Home রাজনীতি আগামীকাল কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

আগামীকাল কমরেড আ ফ ম মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী

29

ডেস্ক রিপোর্ট: আগামীকাল ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ এর আহ্বায়ক আজীবন বিপ্লবী কমরেড আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের ৫ম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৭ সালের এই দিনে তিনি কানাডার আটোয়া দেহ ত্যাগ করেন। কমরেড আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক কে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতিতে অসম সাহসী পদচারণা এদেশের মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ রাখবে। প্রথমে স্বাধীনতা, পরে সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি আমৃত্যু লড়াই চালিয়ে গেছেন। লোভ-লালসা কিংবা ভয়ভীতি তার পথচলা থামাতে পারেনি। সমাজবিপ্লবের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন অবিচল। এ কারণে বুর্জোয়া শাসকগোষ্ঠীর কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্ক।
বিপ্লবী রাজনীতিতে বহু আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। যে ইতিহাস সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে প্রেরণা জোগায়। আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের জীবন সংগ্রামে ছিল তেমনি আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত। স্লোগান মিছিল আর লড়াই ছিল তার জীবনের অংশ।
আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর, নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা মৌলভী ফজলুল হক, মাতা মরিয়ম নেছা। ছয় বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন তিনি। একমাত্র ছেলে হিসেবে সমাজের আর দশজনের মতো শুধু পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীল হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তিনি মা-বাবা ও পরিবারের প্রতি যত্নবান হতে পারেননি। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলাই ছিল তার জীবনের প্রধান কাজ। সহকর্মীদের সেই আদর্শে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।
আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। নিজ গ্রামে প্রাইমারি স্কুলে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। তিনি ১৯৬৪ সালে কুমিল্লা বোর্ড থেকে এসএসসিতে চতুর্থ স্থান এবং ১৯৬৬ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় একই বোর্ড থেকে ১১তম স্থান অধিকার করেন। ১৯৬৬-৬৯ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন।

আ.ফ.ম. মাহবুবুল হকের পুরো নাম আবুল ফজল মোহাম্মদ মাহবুবুল হক মুকুল। ১৯৬২ সালে স্কুলজীবনে শরীফ কমিশনের প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। ওই সময় তার ছাত্র রাজনীতিতে পদার্পণ ঘটে। তিনি ১৯৬৭-৬৮ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগ সূর্যসেন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-৭০ সালে কেন্দ্রীয় সহ-সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাপন্থী ১১ সদস্যের যে নিউক্লিয়াস গঠন করা হয়েছিল, আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক অন্যতম সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতাযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফের রাজনৈতিক এবং গেরিলা যুদ্ধের অন্যতম প্রশিক্ষক ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৭৩-৭৮ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৮-৮০ সালে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও ১৯৮০ সালের ৭ নভেম্বর বাসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেন। ১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর পর্যন্ত তিনি বাসদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করেন। আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক বাংলাদেশের সকল প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বামপন্থীদের প্রথম জোট পাঁচ দলের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম ব্যক্তি ছিলেন আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। সমাজবিপ্লবের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য গড়ে তুলেছিলেন বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। যে ফ্রন্ট দেশের মানুষের আশার আলো হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সে ফ্রন্টেই প্রস্তাব উঠল ১১ দল গঠনের। ১১ দল গঠনের প্রশ্নে নোট অফ ডিসেন্ট দিয়ে এতে যুক্ত হলো বাসদ (মাহবুব)। এই ১১ দলীয় জোটকে যখন ১৪ দলীয় মহাজোটে যুক্ত করার প্রস্তাব উঠল, তখন অন্য বাম দলের আগেই বিবৃতি দিয়ে পাতিবুর্জোয়াদের জোট ১১ দল থেকে বের হয়ে যান তিনি। ৪বাম দলের সাথে যুক্ত হয়ে গড়ে তোলেন ৫বামদল, যা এখন গণতান্ত্রিক বামমোর্চা নামে কাজ করছে। এছাড়া জাতীয় সম্পদ রক্ষায় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠান তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। এছাড়া বহু গণতান্ত্রিক আন্দোলন, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে আ ফ ম মাহবুবুল হক ছিলেন আপোষহীন যোদ্ধা।
১৯৬৮ সালে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। ১৯৭৫ সালে ৮ নভেম্বর বায়তুল মোকাররমের সামনে জাসদের জনসভায় বক্তৃতারত অবস্থায় জিয়া-মুশতাকপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলির শিকার হন। এ সময় পেটে ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত বেঁচে যান তিনি। ১৯৭৬ থেকে ’৭৮ সাল পর্যন্ত রাজবন্দি হিসেবে জেলে কাটান। ১৯৮৬ সালে আবার কারাবরণ করেন। এছাড়াও ১৯৯৫ সালে ঋণখেলাপি কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে মিথ্যা মামলার আসামি হন।
১৯৭৪ সালে ছাত্রনেতা মাহবুবের পরিচয় হয় রাজনৈতিক সতীর্থ কামরুন্নাহার বেবীর সঙ্গে। ১৯৭৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। ১৯৮০ সালে একমাত্র সন্তান উৎপলা ক্রান্তির জন্ম হয়।
২০০৪ সালের ২৫ অক্টোবর অজ্ঞত ঘাতকদ্বাধা আঘাত প্রপ্ত হওয়ার পর দেশে চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসা জন্য ২০০৫ সালের মে মাসে মাহবুবুল হককে নিয়ে যাওয়া হয় কানাডায়। অটোয়া রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে প্রায় বছরখানেক চিকিৎসার পর কিছুটা ফিরে পান চলনশক্তি ও স্মৃতিশক্তি। আগের অসুস্থতার জের ধরে ২০০৯ সালে কানাডায় আবার শিকার হন Seizure Attack (সিজ্র অ্যাটাক) এবং ব্রেইন হেমারেজের। আবারও ফিরে আসে আগের সব শারীরিক ও মস্তিষ্কজনিত বিকলাঙ্গতা। সাত মাস ধরে সিভিক এবং মন্টফোর্ট হাসপাতালে চিকিৎসার পর আবারও ফিরে আসেন পারিবার এবং সতীর্থদের কাছে। তবে আগের মতো সুস্থ আর হতে পারেননি। সর্বশেষ ২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আবারও Seizure Attack (সিজ্র অ্যাটাক) এবং ব্রেইন হেমারেজে আক্রান্ত হন। এবারের রক্তক্ষরণের মাত্রা অনেক বেশি। আর ফিরলেন না। গত ১০ নভেম্বর ২০১৭ সালে ১০.১৫মিনিটে অটোয়া সিভিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আজীবন বিপ্লবী আ.ফ.ম. মাহবুবুল হক। পেছনে ফেলে যান অসংখ্য গুণগ্রাহী, পরিবার-পরিজন এবং সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তার সংগ্রামী শিক্ষা ও আপসহীন অঙ্গীকার। সেই অঙ্গীকার হোক নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীদের পাথেয়।

জয়তু কমরেড মাহবুবুল হক