Home সাহিত্য ও বিনোদন অনুগল্প: গল্পের নাম ফিরে আসা

অনুগল্প: গল্পের নাম ফিরে আসা

50

পলাশ কলি হোসেন শোভা: আরে থাম থাম ওদিকে যাবি না কইলাম সাপ আছে সাজু…. এই পথ দিয়ে হাটতে গিয়ে বড় বোনের পেছন থেকে ডাকাডাকি এখনো শুনতে পায় সে। পিঠাপিঠি বোন জেবুন। তাই নাম ধরেই ডাকে। সাত বছর পর বাড়ি যাচ্ছে। এতবছর বাড়িতে একবারের জন্য ও আসেনি সাজু।
অসম্ভব রকমের দুষ্টামি তে ভরা ছিলো সে জীবন। এর ওর বাড়ির গাছের ফল ফালাদি চুরি করা মাঝরাতে বিলে মাছ ধরতে যাওয়া চই নিয়ে, এগুলো নিত্যদিনের কাজ। বাড়ি থেকে কিছু দুরেই রোললাইন।কত রাত সেখানে বন্ধু দের সাথে আড্ডা আর ভুতের জন্য অপেক্ষা । আপন মনে হেটে যাচ্ছে সাজু। বাড়ির সবাই অবাক হয়ে যাবে। কেন বাড়ি ছেড়েছিলো তা বোধকরি তেমন কেউই জানেনা

কে ওই, কে যায়?
আমি, আমি সাজু
কোন সাজু?
ধলু মিয়ার পোলা
ততক্ষণে দুজনেই মুখোমুখি ।
এত বছর পর! তোমারে তো চিনেন যায় না।
বাড়ির সবাই কেমন আছে কাকা?
যাও, বালাই আছে।
সাজু আবারও হাটতে থাকে। রাত নামছে গ্রামের বুকে। এই কলিম কাকাকে কত বার ভয় দেখিয়েছে। মৌচাক বিশাল বট গাছের কোঠরে চাক বেধেছিলো। সাজু কাকাকে বলে, তার ছোট বল ঢুকে গেছে আনতে পারছে না। কাকা বল আনার জন্য হাত ঢুকাতেই মৌমাছিরা কাকাকে কামড়াতে থাকে। ওমাগো বাবাকে বলে কাকা ততক্ষণে পুকুরে।
দাড়া তোরে পাইয়া লই দেহিস কি করি।

চার পাশের বাড়ি গুলো সব নীরব। মনে হয় কেউ কোথাও নেই। সাজু ডানদিকের বাড়িতে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো, এটাই তো যতীন মাস্টারের বাড়ি। এখনও সেই আগের জরাজীর্ণ অবস্হা । ফিক করে হেসে ফেলে সে।
মজার কথা মনে পড়ে গেলো।
সেই ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় যতীন স্যার ডেকে কুড়িটা টাকা দিয়ে বললো,
যা এক প্যাকেট স্টার নিয়ে আয়
টাকাটা হাতে নিয়ে সদু রে নিয়ে দে দৌড়।
দোকান থেকে নাসির গোল্ড সস্তায় কিনে। একটা খালি স্টারের প্যাকেটে ঢুকিয়ে স্যার কে দিলো। বাকি টাকায় লাঠি লেবুনচুষ আর বাতাসা সন্দেশ কিনে খায়।
ধরা হয়তো পরতো না কাশেম স্যার এসে বলে,
যতীন সিগারেট আছে?
আছে বলে প্যকেট এগিয়ে দেয়।
সিগারেট ধরিয়ে এক টান দিয়েই কি এটা? দেখেই বলে,
তুমি নাসির গোল্ড খাও কবে থেকে? তোমার এই অবস্থা কেন?

কি বললা? ওওও ওই হারামজাদার কাজ। একটার প্যাকেটে আরেকটা? সারা স্কুল খুজে ধরে আনা হলো হেড স্যার পর্যন্ত গড়ায়ছে। হেড স্যারের বেতের বাড়ি একটাও মাটিতে পড়েনি।
স্যার আমাদের দিয়ে বিড়ি আনায় কেন?
এই কথাতেই আইন হয়ে গেলো, কোন ছাএ কে দিয়ে কোন কিছুই আনা চলবে না।
দূরে পুকুরে চোখ পড়তেই সাজু অবাক হয়! বিশাল পদ্ম পুকুর এখনো পানিতে টলমল করছে।
পুকুর পাড়ে গিয়ে দাড়ায়। অন্ধকারে দু একটা পদ্ম দেখা যাচ্ছে।

সাত বছর আগে দিনের বেলা কত গুলো মেয়ে পুকুরে নেমে পদ্ম তুলছিলো। সাজু ততদিনে কলেজে পড়ছে। দুরন্তপনা তখনও কমেনি। পুকুর পাড়ের উপর নারিকেল গাছে উঠেছে মাএ। মেয়েদের কলকাকলীতে নিচের দিকে তাকাতেই দেখে এক দল মেয়ে। সাজু ভুলে যায় ডাব পারার কথা। মেয়েদের কান্ড দেখতেই ব্যস্ত। হঠাৎ চিৎকার আখিরে তোল তোল। কিন্তু কেউ তুলছে না। মেয়েটা হাবুডুবু খেতে খেতে তলিয়ে যাচ্ছে। সাজু যখন বুঝলো মেয়েটি সাঁতার জানে না। অত উঁচু থেকে পুকুরে ঝাপ দিয়ে মেয়েটিকে তুলে আনে। ততক্ষণে আশে পাশের অনেক লোক এসে হাজির। সাজুর বাবা ধলু মিয়া মনে মনে জীবনে প্রথম বললো,
ভাগ্যিস তুই গাছে আছিলি, নাইলে মেয়েটা তো ডুইবা যাইতো।

সাজুদের ঘরে নিয়ে বসায়। এ আগেই সাজু বুকে চাপ দিয়ে পেট থেকে পানি বের করে ফেলে। সাজুর মা গরম দুধ এনে বলে,
খাও মা। তুমি কোন বাড়ির মাইয়া?বাবার নাম কি?
আমি শিকদার বাড়ির মেয়ে। বাবার নাম শাহজাহান শিকদার।
বলো কি? তুমি চেয়ারম্যানের মেয়ে তোমগো বাড়িতো ম্যালা দূর। এখানে কি বুইঝা আইসো?
সবাই উৎসুক হয়ে দেখছে। বান্ধবী রা চলে যেতে চাইছে।
ধলু মিয়া বললো,
মায়েরা চিন্তা কইরো না আমি নিয়া যামু
এহানে কেন….আমরা পদ্মপুকুর দেখতে আসছিলাম। আখি ফুল তুলতে গিয়া পিছলায় গেছে।
একটা দীর্ঘ শ্বাস বের হয় সাজুর।
এই আখির সাথেই অতটুকুন বয়সে প্রেম হয়ে যায়। রাত দুপুরে রেললাইন ধরে মাইল খানেকের বেশি হেটে যেতো আখিকে এক নজর দেখার জন্য । জানালার কাছে গিয়ে রাতের ডাহুকের ডাক দিলেই জানালা খুলে দিতো আখি।দু মিনিট কথা বলে চলে আসার সময় ওর জন্য নেয়া কিছু না কিছু দিয়েই আসতো গান গাইতে গাইতে। অনেকেই এই গান শুনতো। পরদিন হয়তো সাজু কে দেখলেই বলতো,
ঐ পাগলা রাত – দুপুরে এত ঘোরাঘুরি করস কেন? গানের গলাতো চমত্কার।
সাজু হাসে কিছু বলে না।

এভাবেই যখন ওরা প্রেম করছিলো। এক রাতে চেয়ারম্যান শালিশ শেষ করে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে কে একজন মেয়ের জানালার কাছে।
কেডা রে খাড়া, খাড়া কইতাছি।
উঠে পড়ে সে কি দৌড়।
পোলাড়া কেডারে জয়নাল?
ধলুমিয়ার পোলা সাজু।
ওওও,কালকেই ধইরা আনবি।
বলেই চেয়ারম্যান ঘরের দিকে যায়।

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছিলো সাজুর সে ভেবেছিলো ওকে হয়তো চিনতে পারেনি। কিন্তু আখি যদি সব বলে দেয়।সাজুর বিশ্বাস ছিলো আখি কিছুই বলবোনা। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তার বাড়ে অস্হিরতা
মা ভাবে কি হলো সাজুর? পোলাডা এত চুপ কেন?
কিরে বাজান শইল খারাপ?
নাহ মা এমনি বইয়া রইছি।
ঠিক এমন সময় তিনজন লোক উঠানে এসে ডাকে,
ধলু কাহা বাড়িত আছো?
কেপে উঠে সাজু। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নেয়।
কে? সাজু সামনে গিয়ে দাড়ায় পেছনে বাবা
কাহা চলেন, চেরমেন সালাম দিসে।
কও কি
হ লগে আপনার পোলারে লইয়া চলেন।
পোলা কি কুনো দোষ করছে?
গেলেই বুঝবেন।
ততক্ষণে মা বোন এসে দাড়ালো
বাবা ছেলে বের হয়ে যায়।।

চেয়ারম্যান এর কাচারি ঘরে আরো অনেক লোক বসা। ধলুমিয়া ভয় পেয়ে যায়, কিসের বিচার? কার বিচার? সাজুরে কেন ডাকছে?
সেই মজলিশে সাজুর বিচার হয়ে ছিলো তার মেয়ের সাথে প্রেম করাতে। অথচ আখির কোন বিচার হয়নি প্রেম আখিও করেছিলো। বিচারের রায়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিলো সাজুর। দু বছর আগে চেয়ারম্যান মারা গেলেও এক গোপন অভিমানে সে এতদিন বাড়ি আসে নি।

আজ না এসে পারলো না। শহরে থেকে লেখাপড়া শেষ করে ভালো চাকরি করছে। কদিন ধরে মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে, তাই বাড়ি আসা।
এই বাড়ি। তার জানালার পাশে রঙন ছিলো আছে কি?অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। নারিকেল, আম, তেতুল গাছ গুলো অনেক বড় হয়ে গেছে। ঘর গুলো আরো জীর্ণ দশা। অনেক টাকা এখন তার। মাকে সুন্দর ঘর করে দিবে।
উঠান পেরিয়েও দরজার কাছে গিয়ে ডাকে
মা, মাগো
ভেতর থেকে আওয়াজ আসে
কে? কে ডাকে?
মা আমি দুয়ার খোলো

মা দুয়ার খোলে। পূর্ণিমার আলোতে এক যোয়ান ছায়ামূর্তি দেখে বলে, কে তুমি? কে আমার সাজু?
সাজু বুঝতে পারে মায়ের চোখের আলো কমে আসছে। অবাক হয়ে দুজন দুজনার দিকে তাকিয়ে থাকে।

-লেখক : সাবেক অধ‍্যাপক, মিরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।