Home সারাদেশ ঐতিহাসিক লোগাঙ পদযাত্রা দিবসে খাগড়াছড়িতে ‘প্রতীকী লঙমার্চ’ করেছে পিসিপি

ঐতিহাসিক লোগাঙ পদযাত্রা দিবসে খাগড়াছড়িতে ‘প্রতীকী লঙমার্চ’ করেছে পিসিপি

31

চট্টগ্রাম অফিস: ঐতিহাসিক লোগাঙ পদযাত্রার ৩১ বছর উপলক্ষে ‘লোগাঙ গণহত্যা স্মরণে’ আজ ২৮ এপ্রিল ২০২৩, শুক্রবার সকালে খাগড়াছড়ি সদরে ‘প্রতীকী লঙমার্চ’ কর্মসূচি পালন করেছে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)।

আজ সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতীকী লঙমার্চটি খাগড়াছড়ি সদর হবঙপুজ্জ্যে এলাকার ইয়ং স্টার ক্লাব থেকে শুরু করে দশবল বৌদ্ধ বিহার গেইট, স্বনির্ভর বাজার প্রদক্ষিণ করে প্রায় ৭ কিলোমিটার মিছিল সহকারে পায়ে হেঁটে পেরাছড়া এলাকায় গিয়ে এক সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। এ সময় জামতলী, ধর্মপুর, নীলকান্ত পাড়া, চেলাছড়া, পল্টনজয় পাড়া, বেলতলী, লারমা পাড়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় অপেক্ষারত তিন শতাধিক ছাত্র-যুব-নারী-জনতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ লঙমার্চে অংশগ্রহণকারীদের করতালি দিয়ে স্বাগত জানান এবং স্ব উদ্যোগে লঙমার্চে অংশগ্রহণ করেন।

লঙমার্চ শেষে ১৯৯২ সালে ১০ এপ্রিল সংঘটিত লোগাঙ গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা ও সদস্য মিঠুন চাকমা এবং হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা। নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয়, যা ’৯২ সালের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে।

পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ‘আসুন, নব্বইয়ের ছাত্র জাগরণের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হই, দমন-পীড়ন ও দালাল-লেজুড়দের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলুন’ এই শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে পিসিপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শুভাশীষ চাকমার সভাপতিত্বে ও খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি শান্ত চাকমার সঞ্চলনায় বক্তব্য রাখেন ইউপিডিএফের খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের সংগঠক বিপুল চাকমা ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা।

সমাবেশে সাবেক ছাত্র নেতা ও ইউপিডিএফ সংগঠক বিপুল চাকমা বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বহিরাগত সেটলার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের ওপর ডজনের অধিক গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। আজ পর্যন্ত কোন গণহত্যার বিচার পাহাড়ি জনগণ পায়নি। এ বিচার অবশ্যই সরকার ও রাষ্ট্রকে একদিন না একদিন করতে হবে এবং পাহাড়ি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ লড়াই সংগ্রামে সামিল হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে চাপ সৃষ্টি করে পাহাড়ে সকল গণহত্যার বিচার করতে সরকারকে বাধ্য করাতে হবে।

পূর্ণস্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের সামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন মানবেন্দ্র নারায়ন লারমার নেতৃত্বে পাহাড়ি জনগণ পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বায়ত্তশাসন দাবি উত্থাপন করেছিল। কিন্তু শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সেটা কর্ণপাত না করে উল্টো বাঙালি হবার পরামর্শ দিয়েছিল।

তিনি বলেন, পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জেএসএস শান্তিবাহিনী গঠন করে সরকারে সাথে দীর্ঘ সশস্ত্র লড়াইয়ের পর ১৯৯৭ সালে জেএসএস ও সরকারের মধ্যে ‘পার্বত্য চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। জেএসএস-এর সাথে সরকারের করা এ চুক্তি আজ ২৫ বছরে অধিক হলেও পাহাড়ি জনগণের অধিকার অর্জিত হয়নি। সুতরাং পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই। ইউপিডিএফ-এর নেতৃত্বে এ পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনে পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই সংগ্রাম জোরদার করতে হবে।

পিসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা বলেন, কোন রাষ্ট্র কর্তৃক একটা জাতির ওপর গণহত্যা, দমন-পীড়ন, নির্যাতন চালিয়ে সেই জাতিকে ধ্বংস করতে পেরেছে কিংবা তাদের আন্দোলন, সংগ্রামকে দমন করতে পেরেছে তার নজির ইতিহাসে নেই। যেমনটা ভিয়েতনামে আমেরিকা পারেনি, চীনে জাপানিরা পারেনি, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পারেনি এ পূর্ব বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করতে। বাংলাদেশ সরকার যদি পাহাড়ি জনগণের অস্তিত্বকে ধ্বংস করতে দমন-পীড়ন, হত্যার পথকে বেছে নেই তাহলে ভুল করবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা একটি রাজনৈতিক সমস্যা। সুতরাং এ সমস্যাকে সমাধান করতে হলে রাজনৈতিকভাবে সমাধান করতে হবে।

নারী নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, আজকে এ প্রতীকী লঙমার্চে তিন শতাধিক ছাত্র-যুব-নারী-জনতা ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এভাবে যদি আমরা নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকারের জন্য, নিজ বাস্তুভিটা-নারীদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে যেতে পারি, আন্দোলনে সামিল হই, শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ, নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই তাহলে কোন অপশক্তি পাহাড়ি জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে দমন করতে পারবে না।

তিনি নারী অধিকারসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়িত জনগণের অস্তিত্ব রক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে লড়াই সংগ্রামে এগিয়ে আসার জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।

সমাবেশ থেকে বক্তারা লোগাঙ গণহত্যাসহ রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও বহিরাগত সেটলার কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত সংঘটিত সকল গণহত্যার শ্বেতপত্র প্রকাশ ও সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানান।

প্রসঙ্গত, ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় সেটলার বাঙালিরা খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাঙ গুচ্ছগ্রামে পাহাড়িদের ওপর বর্বর গণহত্যা সংঘটিত করে। সেটলাররা দা, বটি, কুড়াল দিয়ে পাহাড়িদের উপর আক্রমণ করে এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যরা পাহাড়িদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। এতে কয়েকশত পাহাড়ি হতাহত হয়। অনেকে নিঁখোজ হয়ে যায়। সেদিন শিশু, বৃদ্ধ, নারী কেউই রেহাই পায়নি। অগ্নিসংযোগ করে ছাই করে দেওয়া হয় পাহাড়িদের ৭ শতাধিক ঘরবাড়ি।

উক্ত হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ১৯৯২ সালের ২৮ এপ্রিল পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের নেতৃত্বে খাগড়াছড়ি সদরের কড়ইতলা (খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ প্রাঙ্গন) থেকে পানছড়ির লোগাঙ অভিমূখে মৌন পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। উক্ত পদযাত্রায় তিন পার্বত্য জেলার হাজার হাজার ছাত্র-জনতা সামিল হয়েছিলন। ঢাকা থেকে আগত প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের নেতা, ছাত্র নেতা, সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মি ও লেখকরাও জুম্ম জনগণের আন্দোলনের সাথে সংহতি জানিয়ে এই পদযাত্রায় অংশ নেন। তাদের এই অংশগ্রহণ জুম্ম জনগণের মনে আরো বেশী শক্তি ও সাহস সঞ্চার করে।

সেদিন পদযাত্রা সফল করা সহজ ছিল না। খাগড়াছড়ি-পানছড়ি রাস্তায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর চেকপোষ্ট অতিক্রম করে সকল রক্ত চক্ষু ও বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে ছাত্র-জনতা পদযাত্রা সহকারে হত্যাযজ্ঞস্থল লোগাঙ পোড়া ভিটায় গিয়ে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পুস্পস্তবক অর্পণের মাধ্যমে শহীদদের প্রতি যথাযথ সম্মান জানায় এবং ধর্মীয় বিধান মতে শহীদদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করে দেয়। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের লড়াই সংগ্রাম এক নতুন মাত্রা লাভ করে।