Home মতামত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি- ১৭

একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি- ১৭

45

সাইফুল ইসলাম শিশির: গাংনী উপজেলার ছোট একটি গ্রাম চাঁদপুর। গাংনী নামের সাথে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের পরিবেশ পরিচিতি। নদী বা নদীর মৃতপ্রায় ধারাকে এ জনপদের মানুষ গাং বা গাঙ বলে। ধারণা করা হয়, গাঙ্গেয় অববাহিকায় যারা প্রথম বসতি স্থাপন করেছিলো তারা অন্যদেরকে বসবাসে উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে গাং অর্থাৎ নদী নেই এমন প্রচার করে। সাধারণ মানুষ নেই কে নি বলে। গাং নেই থেকে হয়ে যায় গাংনী।

মানিক- হিরা- আহমদ আলী সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেছে। আমি শুধু একা চাঁদপুরে পড়ে আছি। একাকীত্বের যে কী দুর্বিসহ জ্বালা, ভুক্তভোগী মাত্রই তা জানে। ‘সময় বহিয়া যায়।’ এক সময় মিন্টু, আবু, আফজেল কামলা- মুনিষ এরাই আমার ঘনিষ্টজন হয়ে ওঠে। তাদের সাথে গল্পগুজব করে সময় কাটে। বনবাদাড়- মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াই। রোদেলা দুপুরে মিন্টুর সাথে বাঘ- ছাগল খেলি। ‘আফজেল’কে সাথে নিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটি, জাল দিয়ে মাছ ধরি।

সকালে যে যার মতো কাজে যায়। ফিরে আসার সময় আখ, ছোলা- বুট, বরই, টমেটো, কলা, গুড় গামছায় লুকিয়ে এনে আমার হাতে দেয়। বারণ করেছি, কিন্তু সেকথা কেউ আমলে নেয়নি। কিছু একটা দিতে পারাটাই যেন সবার আনন্দ। মুখ জুড়ে সেকি তৃপ্তি- ‘ভরা ফসলের মাঠে কৃষকের হাসি।’

আবু, আফজেল, মিন্টু মিলে সিদ্ধান্ত নেয় রাতে সালদার বিলে মাছ ধরবে। যে কথা সেই কাজ। বিকেলটা কেটেছে ব্যস্ততার মধ্যে। সাঁঝরাতে পলো, খালুই, বাঁশের তৈরী মশাল, টর্চলাইট নিয়ে প্রস্তুত। আমিও তাতে সঙ্গি হলাম। মাছ ধরতে যাচ্ছি জেনে চাচা- চাচি দু’জনেই মানা করেন। আমি পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকবো, পানিতে নামবো না এই শর্তে অবশেষে সম্মতি মেলে। জহুরা দরজার আড়াল থেকে হাসে। “মেহমান দাও- বটি নিয়ে বসে থাকলাম। আজ বুঝি মাছ কুটে শুমার পাবো নানি।”

দূর থেকে দেখা যাচ্ছে সালদা বিলের পাড়ে যেন আলোর মিছিল। রাতের বেলা কিছু কিছু মাছ পাড়ে উঠে আসে, অল্প পানিতে চলাচল করে। আলো দেখলে চুপ মেরে থাকে। টর্চের দিয়ে আলো ফেলে, ছোট পলো দিয়ে মাছ ধরতে হয়। টলটলে বিলের পানিতে শোল, টাকি, পুঁটি, শিং নয়না, ফলি মাছ পরিষ্কার দেখা যায়। দেখে ভীষণ মজা লাগে। আমি যেন সম্বিত হারিয়ে ফেলি। এক সময় নিজেকে আবিষ্কার করি, আমিও পানিতে নেমে মাছ ধরছি। মাছ ধরার আনন্দ- উত্তেজনায় কখন যে রাত্রি গভীর হয়েছে তা আমরা কেউ টেরই পাইনি। খালুই ভর্তি মাছ নিয়ে যখন বাড়ি ফিরে আসি তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর।

আফজেলের সাথে কথা হলো আজ রাতে পাখি ধরতে বিলের ধারে যাবো। নভেম্বর- ডিসেম্বর মাসে বিলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি বসে। বাবুইপাখির ন্যায় ছোট্ট ছোট্ট ‘বাঘাড়’ পাখিগুলি রাত্রে আখ ক্ষেতের ভিতর এসে আশ্রয় নেয়। মানুষের পদশব্দ শুনলে ক্ষেতের আইলে জড়ো হতে থাকে। এদিকওদিক তাকায়। রাতের বেলায় এরা উড়তে পারে না, ভয় পায়। চোখের উপর টর্চের আলো ফেলে হাত দিয়ে টপাটপ ধরে ফেলা যায় অনায়াসে। ক্ষেতের আইলে জাল পেতে রাখলে, জালেও ‘বাঘাড়’ পাখি ধরা পড়ে।

ছোট্ট পাখি দু’হাত দিয়ে ধরতে থাকি। হাতের ভিতর ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। ছোট্ট চষ্ণু দিয়ে হাতের তালুতে বিলি কাটে। মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। নিরাপদ আশ্রয় খোঁজার সেকি আকুতি। আশ্রয় ভেবে এক সময় হাতের তালুর ভিতর চুপ হয়ে থাকে। পরক্ষণেই বিবেক আমাকে নাড়া দেয়। পাখি শিকার এমন নিষ্ঠুর কাজ করি কেমনে?

আফজেল কে বললাম পাখি যা ধরেছো সবগুলো ছেড়ে দাও। পাখি আর ধরবো না, চলো ফিরে যাই। সবাই হা হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আবারও তাগাদা দেই। আমতা আমতা করে আফজেল আখ ক্ষেতের ভিতর পাখি গুলিকে মুক্ত করে দেয়। হঠাৎ কেন এ সিদ্ধান্ত? কারণ সবার কাছে তখনও অজানা।

যখন ফিরছি তখন কারও মুখে কোন কথা নেই। আমার মনে হচ্ছে হাতের ভিতর পাখিগুলো এখনও থর থর করে কাঁপছে।

চলবে —


২২ অক্টোবর, ২০২১ সাল
থানা রোড, সিরাজগঞ্জ- ৬৭০০