Home মতামত অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাতঃস্মরণীয় কীর্তিমান রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬১তম...

অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রাতঃস্মরণীয় কীর্তিমান রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ৬১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

26

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

বিদ্যমান বৈষম্যের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংগ্রামে প্রাতঃস্মরণীয় কীর্তিমান রাজনীতিবিদ শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের ৬১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
প্রথিতযশা ও কিংবদন্তী রাজনীতিবিদ তিনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাঙালি কূটনীতিক হিসেবেও বেশ পরিচিত ছিলো তাঁর। রাজনৈতিক মহল এবং সাধারণ মানুষের নিকট শের-এ-বাংলা (বাংলার বাঘ) এবং ‘হক সাহেব’ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি রাজনৈতিক অনেক পদে অধিস্তান করেছেন তার মধ্যে কলকাতার মেয়র (১৯৩৫), অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী (১৯৩৭ – ১৯৪৩), পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী (১৯৫৪), পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী (১৯৫৫), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৬ – ১৯৫৮) অন্যতম। যুক্তফ্রন্ট গঠনে প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

শৈশব ও প্রারম্ভিক জীবন
এ. কে. ফজলুক হক ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশাল জেলার রাজাপুর থানার সাতুরিয়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ এবং সাইদুন্নেসা খাতুনের একমাত্র পুত্র।

এ. কে. ফজলুক হকের প্রাথমিক শিক্ষা বাড়িতেই শুরু হয়। পরে তিনি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। গৃহ শিক্ষকদের কাছে তিনি আরবি, ফার্সি এবং বাংলা ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮১ সালে তিনি বরিশাল জিলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৮৮৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে তিনি বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৮৯ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা বিভাগে মুসলমানদের মধ্যে প্রথম স্থান দখল করেন তিনি। তাঁর প্রখর স্মৃতিশক্তির কারণে শিক্ষকদের খুবই স্নেহভাজন ছিলেন। প্রবেশিকা পাশ করার পর উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্যে তিনি কলকাতায় গমন করেন। ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফ.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। সে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন শাস্ত্রের অধ্যাপক ছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। নিজের মেধার বলে তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। এফ.এ. পাশ করার পর তিনি গণিত, রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় অনার্সসহ একই কলেজে বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। ১৮৯৩ সালে তিনি তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ প্রথম শ্রেণীতে বি.এ. পাশ করেন। বি.এ. পাশ করার পর এম.এ. ক্লাসে প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন ইংরেজি ভাষায়। পরীক্ষার মাত্র ছয় মাস আগে তাকে এক বন্ধু ব্যঙ্গ করে বলেছিলেন যে, মুসলমান ছাত্ররা অঙ্ক নিয়ে পড়ে না, কারণ তারা মেধাবী নয়। এই কথা শুনে এ. কে. ফজলুক হকের জিদ চড়ে যায়। তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন যে, অঙ্কশাস্ত্রেই পরীক্ষা দেবেন। এরপর, মাত্র ছয় মাস অঙ্ক পড়েই তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন।

খেলাধুলার প্রতি ফজলুল হক খুবই আগ্রহী ছিলেন। তিনি প্রথম জীবনে নিজে বিভিন্ন খেলাধুলার সাথে জড়িত ছিলেন এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন খেলাধুলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবেও তিনি পরিচিত ছিলেন। তিনি মোহামেডান ফুটবল ক্লাবের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে জড়িত ছিলেন। এছাড়া তিনি দাবা, সাঁতার সহ বিভিন্ন খেলা পছন্দ করতেন।

পরিবার ও পরিজন
এ. কে. ফজলুক হকের পূর্বপুরুষ আঠার শতকে ভারতের ভাগলপুর হতে পুটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার বিলবিলাস গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এ বংশের কাজী মুর্তজা একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। তার পুত্র কাজী মুহম্মদ আমিন। কাজী মুহম্মদ আমিনের পুত্র মুহম্মদ আকরাম আলী বরিশাল কোর্টে আইন ব্যবসা করতেন। তার দুই পুত্র কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ, কাজী আবদুল কাদের ও পাঁচ কন্যা।
কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদের একমাত্র পুত্র ছিলেন এ. কে. ফজলুক হক। কাজী মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৮৪৩ সালে চাখারে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ালেখা করেন। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে তিনি ষষ্ট গ্রাজুয়েট ছিলেন। ১৮৭১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে তিনি বি. এল. পাশ করে আইন ব্যবসা শুরু করেন। মুহম্মদ ওয়াজেদ রাজাপুর থানার সাতুরিয়া মিয়া বাড়ির আহমদ আলী মিয়ার কন্যা বেগম সৈয়দুন্নেছাকে (শেরে বাংলার মা) বিয়ে করেন। মুহম্মদ ওয়াজেদ ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বরিশালে মৃত্যুবরণ করেন।

এ. কে. ফজলুক হক এম.এ. পাশ করার পর দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করেন। এ সময় নবাব আবদুল লতিফ সি. আই. ই.-এর পৌত্রী খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে তার বিয়ে হয়। খুরশিদ তালাত বেগম দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। খুরশিদ তালাত বেগমের অকাল মৃত্যুর পর তিনি হুগলী জেলার অধিবাসী এবং কলকাতা অবস্থানকারী ইবনে আহমদের কন্যা জিনাতুন্নেসা বেগমকে বিয়ে করেন। কিন্তু, জিনাতুন্নেসাও নিঃসন্তান অবস্থায় পরলোক গমন করেন এবং ১৯৪৩ সালে এ. কে. ফজলুক হক মীরাটের এক ভদ্র মহিলাকে পত্নীত্বে বরণ করেন। তাঁদের সন্তান এ. কে. ফাইজুল হক ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পাট প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ২০০৭ সালে মারা যান।

কর্মময় জীবন
১৮৯৭ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এল. পাশ করে স্যার আশুতোষ মুখার্জির শিক্ষানবিশ হিসেবে কলকাতা হাইকোর্টে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন এ. কে. ফজলুক হক। দুবছর শিখানবিশ হিসেবে কাজ করার পর ১৯০০ সালে তিনি সরাসরি আইন ব্যবসা শুরু করেন।
পিতার মৃত্যুর পর ১৯০১ সালে তিনি বরিশালের ফিরে আসেন এবং বরিশাল আদালতে যোগদান করেন। ১৯০৩ – ১৯০৪ সালে বরিশাল বার এসোসিয়েশনের সহকারী সম্পাদক পদে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। এ সময়ই তিনি বরিশাল রাজচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ডক্টর হরেন্দ্রনাথ মুখার্জির অনুরোধে ঐ কলেজে অঙ্কশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯০৬ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে ফজলুল হক সরকারি চাকরি গ্রহণ করেন। পূর্ব-বাংলার গভর্ণর ব্যামফিল্ড ফুলার তাকে ডেকে সম্মানের সাথে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেন। সরকারি চাকুরিতে তিনি কিছুদিন ঢাকা ও ময়মনসিংহে কাজ করেন। এরপর তাকে জামালপুর মহকুমার এস.ডি.ও হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে জামালপুরে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়। ফজলুল হকের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেখানে দাঙ্গা বন্ধ হয়। জামালপুর মহকুমাতে চাকরি করার সময় তিনি জমিদার ও মহাজনের যে নির্মম অত্যাচার নিজের চোখে দেখেন, পরবর্তী জীবনে এর প্রতিকার করতে গিয়ে সে অভিজ্ঞতা হয়, তা তার জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। ১৯০৮ সালে এস.ডি.ও –এর পদ ছেড়ে দিয়ে তিনি সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার পদ গ্রহণ করেন। এসময় তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থা নিজের চোখে পর্যবেক্ষণ করেন। সরকারের সাথে বনাবনি না হওয়ায় অল্পদিনের মধ্যেই তিনি চাকুরি ছেড়ে দিলেন। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৯১১ সালে এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা হাইকোর্টে যোগ দেন। কলকাতায় তাকে সেদিন নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সংবর্ধনা সভার সভাপতিত্ব করেন নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহ।

সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির সংগ্রামে
শিল্প সাহিত্যের সাথে এ. কে. ফজলুক হকের সান্নিধ্য ঘটে বরিশালে। কিশোর কিশোরীদের জন্য এ সময় তিনি নিজের সম্পাদনায় “বালক” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি “ভারত সুহৃদ” নামে যুগ্ম সম্পাদনায় আরো একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এসময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত নবযুগ নামক পত্রিকার সম্পাদল ছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রখ্যাত কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ কমরেড মুজাফফর আহমদের প্রস্তাবে এ. কে. ফজলুক হক নবযুগের প্রকাশনাতে সাহায্য করতে সমর্থ হন। নজরুলের আগুন ঝরানো লেখার কারণে “নবযুগ” হু হু করে বিক্রি হতে লাগলো। কলকাতা হাইকোর্টের ইংরেজ বিচারপতি টিউনন ফজলুল হক সাহেবকে নিজের খাস কামরায় ডেকে নিয়ে বৃটিশ সরকার বিরোধী লেখার জন্য হুশিয়ার করে দেন। কিন্তু ফজলুল হক ভয় না পেয়ে টিউননের কাছ থেকে ফিরেই নজরুলকে খবর দিয়ে বলেন, “আরো গরম লিখে যাও, ইংরেজ সাহেবদের টনক নাড়িয়ে দাও”। নজরুলের লেখা চলতে থাকলে একসময় বৃটিশ সরকার “নবযুগ” পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করে এবং কাগজটি বন্ধ করে দেয়। হক সাহেবের চেষ্টায় আবার নবযুগ চালু হলেও, তিক্ত বিরক্ত নজরুল নবযুগের কাজ ছেড়ে দেন।

ব্রিটিশ আমলে সংগ্রামী রাজনীতি
বরিশাল পৌরসভা নির্বাচন
বরিশাল পৌরসভার চেয়ারম্যান অশ্বিনীকুমার দত্ত এ. কে. ফজলুক হককে কমিশনার পদে প্রার্থী হবার আহবান জানান। এ. কে. ফজলুক হক পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করেন এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে সদস্য নির্বাচিত হন। এর মাধ্যমেই এ. কে. ফজলুক হকের রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের সূত্রপাত।

বঙ্গীয় আইন পরিষদ
১৯১৩ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে এ. কে. ফজলুক হক বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৫ সালে পুনরায় ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৩ থেকে ১৯১৬ সার পর্যন্ত তিনি এ পরিষদের সভায় মোট ১৪৮ বার বক্তৃতা করেন। ১৪৮ বার বক্তৃতার ভেতর ১২৮ বার তিনি দাড়িয়ে ছিলেন মুসলমানদের শিক্ষা সম্পর্কে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। তার অদম্য চেষ্টার ফলে ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কারমাইকেল ও টেইলার হোস্টেল স্থাপন করা হয়েছিল। তৎকালীন শিক্ষা বিভাগের ডি.পি.আই কর্ণেল সাহেব তখন ফজলুল হকের শিক্ষা বিষয়ক উদ্যোগের প্রশংসা করে তাকে বাংলার “বেন্থাম” হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

নিখিল ভারত মুসলিম লীগ
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ নিয়ে বাংলার জনগণ বিভক্ত হয়ে পড়লে, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ উপলব্ধি করেন মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি সংগঠন দরকার। এই চিন্তা থেকেই ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্স আহবান করেন। এই সম্মেলনে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সভাপতি ছিলেন নবাব সলিমুল্লাহ নিজে এবং যুগ্ম সচিব হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন নবাব ভিকারুল মুলক এবং আবুল কাশেম ফজলুল হক। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার আহসান মঞ্জিল-এ। এই কনফারেন্সে নবাব সলিমুল্লাহ নিখিল ভারত মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব পেশ করেন ও সেই প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। অবশেষে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের সূত্রপাত ঘটে। ১৯১২ সালে এ. কে. ফজলুক হক মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু এই সংগঠনের সাথে সাংগঠনিক নানা বিষয়ে তার বিরোধ বাধে। ১৯১৪ সালের ঢাকার আহসান-উল্লাহ-ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল বর্তমানে বুয়েট প্রাঙ্গণে মুসলিম লীগের প্রাদেশিক বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৮ সালে দিল্লীতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলনে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাঙালিদের মধ্যে তিনিই একমাত্র নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯১৯ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

নিখিল ভারত কংগ্রেস
১৯১৪ সালে ফজলুল হক নিখিল ভারত কংগ্রেস দলে যোগ দেন। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস দলের নেতা হয়ে উঠেন। ১৯১৮ তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন।

খেলাফত আন্দোলন
এ. কে. ফজলুক হক খেলাফত আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর খেলাফত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এ. কে. ফজলুক হক নিখিল ভারত খেলাফত কমিটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বাংলার শিক্ষামন্ত্রী এ. কে. ফজলুক হক
১৯২২ সালে মহাত্মা গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিলে এ. কে. ফজলুক হক খুলনা উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা করে নির্বাচিত হন। ১৯২৪ সালে খুলনা অঞ্চল থকে তিনি পুনরায় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং এ সময় বাংলার গভর্ণর ছিলেন লিটন, তিনি ফজলুল হককে বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ও মতিলাল নেহেরু-এর নেতৃত্বে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল স্বরাজ্যদল। এই দলের অন্যতম কর্মসূচি ছিল আইনসভায় নির্বাচিত হয়ে সরকারি নীতির বিরোধীতা সহ সরকারি বাজেট বা আয়-ব্যয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা। স্বরাজ্য পার্টি ১৯২৪ সালের বাজেটের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেন তিনি। এ সময় ১৯২৪ সালের ১ আগস্ট এ. কে. ফজলুক হক মন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তাফা দেন।

র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের গোলটেবিল বৈঠক
ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নির্ধারণের লক্ষ্যে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার র‌্যামজে ম্যাকডোনাল্ড (James Ramsay MacDonald) একটি গোলটেবিল বৈঠক আহবান করেন। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধী এই বৈঠক প্রত্যাখান করেন। কিন্তু, মুসলিম লীগ সেই বৈঠকে অংশগ্রহণ করে। ১৯৩০ – ১৯৩১ সালের প্রথম গোলটেবিল বৈঠকে ফজলুল হক বাংলা এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের জন্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব দাবি করেছিলনে। তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচনের পক্ষে বক্তৃতা দেন। ১৯৩১- ১৯৩২ সালে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে কংগ্রেসও যোগ দেয়। এ বৈঠকেও সাম্প্রদায়িক প্রশ্নের সমাধান না হওয়ায় ভারতের শাসনতন্ত্র রচনার দায়িত্ব চলে যায় বৃটিশের হাতে।

কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন
১৯৩৫ সালে এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। তিনিই কলকাতা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র।

কৃষকদের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি
১৯২৪ সালে শিক্ষামন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেয়ার পর থেকে আবুল কাশেম ফজলুল হক সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েছিলেন কৃষকদের রাজনীতি নিয়ে। ১৯২৯ সালের ৪ জুলাই বঙ্গীয় আইন পরিষদের ২৫ জন মুসলিম সদস্য কলকাতায় একটি সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এই সম্মেলনে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি দল গঠনের সিধান্ত হয়। বাংলার কৃষকদের উন্নতি সাধনই ছিল এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯২৯ সালেই নিখিল বঙ্গ প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। ঢাকায় প্রজা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৪ সালে। এই সম্মেলনে এ. কে. ফজলুক হক সর্বসম্মতিক্রমে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। ময়মনসিংহে বঙ্গীয় প্রজা সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিতসঙ্গীত এবং মরমী শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের গানের মধ্যে দিয়ে এ সম্মেলন শুরু হয়েছিল। এই প্রজা সমিতির মধ্য দিয়েই পরবর্তিতে কৃষক-প্রজা পার্টির সূত্রপাত ঘটে।

১৯৩৭ –এর নির্বাচন
১৯৩৭ সালের মার্চে বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির পক্ষ থেকে পটুয়াখালী নির্বাচনী এলাকা থেকে এ. কে. ফজলুক হক ও মুসলিম লীগের মনোনীত পটুয়াখালীর জমিদার ও ঢাকার নবাব পরিবারের সদস্য খাজা নাজিমুদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। মুসলিম লীগ প্রার্থী খাজা নাজিমুদ্দিনের নির্বাচনী প্রতীক ছিল “হারিকেন” আর হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টির প্রতীক ছিল “লাঙ্গল”। কৃষক প্রজা পার্টির শ্লোগান ছিল, “লাঙল যার জমি তার, ঘাম যার দাম তার”। পটুয়াখালীতে এ. কে. ফজলুক হক ১৩,০০০ ভোটে পেয়েছিলেন। অপরদিকে, খাজা নাজিমুদ্দিন ৫,০০০ হাজার ভোট পেয়ে ৭,০০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এই নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টি ৩৯টি আসন ও মুসলীম লীগ ৩৮টি আসন লাভ করে। নির্বাচনে মুসলিম লীগের সথে সমঝোতায় গিয়ে এ. কে. ফজলুক হক ১১ সদস্য বিশিষ্ট যুক্ত মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। মন্ত্রীদের মধ্যে তিনজন কৃষক প্রজা পার্টির, তিন জন মুসলিম লীগের, তিন জন বর্ণ হিন্দুর এবং দুই জন তফসিলী সম্প্রদায়ের সদস্য ছিলেন
১৯৩৭ সালের ১ এপ্রিল এ. কে. ফজলুক হকে নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী পরিষদ গভর্ণর এন্ডারসনের কাছে শপথ গ্রহণ করেন। আইন পরিষদের স্পিকার ছিলেন স্যার আজিজুল হক ও ডেপুটি স্পিকার হলেন জালালউদ্দিন হাশমী। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

বাংলার প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ. কে. ফজলুক হক বহু কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। শিক্ষা ক্ষেত্রেই জোড় দিয়েছিলেন বেশি। তার আমলে দরিদ্র কৃষকের উপরে কর ধার্য না করে সারা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করা হয়। “বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ”-এর পদক্ষেপ তিনি গ্রহণ করেন। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য বৃটিশ সরকার ১৯৩৮ সালে “ক্লাউড কমিশন” গঠন করে। ১৯৩৮ সালের ১৮ আগস্ট বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধনী পাস হয় এবং জমিদারদের লাগামহীন অত্যাচার চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়। ১৯৩৯ সালের “বঙ্গীয় চাকুরি নিয়োগবিধি” প্রবর্তন করে মন্ত্রী পরিষদ মুসলমানদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ চাকুরি নির্দিষ্ট রাখার ব্যবস্থা করে। এ বছরেই “চাষী খাতক আইন”-এর সংশোধনী এনে ঋণ সালিশী বোর্ডকে শক্তিশালী করা হয়। ক্লাউড কমিশনের সুপারিশ অনুসারে ১৯৪০ সালে হক সাহেব আইন পরিষদে “মহাজনী আইন” পাস করান। এ বছরই “দোকান কর্মচারি আইন” প্রণয়ন করে তিনি দোকান শ্রমিকদের সপ্তাহে একদিন বন্ধ ও অন্যান্য সুবিধা প্রদানের নির্দেশ জারী করেন। কৃষি আধুনিকায়নের জন্য ঢাকা, রাজশাহী এবং খুলনার দৌলতপুরে কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। পাট চাষীদের ন্যায্য মূল্য পাওয়ার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে “পাট অধ্যাদেশ” জারী করা হয়। ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর আবুল কাশেম ফজলুল হক দ্বিতীয়বারের মত মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। শরৎচন্দ্র বসু ও হিন্দু মহাসভার সহ-সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সঙ্গে প্রগতিশীল যুক্ত পার্টি গঠন করে তিনি সেই দলের নেতা হয়েছিলেন। ১৭ ডিসেম্বর এই মন্ত্রী পরিষদ বাংলার গভর্ণর জেনারেল হার্বাটের কাছে শপথ গ্রহণ করেন।

লাহোর প্রস্তাব

১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলীম লীগের অধিবেশনে সভাপতি ছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের উপস্থাপক ছিলেন এ. কে. ফজলুক হক। এই লাহোর প্রস্তাবই “পাকিস্তান প্রস্তাব” হিসেবে পরবর্তীকালে আখ্যায়িত হয়।

মুসলিম লীগে যোগদান
১৯৪৬ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গীয় আইন পরিষদের নির্বাচনে বরিশাল অঞ্চল ও খুলনার বাগেরহাট অঞ্চল থেকে প্রার্থী হয়ে তিনি নির্বাচিত হন। কিন্তু, দলীয়ভাবে পরাজিত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রীসভা গঠন করেন ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই নির্বাচনের পর দলীয় নেতাকর্মীদের চাপে হক সাহেব মুসলিম লীগে যোগ দেন। কিন্তু দলের সদস্য হিসেবে তিনি ছিলেন নীরব।

পাকিস্তান আমলে রাজনীতি
পাকিস্তান গঠিত হবার পর থেকে হক সাহেব ঢাকা হাইকোর্টে পুনরায় আইন ব্যবসা শুরু করেছিলেন। তিনি ঢাকা হাইকোর্ট বারের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৫১ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে এ. কে. ফজলুক হক সমর্থন দেন।

কৃষক শ্রমিক পার্টি গঠন
১৯৫৩ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনের সময় তার বাস ভবনে কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে দলের নাম থেকে প্রজা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কৃষক শ্রমিক পার্টি’ গঠন করা হয়। আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সাধারণ সম্পাদক করে এই পার্টির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এ. কে. ফজলুক হক।

যুক্তফ্রন্ট গঠন
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর এ. কে. ফজলুক হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে নিয়ে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করার জন্য এ সময়ে সাপ্তাহিক ‘ইত্তেফাক’কে দৈনিক পত্রিকায় রুপান্তর করা হয়। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠা সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ৯টি আসন লাভ করে। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল এ. কে. ফজলুক হক চার সদস্য বিশিষ্ট মন্ত্রীসভা গঠন করেন। পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পরিষদ গঠন করা হয় ১৫ মে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এ. কে. ফজলুক হক
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল। যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী পরিষদ এই ২১ দফা বাস্তবায়নের জন্য তৎপর হন।

২১ দফয় গৃহীত উল্লেখ্যযোগ্য কর্মসূচিগুলো হল:
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ।
২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা।
ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতিতে ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা গবেষণা কেন্দ্র বা বাংলা একাডেমি ঘোষণা করা।
জমিদারি ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদের ব্যবস্থা নেওয়া।
এ সময় এ. কে. ফজলুক হক কলকাতা সফরে যান। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী পরিষদ বাতিল করে দিয়ে ৯২ (ক) ধারা জারীর মাধ্যমে প্রদেশে গভর্ণরের শাসন প্রবর্তন করেন।

১৯৫৫-এর নির্বাচন
১৯৫৫ এর ৫ জুন সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পুনরায় গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। মুসলিম লীগের চৌধুরী মোহাম্মদ আলী কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন। এ. কে. ফজলুক হক ছিলেন এই সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন বিরোধী দলের নেতা।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর
১৯৫৬ এর ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র গৃহীত ও ২৩ মার্চ তা কার্যকরী হয়। এ সময় এ. কে. ফজলুক হক পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করে ৮৩ বছর বয়সে করাচি থেকে ঢাকা এসে ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার তাকে গভর্ণরের পদ থেকে অপসারণ করে। এরপরই তিনি তার ৪৬ বছরের বৈচিত্রময় রাজনৈতিক জীবন থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন।

অবসরে এ. কে. ফজলুক হক
১৯৫৮ এর ২৭ অক্টোবর আবুল কাশেম ফজলুল হককে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক “হেলাল-ই-পাকিস্তান” খেতাব দেওয়া হয়। ১৯৬১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দ তাকে সংবর্ধনা প্রদান করে এবং তাকে হলের আজীবন সদস্য পদ প্রদান করা হয়। এই সংবর্ধনা সভার পর তিনি আর কোন জনসভায় যোগদান করেননি। ১৯৬২ এর ২৭ মার্চ তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। তিনি প্রায় একমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন।

মৃত্যু

সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে অবস্থিত তিন নেতার মাজারে শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হকের কবর
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০ টা ২০ মিনিটে এ. কে. ফজলুক হক ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যু বরণ করেন। ২৮ এপ্রিল সকাল সাড়ে দশটা পর্যন্ত তার মরদেহ ঢাকার টিকাটুলি এলাকায় তার ২৭ কে. এম. দাস লেনের বাসায় রাখা হয়। সেদিন সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে ঢাকার পল্টন ময়দানে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় তাকে সমাহিত করা হয়। একইস্থানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমুদ্দিনের কবর রয়েছে। তাদের তিনজনের সমাধিস্থলই ঐতিহাসিক তিন নেতার মাজার নামে খ্যাত। রেডিও পাকিস্তান সেদিন সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে সারাদিন কোরআন পাঠ করে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রেখে তার প্রতি সম্মান দেখানো হয়। ৩০ এপ্রিল সোমবার পাকিস্তানের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্কুল কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

সম্মাননা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি আবাসিক হলের নামকরণ করা হয়েছে।[১৬] রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল জিন্নাহ হলের নাম পরিবর্তন করে তার নামে করা হয়ে। কুয়েটে তার নামে একটি ছাত্র আবাসিক হল (ফজলুল হক হল) আছে। বুয়েটেও তার নামে একটি আবাসিক হলের (শেরে বাংলা হল) নামকরণ করা হয়েছে।[১৭] বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলের নামকরণ করা হয়েছে। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে একটি ছাত্র আবাসিক হল রয়েছে।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার নামে একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,[১৮] যা ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তৎকালীন পাক-ভারত উপমহাদেশে প্রথম কৃষিশিক্ষাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ছিল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নিজেই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এছাড়া এই শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার নামে একটি হলও রয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় তার নামে একটি এলাকার নামকরন করা হয়েছে শের-এ-বাংলা নগর (পূর্ববর্তী আইয়ুবনগর ও তারও পূর্বে মনিপুর), যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অবস্থিত।

তার নামে ঢাকায় একটি ক্রিকেট স্টেডিয়াম রয়েছে শের-ই-বাংলা ক্রিকেট স্টেডিয়াম, মিরপুর, ঢাকা। যা বাংলাদেশের হোম অব ক্রিকেট হিসেবে খ্যাত। বরিশালে তার নামে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের নামকরণ করা হয়েছে। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দক্ষিণবঙ্গের ৫ চিকিৎসা-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল।
পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই প্রাতঃস্মরণীয় কিংবদন্তী ও কীর্তিমান এই রাজনীতিবিদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।