Home মতামত আজকের কাগজের সেই মুক্তচিন্তার জাগরণে বেঁচে থাকবেন কাজী শাহেদ

আজকের কাগজের সেই মুক্তচিন্তার জাগরণে বেঁচে থাকবেন কাজী শাহেদ

32

সোহেল সানি:

স্বৈরাচারমুক্ত বাংলাদেশে প্রথম দৈনিক আজকের কাগজের (অধুনালুপ্ত) প্রকাশক কাজী শাহেদ আহমেদ চলে গেলেন চিরঅচেনার দেশে। তাঁর সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলতে পারি, ” সমাজকল্যাণবোধ ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছাড়াও জাগ্রত হতে পারে, কিন্তু দেশপ্রেম দেশের ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছাড়া উদ্ভূত হয় না।”
এই উক্তিটির সংস্পর্শলাভের সুযোগ নিতান্তই কতজনের হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়। তবে আমার ধ্যানমগ্ন ভাববোধে কাজী শাহেদ চরিতটি একটি স্থিরচিত্র রূপে চোখের সম্মুখে দন্ডায়মান হচ্ছে। তাঁর জীবনচরিত যা যা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত এবং আলোড়িত, তন্মধ্যে রবীন্দ্রনাথের উপর্যুক্ত উক্তিটির অনবদ্য প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সেই মস্তবড় প্রভাবটি প্রকাশ্যরূপ গ্রহণ করে প্রাত্যহিক বা দৈনিক একটি জনপ্রয়াসের মাধ্যমে। যে প্রয়াসের আক্ষরিক নাম ‘দৈনিক আজকের কাগজ।’
খুব করে মনে পড়ছে, যুগোপযোগী আধুনিক চিন্তাধারার জবাবদিহিমূলক একটি স্বাধীন সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। সাংবাদিকতায় সদ্য জাগ্রত একজন তরুণ সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের ওপর এক ঝুঁকিপূর্ণ নির্ভরতা রেখে তিনি অগ্রসর হচ্ছিলেন। আধুনিক প্রাকৃতমনস্ক মুক্তচিন্তাকে সমীহ করে যে শক্তি ও সাহস তিনি যুগিয়েছিলেন, তা সত্যিই অবিস্মরণীয়।
নব্বই এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আগে রাজপথের সাহসী মিছিলে গিয়েও মনে পড়তো, বিদ্রোহী কবি নজরুলের কিছু জ্বালাময়ী উক্তি।
কবির ভাষায়- ” পথ- পার্শ্বের ধর্ম-অট্টালিকা আজ পড় পড় হইয়াছে, তাহাকে ভাঙিয়া ফেলিয়া দেওয়াই আমাদের ধর্ম, ঐ জীর্ণ অট্টালিকা চাপা পড়িয়া বহু মানবের মৃত্যুর কারণ হইতে পারে। যে ঘর আমাদের আশ্রয় দান করিয়াছে, তাহা যদি সংস্কারাতীত হইয়া আমাদের মাথায় পড়িবার উপক্রম করে, তাহাকে ভাঙিয়া নতুন করিয়া গড়িবার দুঃসাহস আছে একা তরুণেরই।”
কাজী শাহেদ আহমেদ হয়তো বিদ্রোহী কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলিয়ে তরুণদের দিয়েই একটি দুঃসাহসিক অভিযানে নেমে পড়েছিলেন। সামরিক ছাউনি থেকে বেরিয়ে আসা কর্নেল শাহেদ গণমানুষের কল্যাণে সংবাদপত্রকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তেজস্বী ও তারুণ্যদীপ্ত একজন সম্পাদক হিসেবে নাঈমুল ইসলাম খান কাজী শাহেদের স্বপ্ন চিন্তার সঙ্গে নিজের স্বপ্ন চিন্তাকে একীভূত করে এমন একটা টিম ওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে দেশময় আজকের কাগজ সাড়া জাগিয়েছিল। আজকের কাগজের পাঠকের সংখ্যা শুধু নয়, সংবাদপত্র নিয়েই মানুষের মাঝেই ইতিবাচক সাড়া পড়ে যায়।
কাজী শাহেদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধে উজ্জীবিত একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। যেমন ছিলেন খাঁটি মুসলমান, ঠিক তেমনি ছিলেন খাঁটি বাঙালি।
কাজী শাহেদ আহমেদের সঙ্গে জীবনে একটুআধটু যে আলাপচারিতা হয়েছে, তাতে মনে হতো তাঁর মধ্যে কখনো নজরুলের বিদ্রোহী প্রভাব আবার কখনো রবীন্দ্রনাথের প্রেমময় মানবিক প্রভাব বিরাজ করতো।
গণমানুষের জন্য যে সংবাদপত্র এবং তা কোনভাবেই কোনো ধর্মগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য হতে পারে না, নজরুলের সেকালের পত্রিকা নবযুগের দিকে দৃষ্টি ফেরালেই উপলব্ধি করা যায়।
“আজ আমরা মুসলিম তরুণেরা, যেন অকুণ্ঠিত চিত্তে মুক্তকণ্ঠে বলিতে পারি, ধর্ম আমার আমাদের ইসলাম, কিন্তু প্রাণের ধর্ম আমাদের তারুণ্য, যৌবন। আমরা সকল দেশের, সকল জাতির, সকল ধর্মের, সকল কালের। আমরা মুরিদ যৌবনের। এই জাতি-ধর্ম-কালকে অতিক্রম করিতে পারিয়াছে যাঁহাদের যৌবন, তাঁহারাই আজ মহামানব, মহাত্মা, মহাবীর। একজন সংবাদকর্মী ও পাঠক হিসেবে তখন আমার মনে বলেছে,
আজকের কাগজের যাত্রাও উপর্যুক্ত বিশ্বাসের ওপর স্থির হয়েছিল। তাই আমরা দেখেছি, গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের ফাঁসি হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরিতে আজকের কাগজের অনবদ্য ভুমিকা। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত ভোট ও ভাতের আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসাবে পত্রিকাটির ভুমিকা পাঠকের মনে জ্বলজ্বল স্মৃতি হয়ে আছে। রোষানল থেকে রক্ষার জন্য সংবাদপত্রে একসময় প্রচলন ছিলো, নাম আড়াল করে ছদ্মনামে কলাম লেখা। মানে সম্পাদকীয় উপসম্পাদকীয়গুলো যেন আড়ালে আবডালে বসে ক্ষমতাসীন দল, বিরোধী দল এমনকি লুটেরা শ্রেণীর বিরুদ্ধে আলোচনা সমালোচনা করা হতো। কিন্তু সেই ধারাটি পাল্টে দেয় আজকের কাগজ। সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানই এই ধারার প্রবর্তক।
সত্যিই সংবাদপত্রের গতানুগতিক ধারার আমূল পরিবর্তন এনে দিতে আজকের কাগজ যে বার্তা বাতলে দিয়েছিল, সেই পথেই হেঁটে হেঁটে সংবাদপত্র আজ একটা শিল্পতে দাঁড়াতে সক্ষম হচ্ছে। পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠার পরপরই আজকের কাগজ -এ একটা বিপর্যয় ঘটে। নাঈমুল ইসলাম খান পুরো টিমসহকারে চলে গিয়ে প্রকাশ করেন দৈনিক ভোরের কাগজ। স্বভাবতই ভোরের কাগজের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি চলে যায়। কিন্তু তারপরও কাজী শাহেদ আহমেদ নিজেই সম্পাদক হন। আজকের কাগজের বিপর্যয় রুখে দিতে সক্ষম হলেও কাজী শাহেদের এ ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে অগ্রসর হওয়া একরকম কঠিনই ছিলো। তারপরও আজকের কাগজ একটা মানসম্মত দৈনিক হিসেবেই পাঠক মহলে সমাদৃত ছিলো। বলাবাহুল্য, ভোরের কাগজেও পটপরিবর্তন ঘটে। প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরী মতিয়ুর রহমাকে সম্পাদক করেন নাঈমুল ইসলাম খানকে সরিয়ে। পরবর্তীতে মতিয়ুর রহমান ট্রান্সকম গ্রুপের পক্ষে দৈনিক প্রথম আলো বের করেন ভোরের কাগজের প্রায় পুরো টিম নিয়ে গিয়ে। অপরদিকে নাইমুল ইসলাম খান দৈনিক আমাদের সময় বের করে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিলেন, ঠিকই কিন্তু সেটি তিনি ব্যবসায়ী নূর আলীর কাছে বিক্রি করে দেন।
কাজী শাহেদ আহমেদের দৈনিক আজকের কাগজ আজ অধুনালুপ্ত। তিনি যে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা করেছিলেন, সাংবাদিক ও সম্পাদকদের স্থায়ীত্ব না দেখতে পেয়ে, অর্থাৎ রাতারাতি টিম শুদ্ধ পত্রিকাবদলকে অসংস্কৃতি হিসাবে দেখতেন। এজন্য তিনি ব্যথিতও ছিলেন। কাজী শাহেদ আহমেদ পুত্র নাবিল আহমেদকে দিয়েছিলেন আজকের কাগজ পরিচালনার জন্য। কিন্তু তাকে রাজনীতিতেই বেশি সময় খরচ করতে হয়। আওয়ামী দলীয় সংসদ সদস্যও তিনি। এসব কারনে নব্বই দশকের একটি সোনালী অর্জন আজকের কাগজ হারিয়ে গেলো। পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদও চিরঅচেনার দেশে চলে গেলেন। তারপরও বেঁচে থাকবেন তাঁর অসাধারণ প্রকাশ আজকের কাগজের জন্য। কেননা, আজকের সেইসব তেজস্বী দুরন্ত সাংবাদিকরাই আজ গণমাধ্যমের শীর্ষ পদগুলো অলংকৃত করে আছেন।

-লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক।