Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি করোনাকালে কেউ কেউ কল্পনাতীত ধনী হলেও আয় ও সম্পদবৈষম্যে দরিদ্র হয়েছে সাড়ে...

করোনাকালে কেউ কেউ কল্পনাতীত ধনী হলেও আয় ও সম্পদবৈষম্যে দরিদ্র হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি মানুষ

37

সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি : করোনা মহামারিতে কেউ কেউ কল্পনাতীত ধনী হয়েছেন। একই সময়ে দেশে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।
অন্যদিকে করোনায় নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। তাই করোনা পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ধনীদের সম্পদ গরিবের মধ্যে পুনর্বণ্টনের সুপারিশ করেছেন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. আবুল বারকাত।

অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত সম্মেলনে উপস্থাপিত মূল প্রবন্ধে তিনি এ সুপারিশ তুলে ধরেন।

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি আয়োজিত দুই দিনের সম্মেলনের শেষ দিনে শনিবার (২৫ ডিসেম্বর ২০২১) ‘কোভিড-১৯ থেকে শোভন সমাজ’ শিরোনামের মূল প্রবন্ধটি তুলে ধরেন ড. আবুল বারকাত।

কোভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত মোকাবেলা করে শোভন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে অর্থনীতি ব্যবস্থায় সর্বোচ্চ নজর দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, কোভিডের মহামন্দা-মহারোগ থেকে সমাজ ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং একই সঙ্গে সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এখন জোরেশোরে কাজ শুরু করতে হবে।

দুই দিনব্যাপী দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের শেষ দিনে আয়োজিত অধিবেশনে আরও উপস্থিত ছিলেন সমিতির সাবেক সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, সমিতির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন।

মূল প্রবন্ধে ড. আবুল বারকাত বলেন, করোনা মহামারি দেশের শ্রেণিকাঠামো পাল্টে দিয়েছে।

করোনার আগে দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৪০ লাখ। গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ৬৬ দিনের টানা বিধিনিষেধের সময় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়ে ৬ কোটি ৮০ লাখে ঠেকেছে। অর্থাৎ করোনার কারণে ৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে।

বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে চারটি সুপারিশ করেন ড. আবুল বারকাত। সেগুলো হচ্ছে, ধনীদের সম্পদ গরিবের মধ্যে পুনর্বণ্টন করা।

ড. আবুল বারকাত মনে করেন, এতে একদিকে আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য কমবে, অন্যদিকে অর্থনীতিতে প্রবাহ বাড়বে।

ড. আবুল বারকাত বলেন, অনেকের কাছে প্রস্তাবটি বাস্তবতাবিবর্জিত মনে হলেও এটি কোনো অবাস্তব কিংবা অসম্ভব কিছু নয়।

মূল প্রবন্ধে আরও সুপারিশ করা হয়, করোনার ক্ষতি পোষাতে প্রয়োজনে টাকা ছাপানো।

এ বিষয়ে ড. আবুল বারকাত বলেন, টাকা ছাপানোর কথা বললেই অনেকে বুঝে না বুঝে আঁতকে ওঠেন। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করেন।

কিন্তু আমরা বলছি, প্রয়োজনীয় টাকা ছাপাতে। আমরা বলছি না অতিরিক্ত টাকা ছাপাতে হবে।

প্রয়োজনমতো টাকা ছাপিয়ে সে টাকা দিয়ে যদি বিপুলসংখ্যক মানুষকে বেকারত্ব থেকে মুক্তি দেওয়া যায় কিংবা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়, সেটি হবে বেশি জনহিতকর। তাতে উৎপাদনশীলতা বাড়বে।

গ্রাম ও শহর দুই এলাকাতেই ব্যাপক কর্মসংস্থান হবে।

তৃতীয় সুপারিশ ছিল, করোনা থেকে উত্তরণে একটি বৈশ্বিক সম্পদ তহবিল গড়ে তোলার। কারণ হিসেবে বলা হয়, করোনা একক কোনো দেশের বিষয় নয়।

এটি বৈশ্বিক। করোনার ফলে বৈশ্বিক মহামন্দা বিশ্বের সব দেশকেই বিপর্যস্ত করেছে। সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে বৈশ্বিক পর্যায়ে একটি সম্পদ তহবিল করতে হবে।

এ সম্পদ তহবিলের উৎস হবে বিশ্বব্যাপী এক বছরে যেসব আর্থিক লেনদেন হয়, তার ওপর শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ হারে করারোপ করা।

ড. আবুল বারকাতের চতুর্থ সুপারিশ ছিল কালোটাকা ও অর্থ পাচার বন্ধ করার। পাশাপাশি বাজারে বন্ড ছেড়ে অর্থ আহরণ করার।

পরে মূল প্রবন্ধের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ড. আবুল বারকাত তাঁর প্রতিবেদনে বেশ কিছু প্রস্তাব তুলে ধরেছেন।

এর মধ্যে সব প্রস্তাব যে সবার পছন্দ হবে, তা নয়। তবে তাঁর যে মূল সুর, তার সঙ্গে সবাই একমত হবেন।

ড. আবুল বারকাত তাঁর প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, করোনার প্রভাবে আয়, ধনসম্পদ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বৈষম্য প্রকট হয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।

এ অবস্থা থেকে ঘুরে না দাঁড়ালে সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যস্ত অনিবার্য।

প্রবন্ধে আরও বলা হয়, বড় ঋণগ্রহীতাদের কোনোভাবেই নগদ অর্থ প্রণোদনা দেওয়া ঠিক হবে না। এতে একদিকে সম্পদের অপচয় হয়।

একই সঙ্গে ভুল বরাদ্দ ও অর্থ পাচারের আশঙ্কাও থাকে। এ ছাড়া করোনার কারণে ঘোষিত প্রণোদনার টাকা যেসব উচ্চবিত্তের কাছে গেছে, সে টাকা ফেরত আনা কঠিন হবে বলে মনে করেন অর্থনীতি সমিতির নেতারা।

ড. আবুল বারকাত বলেন, কোভিডের প্রভাবে জিডিপির ক্ষতি হয়েছে ৪ লাখ ৫৮ হাজার ২৬ কোটি টাকা যা প্রায় ৬৫ দশমিক ২ শতাংশ। সব খাতের জিডিপি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সেবা খাতে ৫৬.৯ এবং ৩৪.২ শতাংশ শিল্প খাতের ক্ষতি হয়েছে। সেবা ও শিল্প খাত পুনরুজ্জীবনের বিকল্প নেই। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজ নয়। তিনি আরও বলেন, লকডাউনে বহুমাত্রিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে অনানুষ্ঠানিক খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষভাবে চা বিক্রেতা, ফেরিওয়ালা, খুদে দোকানি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প খাত। দেশে এ ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৮৬ লাখের উপরে। লকডাউনের সময় এদের মধ্যে ৬৫ লাখ সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে নবদরিদ্র গ্রুপে যেতে বাধ্য হয়েছে।