Home জাতীয় ছাত্র ইউনিয়নের সংবাদ সম্মেলন

ছাত্র ইউনিয়নের সংবাদ সম্মেলন

32

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি: বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) আজ এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, গত বছরের ১৬ই মার্চ করোনা পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীদের সুরক্ষার কথা ভেবে বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতির নানারকম উন্নতি ও অবনতির ডামাডোলে প্রায় দেড় বছর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ছিলো। দফায় দফায় ছুটি বাড়ানো হয়, বন্ধ হয়ে যায় মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিকসহ সকল পাবলিক পরীক্ষা। পূর্ববর্তী ফলাফলের ওপর নির্ভর করে এই পরীক্ষাগুলোর নতুন ফল ঘোষণা করা হয়, যা সারাদেশের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ‘অটোপাশ নামে পরিচিতি পেয়েছে। করোনা সংকটের শুরু থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব থেকে শিক্ষার্থীদের এই কঠিন সময়ে তাদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধানে সমস্ত যৌক্তিক আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাদের পাশে থাকার আন্তরিক চেষ্টা চালিয়েছে।
তারা বলেন, মহামারীর কঠিনতম সময়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার জন্য সারাবিশ্বেই সবথেকে উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে অনলাইন স্কুলিং। বাংলাদেশ সরকার অনলাইনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিলে আমরা এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদই জানাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু দেখা গেলো, আদতে অনলাইন স্কুলিং যে প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনা করা হয়েছিলো, তা ছিলো একটি চূড়ান্ত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত ও দিক নির্দেশনা পাঠিয়ে দেয়া হলেও নিম্ন-আয়ের যে বিপুল সংখ্যক কৃষক-শ্রমজীবী জনতা বাংলাদেশে রয়েছেন, তাদের সন্তানদের জন্য ডিভাইস ও ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থা করার কোনো পরিকল্পনাই সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। যে সকল প্রান্তিক অঞ্চলে নেটওয়ার্ক কোনোভাবেই অনলাইন ক্লাস করার উপযুক্ত নয় সে সব অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কথাও পরিকল্পনা করার সময় মাথায় রাখা হয়নি। যার ফলে দেড় বছরের এই লম্বা সময়ে শিক্ষার্থীদের সিংহভাগই অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। যারা অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যেও অনেককে সম্মুখীন হতে হয়েছে নানা অসুবিধার।
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি, কীভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকার এই প্রসঙ্গে যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন, বাস্তবতা খুবই পরিষ্কার। গত বছরের আগস্ট মাসে সানেম (সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনোমিক মডেলিং) তাদের একটি গবেষণা প্রকাশ করে। এই গবেষণা থেকে আমরা জানতে পারি বাংলাদেশে মাধ্যমিক স্তরে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর হার করোনাকালে ৯% বেড়ে ৩৬% থেকে ৪৫% তে পৌঁছানোর কথা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্ট মাসেই স্কুল খুলে দিলেও এই শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়ার কথা। এরপর আরও এক বছর ধরে স্কুল বন্ধ থাকার পরিণামে আরও কত তরুণ-তরুণী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ঝড়ে পড়েছে তা জানার কোনো চেষ্টা সরকার করেনি। একই ভাবে সরকার করোনাকালে দারিদ্র্য বৃদ্ধির বিষয়টিকেও অগ্রাহ্য করার ও এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে গেছে। এই বছরের শুরুতে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) করা এক যৌথ গবেষণা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে করোনাকালে বাংলাদেশের নতুন করে দরিদ্র হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লক্ষ মানুষ। নতুন করে দরিদ্র হওয়া এই মানুষেরা নিজেদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যেতে হিমশিম খাচ্ছে। যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে শিশুশ্রম এবং বাল্যবিবাহ। এই সংকটের ফায়দা নিয়ে লুটেরা শিল্পপতিরা শ্রম আইনের ফাঁদ এড়িয়ে শিশু শ্রমিকদের বয়স বেশি দেখিয়ে নামমাত্র মজুরিতে এই শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ দিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিশুশ্রমের হার কী বর্বর রূপ ধারণ করেছে, রূপগঞ্জের হাশেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত শ্রমিকদের বয়সের দিকে তাকালেই আমরা সেই বিষয়ে একটা সম্যক ধারণা পাই। ব্র্যাকের ‘জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি’ বিভাগের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী করোনাকালে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার বেড়েছে ১৩%। পত্র-পত্রিকা খুললেই বাল্যবিবাহ বৃদ্ধির এই ধারা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। মাধ্যমিক স্তরের চেয়েও বেশি নাজুক অবস্থা বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী সংবাদ-মাধ্যমে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দেখে আমরা জেনেছি যে, প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির আগে শিশুদের তৈরি করার জন্য কিন্ডারগার্টেন, প্রি-স্কুল ও প্রিপারেটোরি স্কুলগুলো মিলিয়ে দেশে যে ৬০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করোনার আগে সচল ছিল তার এক-তৃতীয়াংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের কাছে বারংবার ঋণ চেয়েও প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এই বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানসমূহের অভাব কীভাবে পূরণ করা হবে তা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিন্দুমাত্র মাথাব্যথাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
আরও বলেন, দেড় বছর সশরীরের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্যবিধি মেনে খুলে দেয়া হয়েছে দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনার শুরু থেকেই ছাত্র ইউনিয়ন দাবি জানিয়ে এসেছে এই সময়কালে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন মওকুফ করার। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার পর থেকে এই দাবিকে সামনে রেখে ঢাকা শহরের বিভিন্ন থানায় ও সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সামনে সভা-সমাবেশ করে আসছি আমরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বারংবার এই দাবি জানালেও তারা কর্ণপাত করেনি। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, উল্টো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গে সঙ্গেই নানা আলাপ শুরু হলো যে কী প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে এই অর্থ আদায় করা যায়। শিক্ষামন্ত্রীর তরফ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি টিউশন ফি’তে ছাড় দেয়ার আহবান জানানো হলেও, মওকুফের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। একবারে এত টাকা দিতে সমস্যা হলে কিস্তিতে টিউশন ফি নেয়ার কথাও তাদের বিবেচনা করতে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মহামারীর পুরো সময়জুড়েই বেতন-ফি সম্পূর্ণ মওকুফের দাবি জানিয়ে এসেছে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে ব্যক্তি-মালিকানাধীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের বেতন-ভাতা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আসা টিউশন ফি-এর ওপর নির্ভরশীল। এ সংকট থেকে উত্তরণের পথ হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন বহু আগেই ব্যক্তি-মালিকানাধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ওপর সারচার্জ আরোপ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়েছিলো। এ ছাড়াও, জাতীয় বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেয়া ছাত্র ইউনিয়নের দীর্ঘদিনের দাবি। শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নত বিভিন্ন দেশের বাজেটের দিকে তাকালেই এ কথা স্পষ্ট হয়ে যে শিক্ষার মান উন্নয়নে বাংলাদেশের বরাদ্দ কতখানি অনুপযুক্ত। করোনা মহামারীর কারণে বাংলাদেশের ৩ কোটি শিক্ষার্থী যে অপরিসীম ক্ষতির সম্মুখীন হলো, তা থেকে আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, এবারের জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে বরাদ্দের ক্ষেত্রে আমাদের দাবিকে আমলে নেয়া হবে। বাজেটের পূর্বে বারবার দাবি নিয়ে রাজপথে উপস্থিত থাকলেও আমরা দেখলাম, সরকার বরাবরের মতোই তার নিয়মিত প্রবৃদ্ধির হারেই শিক্ষাবাজেট পেশ করলেন। যেখানে করোনাকালে শ্রমজীবি মানুষের নতুন করে আয় কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ, সেখানে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে করোনাকালীন পুরো সময়ের টিউশন ফি আদায় করা সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তে না আসতে পারা সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতার আরও একটি উদাহরণ।
সংবাদ সম্মেলন থেকে আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর বরাবর শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া তুলে ধরে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রাগীব নাঈম। আজকের সাংবাদিক আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি অনিক রায়, জহর লাল রায়, সদস্য জয় রায়, সাংগঠনিক সম্পাদক মিখা পিরেগু, ক্রীড়া সম্পাদক শিমুল কুম্ভকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সহকারী সাধারণ সম্পাদক মেঘমল্লার বসু, ঢাকা জেলার সহ-সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফাহিম পবণ প্রমুখ।