুরু হয়্ মুজফ্পএরর সাথে বিভিন্ন সভ-সমাবেশে অংশ নিয়ে বক্তৃতা দিতেন। এ সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে পরিচিত হন।