Home জাতীয় কারাগারে মৃত্যু, দায় নিয়ে ঠেলাঠেলি

কারাগারে মৃত্যু, দায় নিয়ে ঠেলাঠেলি

20

ডেস্ক রিপোর্ট: কারাগারে বন্দি মৃত্যুর ঘটনা বেড়েই চলেছে। এসব মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ একে অপরের ওপর দায় চাপিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, রিমান্ড ফেরত আসামিদের বেশির ভাগই অসুস্থ অবস্থায় কারাগারে আসেন। কিছুদিনের মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। আর পুলিশের পক্ষ থেকে হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। যদিও কারা কর্তৃপক্ষের দাবি, কারাগারের ভেতর আসামি বা বন্দিদের ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো সুযোগ নেই। তবে মানবাধিকার কর্মীদের মতে কারাগার অথবা পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর প্রতিটি ঘটনায় ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য মতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত কারাগারে ৩২৮ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা ১২৩ ও আটক ২০৫ জন। বছর হিসেবে ২০১৮ সালে ৭৪ জন, ২০১৯ সালে ৫৮ জন, ২০২০ সালে ৭৫ জন, ২০২১ সালে ৮১ জন ও ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪০ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার অনেক বন্দির মৃত্যু হয়েছে যাদের বয়স সত্তরের বেশি। এ ছাড়া কারাগারে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে রিমান্ড ফেরত আসামিরাও কারাগারে মারা যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পুলিশ ও কারা কর্তৃপক্ষ দুই পক্ষই একে অপরকে দোষারোপ করে থাকেন।
এসব বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায় না। তবে অসুস্থ অবস্থায় বন্দি বা আসামিদের নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা গেলে, সে সংক্রান্ত একটি মৃত্যু সনদ প্রদান করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ঐসব মৃত্যু সনদে তার মৃত্যুর কারণ হিসেবে বার্ধক্যজনিত কিংবা হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন—এরকম কারণ উল্লেখ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে মৃত্যু সনদে ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ জনিত, কিডনি ও লিভার জটিলতাকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
কারা অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, কিছু ক্ষেত্রে রিমান্ড ফেরত আসামিদের শরীরের বাহ্যিক অবস্থা দেখে তাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেডিক্যাল চেকআপের মাধ্যমে কারা কর্তৃপক্ষ ঐসব আসামিদের গ্রহণ করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে বেশি অসুস্থ হলেও ঐসব আসামিকে গ্রহণ করার জন্য পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে সুপারিশ আসে। তখন তাদের গ্রহণ করা হয় এবং একটি নোট রাখা হয়। অথচ এসব ক্ষেত্রেও ঐ আসামি মৃত্যুবরণ করলে কারা কর্তৃপক্ষকে দোষারোপ করা হয়। এক্ষেত্রে ঢাকা পড়ে যায় পুলিশি নির্যাতনের বিষয়টি।
গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি ইদ্রিস আলী মোল্লা (৬২) অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। তার মৃত্যু সনদে বার্ধক্যজনিত কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সৈয়দ মোছাব্বের হোসেন (৫২) নামে এক আসামির মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু সনদে বলা হয়েছে, উচ্চরক্তচাপ ও দীর্ঘ দিন ধরে নানা ধরনের জটিল রোগে তার মৃত্যু হয়েছে। গত ১ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বন্দি মফিজ বাবু (৬২) ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার মৃত্যু সনদে মৃত্যুর কারণ হিসেবে একই ধরনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে গত বছরের ১১ আগস্ট একটি ডাকাতি মামলার আসামি আনোয়ার হোসেনের মৃত্যু হয়। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, হার্ট অ্যাটাকে তার মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের অভিযোগ, গ্রেফতারের পর পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে কারাগারে মারা গেছেন আনোয়ার। গত ৪ সেপ্টেম্বর মেহেরপুর কারাগারে জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি তোফায়েল আহমেদের মৃত্যু হয়। কারা কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যু হয় তার।
সূত্রমতে, ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদ ১০ মাস কারাবন্দি থাকা অবস্থায় গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মারা যান। শহীদ তাজ উদ্দিন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। ময়নাতদন্তের রিপোর্টে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গত বছরের ১৩ মার্চ বরিশাল কেন্দ্রীয় কারাগারে হাজতি জহিরুল মারা গেলে অসুস্থতার কথা বলে কারা কর্তৃপক্ষ। তবে তার বড় ভাই আলী আকবর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘পিবিআইয়ের লোকজন জহিরুলকে গ্রেফতারের পর আদালতে না দিয়ে ব্যাপক মারধর করলে কারাগারে মারা যান তিনি। মারা যাওয়ার চার-পাঁচ দিন আগে কারাগারের মধ্যে কিছু লোক জোড় করে তার ঘাড়ে ইনজেকশন দেয় বলেও পরিবারকে জানিয়েছিল জহিরুল।’ ২০১৯ সালে পঞ্চগড় জেলা কারাগারে আইনজীবী পলাশ কুমার রায় আগুনে পুড়ে মারা গেলে কর্তৃপক্ষ আত্মহত্যা বলে জানায়। ঐ সময় তার পরিবার আত্মহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে।
কারা সূত্র জানায়, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ফজর আলী ও ৩০ আগস্ট খোকা মিয়া নামের দুই বন্দি নরসিংদী কারাগারে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই দুইটি ঘটনায় নিচের পদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এসব ব্যাপারে জানতে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হকের মোবাইলে কয়েক বার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ ইত্তেফাককে বলেন, কারাগারে কেউ অসুস্থ হলে আমরা যথাযথভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। তারপরও কেউ মারা গেলে আমাদের কী করার আছে? তবে এসব মৃত্যু নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ কখনো পুলিশের ওপর দোষ চাপায় না বলে তিনি দাবি করেন।

এ ব্যাপারে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-কমিশনার ফারুক হোসেন বলেন, কোনো আসামি গ্রেফতারের পর বা রিমান্ডের আসামির ওপর নির্যাতন চালানোর কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইন-২০১৩ কার্যকর হওয়ার পর থেকে রিমান্ডের আসামির ওপর তদন্তকারী কোনো কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদের নামে নির্যাতন চালান না। কোনো আসামি যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা তার ফিটনেস সনদ দেওয়ার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। রিমান্ডের আসামিদের ওপর নির্যাতন চালানোর অভিযোগ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন বলেন, বিচারে দীর্ঘসূত্রতায় মানসিক চাপ, আন্তঃসামাজিক মর্যাদাগত চাপ ও ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বন্দি, রাতের বেলা হার্ট অ্যাটাকসহ অন্যান্য গুরুতর অসুখে তাৎক্ষণিক ও যথাসময়ে চিকিৎসা না পাওয়াই কারাগারে বন্দি মৃত্যুর কারণ। এছাড়া গ্রেফতারের পর থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদের যে পদ্ধতি অর্থাৎ মারধর বা নির্যাতনের কারণে অনেকের মৃত্যু হয়। অথচ বন্দি মৃত্যু নিয়ে কারা কর্তৃপক্ষ সব সময় গতবাধা কথা বলে। তারা ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ অথবা ‘হার্ট অ্যাটাক’-এর কথা বলে থাকে। কারা হেফাজতে মারা যাক, আর পুলিশ হেফাজতে মারা যাক—এসব মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত বাধ্যতামূলক এবং একটি কমিটি গঠন করে ময়নাতদন্ত করতে হবে। এই মানবাধিকার সংগঠক আরও বলেন, কারাগারে একজন সাধারণ বন্দি অসুস্থ হলে প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন আমলে নেওয়া হয় না। যখন চূড়ান্ত অসুস্থ হয়ে পড়ে তখন দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এছাড়া প্রকৃত অসুস্থ রোগীরা হাসপাতালে জায়গা পায় না। এখানে যার টাকা আছে, তারা সহজেই চিকিৎসা সেবা পায়।
ইত্তেফাক