স্টাফ রিপোর্টার ।। ‘জীবনে ভোগের চেয়ে ত্যাগ বড়’-এই মানসিকতায় মানুষের জন্য মানুষের লড়াইয়ে থাকাই রাজনীতিবিদদের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। চিন্তা ও মননে এই ব্রত নিয়েই জীবনের ৭০ বছর এবং সংগ্রাম ও ত্যাগে রাজনীতির ৫০ বছর পূর্ণ করলেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা। সেই সংগ্রামী জীবনকে স্মরণীয় রাখতে এবং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী লড়াইয়ের শপথে বর্ণাঢ্য আয়োজনে উদযাপন করা হলো কমরেড বাদশার রাজনীতির ৫০ বছর। ১৯ নভেম্বর ঐতিহাসিক ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল জাতীয় উদযাপন কমিটি। এদিন রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমি সেজেছিল নতুন সাজে। প্রধান ফটক থেকে মিলনায়তন সাজানো হয়েছিল কাস্তে-হাতুড়ির লাল পতাকা আর কমরেড বাদশার সংগ্রামী জীবনের স্থির চিত্র দিয়ে। জাতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয় আয়োজনের মূল অনুষ্ঠান। কমরেড বাদশার ছাত্র জীবনের সংগ্রামী সহযোদ্ধা ইতিহাসবিদ মেজবাহ কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে আলোচক ও আয়োজকদের এমন আয়োজন করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন অনুষ্ঠানের মধ্যমণি রাকসুর সাবেক ভিপি, ছাত্র মৈত্রী ও যুব মৈত্রী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা। মূল বক্তা ছিলেন তার রাজনৈতিক গুরু এদেশের বাম আন্দোলনের আইকন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ জীবন্ত কিংবদন্তী কমরেড রাশেদ খান মেনন। বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক কমরেড বাদশার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক গবেষক কলামিস্ট শহিদুল ইসলাম, রাজনীতিবিদ ও সাবেক সাংসদ আদিবাসী নেতা উষাতন তালুকদার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির, সাবেক ছাত্রনেতা মনোয়ারুল হক, ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড নূর আহমদ বকুল, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী’র সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাদাকাত হোসেন খান বাবুল, শহীদ রিমু’র মা জেলেনা চৌধুরী, গবেষক জান্নাত-এ-ফেরদৌসী লাকী প্রমুখ। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড মুস্তফা লুৎফুল্লাহ। সঞ্চালনা করেন কমেরড বেনজির আহমেদ ও কমরেড নাসরিন খান লিপি।
অনুষ্ঠানে কমরেড রাশেদ খান মেনন বলেন, “দেশ এক গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ সংকট, অন্যদিকে বৈশি^ক সংকট। অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলা করতে না পারলে বৈশি^ক সংকট মোকাবেলা করা যাবে না।”
তিনি বলেন,“দেশে মূল্যস্ফীতি যখন চরম মাত্রায় রূপ নিয়েছে, তখনো ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাঠানো হচ্ছে। এর ফলে অনেক আগেই যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল তা চরম মাত্রায় রূপ নিয়েছে।”
বর্ষীয়ান এ নেতা আরো বলেন,“রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাও একটি বড় সংকট। ক্রমেই তা বিকশিত হচ্ছে এবং ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। নির্বাচনের নামে, আন্দোলনের নামে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আস্ফালন বাড়ছে। এই সময়ে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী বৃহত্তর ঐক্য। একই সাথে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সেই দায়িত্ব নিতে হবে কমরেড বাদশা ও ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমাদের সকলকে। দায়িত্ব নিতে হবে সরকার ও সকল প্রগতিশীল শক্তিকে। তবেই আমরা এ সংকট থেকে রক্ষা পাব।”
কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা তার বক্তব্যে বলেন,“সামরিক এরশাদ সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী আমাকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে টর্চার সেলে রেখে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়াতে পূর্ণমন্ত্রীর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি এরশাদের সরকারকে অবৈধ সরকার বলে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।”
তিনি বলেন, “লড়াই সংগ্রামে যারা জীবন দিয়েছেন, তাদেরকে বুকে ধারণ করেই আমি রাজনীতি করি, ভবিষ্যতেও করব।”
কমরেড বাদশা বলেন,“মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু ’৭২-এর সংবিধানেও ধর্মনিরপেক্ষ শোষণমুক্ত জনগণের রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন। আমাদেরকে সেই সংবিধানে ফিরে মানুষের জন্য লড়াই করতে হবে। মানুষের মনে বিশ^াস ও আস্থা জাগাতে হবে। তার জন্য বাহাত্তোরের সংবিধানকে সামনে আনা দরকার।”
আলোচক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন,“আমাদের দেশে শিক্ষা নেই, শিক্ষার্থী নেই আছে কেবল পরীক্ষার্থী। বিশ^ ব্যাংকের পরামর্শে শিক্ষাকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। নেই সংস্কৃতি। সবার আগে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষাকে ফিরিয়ে আনতে হবে, সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটাতে হবে। তবেই সংকট থেকে মুক্তি মিলবে। ফজলে হোসেন বাদশা সেই লড়াইয়ে ছিলেন, আমি আশা করব তিনি আরো বহুকাল সেই লড়াইয়ে থাকবেন।”
পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড নূর আহমদ বকুল বলেন,“’’৭৫ পরবর্তী সময়ে রাজনীতির যে উল্টোধারা শুরু হয়েছিল তা থেকে আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির ধারায়
ফিরিয়ে আনার প্রথম সংগ্রাম শুরু হয়েছিল রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ে। সেটা শুরু করেছিল এদেশের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনসমূহ। কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা ছিলেন সেই লড়াইয়ের অগ্রভাগের নেতা।”
সাংসদ মোক্তাদির চৌধুরী বলেন,“ চাঁন-তারা পতাকা কথা মনে হলে, বাংলা ভাইয়ের উত্থানের কথা মনে পড়লে তখন মাথায় ১৪ দল ও অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের কোনো বিকল্প আসে না। অনেক কিছু এমনকি নিজের দলকেও অচেনা লাগে। তবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতে এর বিকল্প দেখি না” আলোচনা শেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।