Home মতামত অগোছালো কথামালায় সাজালাম এবারের ডালা!!!

অগোছালো কথামালায় সাজালাম এবারের ডালা!!!

30

সরদার মোঃ শাহীন:

বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আজকে লিখবো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু গাজীপুর এবং মাওয়াতে দু’দুটো বাসে আগুন লাগার খবরে মনটা অনেকটাই বিমর্ষ হয়ে গেল। গাজীপুরের বাসটিতে পিকনিক ফেরত শিক্ষার্থীতে ঠাসা ছিল। মিনিট সাতেক সময় পাওয়াতে ওরা সবাই নেমে আসতে পেরেছিল। মাওয়ার বাসেও লোকজনে ভর্তি ছিল। ভাগ্যিস, কেউই হত কিংবা আহত হয়নি। কিন্তু বাস দু’টো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
হঠাৎ করে গেল মাত্র কয়দিনে একটার পর একটা পোড়াপুড়ি আর বিস্ফোরণের ঘটনায় মনটা বিমর্ষ না হয়ে পারে! ঢাকা শহরে পরপর বেশ কয়েকটা ভবনে বিস্ফোরণ হয়ে সব ম্যাসাকার হয়ে গেল। এসব কি খুবই সাধারণ ঘটনা! নাকি ভয়াবহ নাশকতা, ভেবে মনটা স্থির রাখতে পারছিলাম না। আবার কি আমরা ক’বছর আগের কঠিন এবং নির্মমতার দিকেই যাচ্ছি! রাজনৈতিক অস্থিরতায় আবারো কি ছাড়খার হবার পথে দেশ!
দেশের রাজনীতি আমি আসলেই বুঝি না। বোঝার চেষ্টাও করি না। কিন্তু একদিকে যখন আগুন আর বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে দেশে, অন্যদিকে দেশের বাইরে ফুটেছে বোমা, তাই একটু ঘাবড়ে গেছি, বলতে পারেন। বিশ্বের রাঘবের দলেরা দলবেঁধে বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে খোলা চিঠি লিখছে, এটা বোমা নয় তো কী? এটা তো নিউক্লিয়ার বোমা।
কেন যেন মনে হচ্ছে, ডাল ম্যাঁ কুচ কালা হ্যাঁয়। সামনে নির্বাচন। একে ঘিরেই কী দেশে বিদেশে বোমাবাজীটা শুরু হয়েছে। আগা নেই, মাথা নেই; কথা নেই, বার্তা নেই; আচমকা বিনা মেঘে যেন ঠাডা পড়েছে। বিশ্বের ৪০ জন নেতা শেখ হাসিনাকে জানাচ্ছে যেন ডঃ ইউনূসের কাজে কামে বাঁধা না দেয় ।
জানালো পত্রিকায় খোলা চিঠি, মানে বিজ্ঞাপন দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা এই বিবৃতি পূর্ণপাতা বিজ্ঞাপন হিসাবে ছাপিয়েছে। হিলারি ক্লিনটন, আল গোর ও বান কি মুনদের মত ব্যক্তিদের বিবৃতি কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন আকারে দিতে হল? কেন এটা সংবাদ আকারে আসলো না? আবার বিবৃতিদাতারা নিশ্চয়ই বিজ্ঞাপন দেননি। তাহলে বিজ্ঞাপনের এই টাকা কে পরিশোধ করেছেন?
সন্দেহের তীরখানা ডঃ ইউনূসের দিকেই যায়। কারণ বিবৃতির বিষয়বস্তু তো তিনিই। যদি তাই সত্যি হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক যে এত্ত এত্ত টাকা এসব কাজে খরচ না করে তিনি তো দেশের জন্যে, দেশের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্যে বিশ্বমানের অন্তত একটা বিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ও করে দিতে পারতেন। এই দেশে অনেকেই না বুঝুক, অন্তত তাঁর মত বিজ্ঞ একজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অর্থ বোঝার কথা। এই দেশে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পায়, তারা এর অর্থ বোঝেন বলে আমার মনে হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির মাঝে ‘বিশ্ব’ কথাটি আছে। এবং বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় বানায়, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির মাঝে যে ‘বিশ্ব’ কথাটি আছে তার মর্মার্থ বোঝে না।
জাপানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমার সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সবচেয়ে বড় বিদ্যালয়কে ইউনিভার্সিটি বা বিশ্ববিদ্যালয় বলে কেন? তিনিও খুব সহজে উত্তর দিতে পারেননি। তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলেছিলেন, যেখানে পড়াশুনা করলে বিশ্বের সবখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা জ্ঞানের কথা তুলনামূলক তত্ত্বের ভিত্তিতে সহজেই আহরণ করা যায় এবং সবকিছু নিয়ে বিশ্লেষণ তথা গবেষণা করা যায় সেটাই বিশ্ববিদ্যালয়। জাপানীজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তাঁর গর্বটাও নজর কাড়ছিল আমার। তবে কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, জাপানের এই চমৎকার বিশ্ববিদ্যালয়ও আজকাল কঠিন সঙ্কটে পড়েছে।
বাংলাদেশের চেয়ে জাপানের লোকসংখ্যা অনেক কম। যদিও আয়তনের দিক থেকে দেশ হিসেবে আমাদের চেয়ে অনেক বড় দেশ জাপান। কিন্তু জনসংখ্যা তার তুলনায় অনেক কম। ১৭ কোটি লোকে ছুঁইছুঁই করছে বাংলাদেশ। পক্ষান্তরে ১২ কোটি লোকের দেশ জাপান। অবশ্য সংখ্যাটি এখন আর ১২ কোটিতেও নেই। নামতে নামতে ১১ কোটি প্লাসে এসে ঠেকেছে। জনসংখ্যা ফি বছর ভয়ানক রকমের কমছে। শুধু কমছেই না। বাড়ার কোন লক্ষণও আর অবশিষ্ট নেই। অবস্থা বড়ই বেগতিক।
অবস্থার এই বেগতিকতায় কঠিন রকমের দিশাহারা জাপান। দিশাহারা যেমনি জাপানের জনগণ, তেমনি দিশাহারা জাপান সরকার। গেল বিশ বছর ধরে জন্মহারের এই ক্রমাবনতি ভাবিয়ে তুলছে সারা জাপানকে। আর সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে মোটামুটি ভাবে জাপানের সব সেক্টরে। অর্থনীতিতে এর আঘাত পড়েছে মারাত্মক ভাবে। কাজ করার লোক দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। কাজ করে যুবাশ্রেণী। জন্মহার তথা জন্ম কমে যাওয়ায় যুবক কিংবা যুবতীদের সংখ্যা কমছে। অন্যদিকে বয়স্করা নিয়মিত অবসরে যাচ্ছে। তাই সমস্যা হচ্ছে কর আদায়ে। দিনে দিনে রাষ্ট্রকে আয়কর দেবার মত মানুষ কমে যাচ্ছে।
এভাবে কমে যাবার কারণে অর্থাৎ লোকবলের ঘাটতির কারণে শিল্পে সমস্যা তৈরী হচ্ছে। বিশেষ করে ভারী শিল্পে। শ্রমিকের ঘাটতি এখানে চোখে পড়ার মত। তিন ধরণের কাজ করার মত লোক এখন জাপানে নেই বললেই চলে। কঠিন বা শক্ত কাজ, নোংরা এবং বিপদজনক কাজ। এই তিন কাজে যুবাশ্রেণী কোনভাবেই যেতে চায় না। তারা সকল সময় সহজ এবং মজার কাজ খোঁজে। তাই এসব কাজ তথা ভারী শিল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে।
তবে প্রথম সমস্যা তৈরী হয়েছিল হাসপাতালে। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা কমছিল। বিশেষ করে গাইনী এবং শিশু বিভাগের রোগী। গাইনীর চেম্বারে যেমনি গর্ভবতী রোগী কমছিল, তেমনি শিশু বিভাগেও শিশু রোগী কমছিল। একটা সময় ছিল, যখন জাপানীজ সমাজে এই দুই বিভাগের ডাক্তাদের রোজগারপাতি ঈর্ষণীয় রকমের ছিল। অথচ এই দুই বিভাগে অনেকেই এখন ভর্তি হতে আগ্রহী নয়।
অন্যদিকে জুনিয়র এবং সিনিয়র স্কুলের অবস্থাও বেগতিক। এখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হচ্ছে। ক’বছর আগ পর্যন্ত ১২ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ৬৮৮টি। পাশাপাশি ডিগ্রী ও মাস্টার্সের কলেজও ছিল অনেক। এখন সংখ্যাটি বেশ খানিকটা কমে ছয়শতে এসে ঠেকেছে। যদিও ১৭ কোটি লোকের বাংলাদেশের তুলনায় এখনও সংখ্যায় অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয় জাপানের আছে। বাংলাদেশে পাবলিক-প্রাইভেট, দেশী-বিদেশী সব মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা হলো মাত্র ১৫১টি।
এর মাঝে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হলো ১০৩টি। সংখ্যা আরও বাড়তে পারতো অথবা বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু বাড়িয়েই বা কী লাভ। সব অনুমোদন নেয় হয় ব্যবসায়ীরা, নয় পলিটিশিয়ানাগণ। অনুমোদন পেয়েই তারা মনে করে সুপার বিজনেজ পেয়েছে। তাই সুপার মার্কেট বানাবার মত করেই বিশ্ববিদ্যালয় বানায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো সুপার মার্কেট নয়। এটি এমন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নয় যে, যখন মনে চায় তখনই এখান থেকে লাভ তোলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় মানে, এখানের আয় থেকে খরচ বাদ দিয়ে পুরোটাই আবার এর মাঝেই বিনিয়োগ করতে হয়।
বিনিয়োগ করতে হয় গবেষণায়। মালিকের একাউন্টে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন মালিকই থাকে না। একটি বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকতে পারা অনেক বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। আমি নিশ্চিত, এটা দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টির পেছনে যারা আছেন, তারা বোঝেন না। তারা বোঝেন কেবল টাকা ।
তবে তারা বুঝতেন, যদি তারা ফিলানথ্রপিস্ট হতেন। নিজের খেয়ে যারা সমাজের জন্যে নিজের কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করেন তাদেরকে ফিলানথ্রপিস্ট বলে। ভারতের বিখ্যাত ফিলানথ্রপিস্ট টাটার মতো ব্যক্তির কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে দেয়া হয়েছে। টাটা একবার তার এক কর্মকর্তা সুধা মূর্তিকে বলেছিলেন, ‘সবসময় একটা কথা মনে রাখবে; তোমার সমস্ত টাকা পয়সার তুমি অছি মাত্র (ট্রাস্টি)। টাকার সবসময় হাতবদল হয়। হাতে রেখে লাভ নেই। টাকা বড় ক্ষণস্থায়ী। যদি সাফল্য আসে সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেবে। সেটাই কিন্তু চিরস্থায়ী’।
এমন মানুষ বাংলাদেশে কি আসলেই আছে!! কঠিন শক্তিধর তথাকথিত বিশ্ববরেণ্য ডঃ ইউনূস কি এমন মানুষ? বিশ্বের ক্ষমতাধর এই মানুষটি, যিনি কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে গ্রামীণ ব্যাংক এবং গ্রামীণ ফোন প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তিনি প্রকৃতঅর্থে বিশ্বমানের একেবারেই অলাভজনক একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো প্রতিষ্ঠা করতেই পারতেন। দশটা না হোক অন্তত একটা গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে পারতেনই! পারলেন না! পারলেন না রেখে যেতে অন্তত একটি অমর সৃষ্টি! যা তাঁকে হাজার বছর বাঁচিয়ে রাখতে পারতো!! আন্তর্জাতিক কূটকৌশলে বাগিয়ে নেয়া বিতর্কিত একটি নোবেল পুরস্কার দিয়ে যা কোনভাবেই সম্ভব নয়!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।