Home সাহিত্য ও বিনোদন অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব সংগীত কেন্দ্র ঢাকা শাখার সম্মেলন ও গুণীজন সম্মাননা

অনুষ্ঠিত হলো বিশ্ব সংগীত কেন্দ্র ঢাকা শাখার সম্মেলন ও গুণীজন সম্মাননা

36

জাকির হোসেন আজাদী: ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৫:৩০টায় জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক সংস্কৃতিক সংগঠন বিশ্ব সংগীত কেন্দ্র ঢাকা শাখার সম্মেলন, গুণীজন সম্মাননা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ব‍্যাপক উৎসব মুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের লক্ষ্যে সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা সংগীতপ্রেমীদের মধ্যে একটা সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন তৈরিতে ২০১২ সাল থেকে নিরবিচ্ছিন্নভান কাজ করে যাচ্ছে ‘বিশ্ব সংগীত কেন্দ্ৰ’ নামের সংগঠনটি।
বিশ্ব সংগীত কেন্দ্ৰের আন্তর্জাতিক মঞ্চের কার্যক্রমকে আরো বেগবান করতে ঢাকা শাখার উদ্যোগে প্রথম এই সম্মেলন ‘অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন হাসানুজ্জামান কল্লোল, সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। বিশেষ অতিথি হিসেবে তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য প্রদান করেন মোঃ কামরুজ্জামান, মহাপরিচালক, জাতীয় যাদুঘর। স্বাগত বক্তব্য পেশ করেন জাকারিয়া কাজী, প্রতিষ্ঠাতা ও বৈশ্বিক সমন্বয়ক, বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্র। এবং সংগঠনের সামগ্রিক বিষয়ে বক্তব্য তুলে ধরেন তিমির নন্দী প্রধান সমন্বয়ক বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্র, ঢাকা শাখা।
সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন- কবি নির্মলেন্দু গুণ, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা সুজেয় শ্যাম, শাহীন সামাদ, বুলবুল মহলানবীশ এবং তিমির নন্দী, বীর মুক্তিযোদ্ধা কন্ঠশিল্পী লীনু বিল্লাহ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মহাদেব ঘোষ।

সম্মাননা প্রাপ্তদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় :

১. কবি নির্মলেন্দু গুণ:
বাংলা সাহিত্যে কাব্য ভুবনের অনন্য এক কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য
এবং ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন ছবিও এঁকেছেন। ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থের ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তী সময়ে এর অন্তর্ভুত ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা ভুলিয়া কবিতাটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও তার, স্বাধীনতা, উপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তাকে ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

২. সুজেয় শ‍্যাম:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা সুজেয় শ্যাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ
গান এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর প্রথম গানের সুর করেন সুজেয় শ্যাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গীতিকার শহীদুল আমিনের লেখা ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ গানের সুর ও সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। গানটির প্রধান কণ্ঠশিল্পী ছিলেন অজিত রায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সুজেয় শ্যামের অন্য গানগুলোর মধ্যে আছে ‘রক্ত দিয়ে নাম লিখেছি’, ‘রক্ত চাই রক্ত চাই’, ‘আহা ধন্য আমার
জন্মভূমি’, ‘আয়রে চাষি মজুর কুলি’, ‘মুক্তির একই পথ সংগ্ৰাম’ ও ‘শোন রে তোরা সোনা। তিনি ২০১৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক, ২০১৮ সালে
একুশে পদক ভূষিত হন।

৩. লীনু বিল্লাহ:
সঙ্গীতে হাতেখড়ি ১৯৬৪ সাল থেকে। আধুনিক, দেশাত্মবোধক, লোক সঙ্গীতের গানে তার পারফর্ম
চোখে পড়ার মত। গানের সাথে সাথে তিনি ভালো তবলাও বাজান এবং ৭১এর সংগ্রামী যোদ্ধাও তার একটি বড় পরিচয়। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথম স্টেজ শো’করেন। হিটস অব লীনু বিল্লাহ সহ এ পর্যন্ত তার
৭টি এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে।

৪.শাহীন সামাদ:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহীন সামাদের জন্ম কুষ্টিয়ায়। খান আতাউর রহমানের কথা ও সুর সঙ্গীতে
সিরাজউদ্দৌলা’ ‘নবাব চলচ্চিত্রের টাইটেল সং- এ কন্ঠ দিয়েছেন তিনি। শাহীন সামাদের দশটি নজরুল সঙ্গীতের অ্যালবাম রয়েছে। ওস্তাদ রামগোপালের কাছে তিনি প্রথম উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নেন। এরপর তিনি ওস্তাদ ফজলুল হক মিয়া, ওস্তাদ ফুল
মোহাম্মদ, সুধীন দাশ এবংং সানজিদা খাতুনের কাছে তালিম নেন। তার উল্লেখযোগ্য দেশাত্মবোধক গান হল “তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর”, “মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”, “রক্তের প্রতিশোধ রক্তেই নেব আমরা”। ২০১৬ সালে ‘একুশে পদক’-এ ভূষিত হন। ২০০৯ সালে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এবং ২০১৪ সালে নজরুল
ইন্সটিটিউট থেকে সম্মাননা লাভ করেন।

৫. বুলবুল মহলানবীশ:
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশ নজরুল সংগীত শিল্পী পরিষদের সহসভাপতি, সাধারণ রবীন্দ্র সম্পাদক একাডেমি। প্রকাশিত হয়েছে ১২টির বেশি গ্রন্থ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব
প্রস্তুতি ও স্মৃতি ৭১ তার বহুল আলোচিত বই। সাহিত্য- সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য পেয়েছেন- চয়ন স্বর্ণপদক, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ফাউন্ডেশন সম্মাননা, পশ্চিমবঙ্গের নজরুল একাডেমি সম্মাননা পদক। ১৯৯০ সালে বারীণ মজুমদার পরিচালিত ‘মনিহার সংগীত একাডেমী থেকে ডিস্টিংশনসহ প্রথম হয়ে বিশ্ববরেণ্য বেহালা-শিল্পী পণ্ডিত ভি.জি. যোগের হাত থেকে নিয়েছেন সনদপত্র এবং পেয়েছেন সংগীত মণি’ উপাধি। বর্তমানে তিনি মাসিক অরিত্র’র নির্বাহী সম্পাদক।

৬. তিমির নন্দী :
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা তিমির নন্দী একাধারে সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার,
সঙ্গীত পরিচালক। সম্প্রতি সংগীত জীবনের ৫০ বছর পার করেছেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। ১৯৭২ সালে বন্ধুদের নিয়ে ‘রজনী’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন। প্রথম সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন বিটিভির ধারাবাহিক নাটক ‘শংকিত পদযাত্রা’য়। এই নাটকে ড. আব্দুল মতিনের
কথায় ‘বাঁধন খুলে দিলাম’ তার গাওয়া এবং সুর করা, যা সেই সময়ে ভীষণ শ্রোতাপ্রিয়তা পায়।

৭. মহাদেব ঘোষ:
বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন বিশেষ গ্রেডভুক্ত শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক মহাদেব ঘোষ। রবীন্দ্রসংগীত সংগঠন রবিরশ্মির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে এর পরিচালক তিনি। বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থায় দায়িত্ব পালন করেছেন যুগ্ম সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে। বর্তমানে তিনি বুলবুল ললিত কলা একাডেমির (বাপা) উপাধ্যক্ষ ও রবীন্দ্রসংগীত
বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক। দেশের বেতার-টিভি-মঞ্চের পাশাপাশি আমন্ত্রিত হয়ে সংগীত পরিবেশন করেছেন ভারত, কুয়েত ও অস্ট্রেলিয়ায়।

বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্রের পরিচিতি:
প্রতিকূল আর্থসামাজিক কারণে আমাদের দেশের অনেক গুণী শিল্পী সাহিত্যিককেই প্রবাস জীবন বেছে নিতে হয়। প্রতিভাবান গুণী ব্যক্তিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিশ্বের নানা কোণে। এ প্রেক্ষিতে প্রবাসে দেশীয় শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশের লক্ষ্যে বাংলা গানের বিশাল রত্নভাণ্ডারকে সামনে রেখে নিয়মিতভাবে বিষয় ভিত্তিক সঙ্গীতানুষ্ঠান আয়োজন
করে চলেছে বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্র। গীতিময় এ কর্মকাণ্ড রোম থেকে শুরু হলেও পর্যায়ক্রমে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত ও বাংলাদেশ তথা বিশ্বের সকল বাঙ্গালি অধ্যুষিত শহরগুলোতে বিশ্ব সঙ্গীত কেন্দ্রের শাখা গঠনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক
সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য:
বিষয় ভিত্তিক নিয়মিত/অনিয়মিত শ্রোতার আসরের আয়োজন করা । ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনলাইন ভিত্তিক অনুষ্ঠান ও মতবিনিময়ের ব্যবস্থা করা। আন্তদেশীয় সাংস্কৃতিক সফরের আয়োজন করা। আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে
বার্ষিক/দ্বিবার্ষিক সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করা।
অনুষ্ঠানের তথ্যাদি সংগঠনের নিজস্ব ওয়েব সাইট, ইউটিউব, ফেসবুক ইত্যাদি মাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা। সংগঠনের মুখপত্র হিসেবে একটি সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা, নিজস্ব ওয়েব সাইট, ওয়েব রেডিও এবং সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে এফ এম রেডিও প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল শিল্পীদের অসুস্থতায় সহায়তার জন্য তহবিল গঠন। প্রতিভাবান শিল্পীদের জন্য একক অথবা সম্মিলিতভাবে অডিও, ভিডিও
এ্যালবাম প্রকাশের ব্যবস্থা করা। আমাদের অনবদ্য কাব্য, সাহিত্য এবং সঙ্গীতগুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদের উদ্যোগ নেয়া এবং বহুজাতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। প্রবাসে বেড়ে উঠা আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য স্থানীয়ভাবে ললিত কলা একাডেমী স্থাপনের মাধমে ভাষা, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীতের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।