Home সাহিত্য ও বিনোদন আজ কবি রুদ্র’র ৬৭তম জন্মদিন

আজ কবি রুদ্র’র ৬৭তম জন্মদিন

681

ভালো আছি ভালো থেকো আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো

মোংলা থেকে মোঃ নূর আলমঃ আজ ১৬ অক্টোবর তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ’র ৬৭তম জন্মবার্ষিকী। কবি ”ভালো আছি ভালো থেকো” কালজয়ী গানটি মোংলার মিঠেখালিতে আমাদের চোখের সামনেই সৃষ্টি করেছেন। আমি সৌভাগ্যবান সেই গান নির্মানকালের একজন প্রত্যক্ষদর্শী; কালের সাক্ষী। তাই কবির জন্মদিনে সেই গানের ভাষায় বলতে চাই ”ভালো আছি ভালো থেকো/আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো”। শুভ হোক কবি রুদ্রের জন্মদিন। বাংলাদেশের কবিতায় অবিসস্মরণীয় এই কবির শিল্পমগ্ন উচ্চারণ তাঁকে দিয়েছে সত্তরের অন্যতম কবি-স্বীকৃতি। ১৯৯১ সালের ২১ জুন মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি মারা যান।

অকালপ্রয়াত এই কবি নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে। সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্যচেতনা ও অসাম্প্রদায়িকবোধে উজ্জ্বল তাঁর কবিতা। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’- এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি উচ্চারণ করেছেন অবিনাশী স্বপ্ন ‘দিন আসবেই, দিন আসবেই, দিন সমতার’। যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাঁকে পরিণত করেছে ‘তারুণ্যের দীপ্র প্রতীক’-এ। একই সঙ্গে তাঁর কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা।

মাত্র ৩৫ বছরের (১৯৫৬-১৯৯১) স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্যনাট্য এবং ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ সহ অর্ধশতাধিক গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন। পরবর্তীকালে এ গানটির জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ সালের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরণোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন।‘উপদ্রুত উপকূল’ ও ‘ফিরে চাই স্বর্নগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থ দুটির জন্য ‘সংস্কৃতি সংসদ’ থেকে পরপর দু’বছর ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরষ্কার লাভ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করেন। মোংলার মিঠেখালিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন ’অগ্রদূত’ ক্লাব ও গানের দল ’অন্তর বাজাও শিল্পী গোষ্ঠি’।

১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ জন্মগ্রহণ করেন। পিতা- ডা. শেখ ওয়ালী উল্লাহ, মাতা-শিরিয়া বেগম। বর্তমান বাগেরহাট জেলার মোংলা উপজেলার মিঠেখালি গ্রামেই কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ শৈশব-কৈশোর এবং যৌবনের সোনালি সময় অতিবাহিত করেছেন। এখানকার পাঠশালাতেই তাঁর পড়াশুনা শুরু। পরবর্তীতে মোংলার সাহেবেরমেঠ গ্রামে তাঁর নানার নামে প্রতিষ্ঠিত ’ইসমাঈল মেমোরিয়াল স্কুলে’ দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। এরপর মোংলার সেন্ট পল্স উচ্চ বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। পাঠ্য বইয়ের পাশপাশি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা পড়া ও কবিতা আবৃত্তির প্রতি তাঁর ঝোঁক দেখা যায়। এ স্কুলে পড়াকালীন নিয়মিত কবিতা আবৃত্তি ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। মামাতো ভাইদের সঙ্গে নিয়ে নানীর ট্রাংক থেকে টাকা চুরি করে নিয়ে গড়ে তোলেন ’বনফুল’ নামের লাইব্রেরি। এসময় তিনি কাঁচা হাতে লিখতে শুরু করেছেন। খেলাধূলার প্রতি খুবই আগ্রহ। ভালো খেলেন। মোংলায় প্রথম ক্রিকেট দল তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন। উন্নসত্তুরের গণঅভুত্থানের সময় কিশোর রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ পূর্ব পাকিস্তানের গণআন্দোলনের কর্মসুচিতে অংশনেন। হরতাল, মিছিল, মিটিংয়ে নিয়মিত যোগ দিতেন। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নবম শ্রেণীর ছাত্র। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠেন রুদ্র। কিন্তু পারিবারিক প্রচন্ড বাঁধার কারনে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও পরোক্ষ ভাবে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। সমর্থন যুগিয়েছেন মুক্তির সংগ্রামকে। নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ কতোটা আধুনিক, প্রগতিশীল এবং দ্বন্ধময় বেগবান দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন; তা অনুমান করা যাবে ১৯৮৩ সালে জুন মাসের ১৮ তারিখে তাঁর বাবাকে লেখা চিঠির কয়েকটি লাইন যদি পড়ি। তা ছিলো এরকম ”এ তো চরম সত্য কথা যে, একটি জেনারেশনের সাথে তার পরবর্তী জেনারেশনের অমিল এবং দ্বন্ধই থাকবেই। যেমন আপনার আব্বার সাথে ছিলো আপনার। আপনার সাথে আমার এবং পরবর্তীতে আমার সাথে আমার সন্তানের। এই দ্বন্ধ ও সংঘাত কোনো ভাবেই রোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধু এই সংঘাতকে যুক্তিসংগত করতে পারি। অথবা পারি কিছুটা মসৃন করতে। সংঘাত রোধ করতে পারি না। পারলে ভালো হতো কিনা জানিনা তবে মানুষের জীবনের বিকাশ থেমে যেতো পৃথিবীতে”। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বিশ্বাস করতেন সাহিত্যের জ্বালানি হচ্ছে রাজনীতি। কবিতায় তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেছেন ”আমি কবি নই-শব্দ শ্রমিক। শব্দের লাল হাতুড়ি পেটাই ভুল বোধে ভুল চেতনায়, হৃদয়ের কালো বেদনায়”। কবি নিজেকে আর্টিস্ট কাম একটিভিস্ট মনে করতেন। দেশের অশুভ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবিদের কী ভূমিকা হতে পারে এমন এক প্রশ্নের জবাবে কবি রুদ্র বলেছিলেন ”রাজনীতি সচেতন একজন মানুষের যে ভূমিকা হবে, একজন কবিও সেই ভূমিকা গ্রহণ করবেন। সংগ্রামী ভূমিকা ছাড়াও কবিকে বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হয়, তা হলো-পাশাপাশি তাকে সংগ্রামী কবিতাও লিখতে হবে”।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ গর্ভে থাকা অবস্থায় তাঁর মা আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন বরিশালে। সেই সময়ে বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে রেডক্রস হাসপাতালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইশতেহার কবিতায় রুদ্র বলেছেন ”এই পৃথিবীর এক কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে যে-শিশুর জন্ম/দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে ছুটে বেড়ানোর অদম্য স্বপ্ন যে-কিশোরের/ জোস্না যাকে প্লাবিত করে/বনভূমি যাকে প্লাবিত করে/নদীর জোয়ার যাকে ডাকে নেশার মতো/ অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ঔপনিবেশিক জোয়াল/গোলাম বানানোর শিক্ষাযন্ত্র/অথচ যার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে/—- অথচ যাকে শৃংখলিত করা হয়েছে স্বপ্নহীন সংস্কারে”।

কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ইচ্ছে ছিলো শস্য আর স্বাস্থ্যের, সুন্দর আর গৌরবের কবিতা লিখবার। তিনি চেয়েছিলেন বসন্ত আর বৃষ্টির বন্দনা করে গান গাইবেন। রুদ্র তাঁর কবিতায় বলেছিলেন ”আমরা উৎসব করবো শস্যের। আমরা উৎসব করবো পূর্ণিমার। আমরা উৎসব করবো গৌরবময় মৃত্যু আর বেগবান জীবনের। কিন্তু- এই স্বপ্নের জীবনে যাবার পথ আটকে আছে সামান্য কিছু মানুষ।— তারা সবচে’ কম শ্রম দেয় আর সবচে’ বেশি সম্পদ ভোগ করে। তারা সবচে’ ভালো খাদ্যগুলো খায় আর সবচে’ দামি পোশাক গুলো পরে”। এই কথা বলেই কবি ক্ষান্ত হয়নি। কবি সমাধানের পথ দেখিয়ে বলেছেন ”একদা অরণ্যে যেভাবে অতিকায় বন্যপ্রাণী হত্যা কোরে আমরা অরণ্য জীবনে শান্তি ফিরিয়ে এনেছি, আজ এই সব অতিকায় কদাকার বন্য মানুষগুলো নির্মূল কোরে আমরা আবার সমতার পৃথিবী বানাবো। সম্পদ আর আনন্দের পৃথিবী বানাবো। শ্রম আর প্রশান্তির পৃথিবী বানাবো”। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আজ যদি বেঁচে থাকতেন তাঁর বয়স হতো ৬৭ বছর। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে দেহত্যাগ করেছেন। বেঁচে থাকলে তাঁর কাছ থেকে হয়তো আরো সৃষ্টিশীল শিল্পমান উত্তীর্ণ সাহিত্য আমরা পেতাম। কিন্তু যা পেয়েছি তাও বা কম কীসে। এমন কোন গণআন্দোলন; গণসংগ্রাম নেই যেখানে রুদ্র’র কবিতা আবৃত্তি হয়না। কবি রুদ্র’র ৬৭তম জন্মবার্ষিকীর এইদিনে তাঁকে সশ্রদ্ধ সালাম জানাই এবং কবির ভাষায় বলি ”চ’লে যাওয়া মানেই প্রস্থান নয়-বিচ্ছেদ নয়/ চ’লে যাওয়া মানেই নয় বন্ধন ছিন্ন করা আর্দ্র রজনী/ চ’লে গেলে আমারো অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না থাকা জুড়ে”। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ আমাদের চেতনার বাতিঘর। সবুজ শ্যামল এই দেশে; শুভ হোক রুদ্র’র জন্মদিন।

-লেখকঃ মোঃ নূর আলম শেখ আহ্বায়ক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মোংলা ।