Home মতামত এবার তোরা মানুষ হ!!!

এবার তোরা মানুষ হ!!!

72

সরদার মোঃ শাহীন:

বহু আগের কথা। মানে, স্বাধীনতার ঠিক পর পরের কথা। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার খান আতার একটা বিখ্যাত ছবি মুক্তি পেয়েছিল; আবার তোরা মানুষ হ। ছবিটার নামের সাথে কিছুটা মিলিয়ে আজকের শিরোনামটা দিলাম। আমি কেবল ‘আবার’ শব্দটা পাল্টে ‘এবার’ বসিয়েছি। বসিয়েছি এ কারণে যে, এবার একটু থামা দরকার। রাজনীতির নামে মানুষকে আতঙ্কিত করারও তো একটা সীমা পরিসীমা আছে। কিন্তু সেটা যখন ভয়াবহ রূপে সাংঘাতিক ভাবে লঙ্ঘিত হয় তখন আর চুপ করে থাকা যায় না। চুপ করে থাকা উচিতও না।

কোনো সন্দেহ নেই, পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের দেশেও বর্তমানে একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। এখানে লুকোচুরির কিছু নেই। এই সংকট শুধু আমাদের দেশে কেন, পৃথিবীর সব দেশেই চলছে। মারাত্মক ভাবে চলছে। তাই বলে এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে বারবার অতিরঞ্জিত খবর ছাপিয়ে, কিংবা মিথ্যাচার করে সংকটকে বড় করার চেষ্টা করা হবে? জাতিকে আতঙ্কিত করে ফায়দা লোটা হবে? শোনা যাচ্ছে মিথ্যাচার করে আতঙ্কিত করা হচ্ছে কুরাজনীতির অংশ হিসেবেই।

খুব করে চাই, তথ্যটি মিথ্যে হোক। তবে দুঃখ যেটা পাচ্ছি, সেটা তো ঠিকই সত্যি সত্যি পাচ্ছি। রাজনীতি তো দেশের জন্যে; দেশের ভালোর জন্যে। অথচ এখানে রাজনীতির নামে তথাকথিত রাজনীতি হচ্ছে দেশের ক্ষতির জন্যে! দেশের ক্ষতির জন্যে হচ্ছে মিথ্যেচার! বাস্তব সত্যিকে পুঁজি করে হাজারটা নয়, আন্দোলনের মত আন্দোলন একটা করলেই হয়। আমরা চাই সেই আন্দোলন হোক সুস্থধারার। শেষমেষ জনতার জয় হোক, এই কামনা সেই ছোটবেলা থেকেই। তাই সঠিক রাজনীতির সঠিক পরিবেশে কখনোই কোন কষ্ট পাইনা আমি। কিন্তু যখনই রাজনীতিকে বেঠিক পথে নেয়া হয় এবং মিথ্যেকে পুঁজি করে গুজব ছড়িয়ে মানুষকে আতঙ্কিত করে রাজনীতি করা হয়, তখন কষ্ট পাই।

এবং মানতে পারি না। মানা উচিতও না। ক’মাস আগে ‘দেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে’ গুজব ছড়িয়ে যারা দেখলেন কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কা হয়নি, তারাই এখন ‘ব্যাংকে টাকা নেই, আমানত তুলে নিন’ বলা শুরু করেছেন। হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে এসব গুজব ছড়িয়েছে। তাই গ্রাহকরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন। এমনকি ব্যাংক থেকে টাকা তোলার জন্য হুড়াহুড়ি লেগেছে বলেও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বিভ্রান্তিকর নানা তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর পরিষ্কার করে জানিয়েছেন ব্যাংক খাতে সামান্যতম তারল্য সংকট নেই। বরং অতিরিক্ত তারল্য আছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, যে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, তা আগামী জানুয়ারি থেকে আর থাকবে না। দুঃখজনক হলো যে, তারপরও ব্যাংকে নতুন আমানত আসছে না। বরং পুরোনো আমানত বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

কেউ না কেউ গুজব ছড়াচ্ছে বলেই ঘটছে। অথচ আইএমএফ এর আচরণ ভিন্ন। আইএমএফ ঋণ দিচ্ছে। ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা না থাকলে কেউ ঋণ দেয়? অন্তত আইএমএফ দেয় না। আবার শুধু আইএমএফের ঋণই না; বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান, সবাই আমাদের ঋণ দিতে আসছে। এদের ঋণ অনুমোদন এটাই প্রমাণ করে যে বিদেশীরা বাংলাদেশকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে না। ভয় পাওয়ানো হচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণকে। নিজের দেশের বাড়তি তারল্যসম্পন্ন ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ে ভয় পাচ্ছে আমজনতা।

গুজব ছড়াচ্ছে বলেই ভয় পাচ্ছে সবাই। সেদিন জাপানে একজনার বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলাম। বলা যায় অনেকটা জোর করাতেই যাওয়া। কেননা করোনায় এখনো সামাজিক বা পারিবারিক ওঠাবসা জাপানে তেমনভাবে শুরু হয়নি। তবে দেশীয় মুখরোচক খাবারদাবারে সময়টা মন্দ যাচ্ছিল না। নানা গল্পগুজবও হচ্ছিল। রাত গভীরে ফেরার সময় হয়। ভদ্রলোক উঠতে উঠতে খপ করে আমার হাত ধরে ফেললেন। কিছু কথা ছিল বলেই আবার বসতে বললেন। আমি বসার আগেই তিনি নিজেই ধপ্পাস করে বিছানায় বসে পড়লেন।

ভাই আমাকে বাঁচান। আমি তো শেষ; বলেই তিনি হাঁপাতে লাগলেন। কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে জানতে চাইলাম সমস্যা কোথায়? সমস্যা তো দেশে। দেশ শেষ। দেশের ব্যাংক শেষ। আমিও শেষরে ভাই। আমিও শেষ। বলে একটু থামলেন। এরপর তার ব্যাংক একাউন্টের ফিরিস্তি দিলেন। জীবনের সঞ্চিত পুরো টাকাটাই তার ব্যাংকে গচ্ছিত। ব্যাংক শেষ হয়ে গেলে তার জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে। পুরো পরিবার নিয়ে পথে বসবে।

এই হলো একজন প্রবাসীর অবস্থা। তার মত লক্ষ কোটি প্রবাসী আছেন। তাদের অবস্থাও একই রকম। গুজব তাদেরকে আধামরা করে দিয়েছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের বর্তমান সংকট মূলত একটা স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির সংকট। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার মাধ্যমে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত থাকবো ঠিক আছে। কিন্তু সেই সুস্থ চিন্তার বদলে গুজবে ভর করে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বো!

আসলে যেসব কথা ছড়ানো হচ্ছে তার কোন ভিত্তি নেই। স্রেফ গুজব। এবং ভাওতাবাজী। সবই পরিকল্পিত ভাবে ছড়ানো হচ্ছে। অথচ সবার অর্থই সুরক্ষিত আছে। সুরক্ষিত নেই বলে যা বলা হচ্ছে, তা সবই অসত্য। ব্যাংকগুলোতে সবার সব অর্থ সম্পূর্ণ সুরক্ষিত আছে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার আসলেই কোনো কারণ নেই। কোন গ্রাহকেরই উচিত হবে না এমনি গুজবে বিশ্বাস করা।

সত্যি কথা হলো, বাংলাদেশ শ্রীলংকা হয় হয় বলে রব উঠেছিলো, শ্রীলঙ্কা হয়নি। বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকে টাকা নাই- এমন একটা রব উঠেছে এখন। নিশ্চিত থাকুন, বাংলাদেশ দেউলিয়া হবে না। কোনো ব্যাংকই ধ্বসে পড়বে না। অর্থনীতিতে চাপ আছে; প্রবল চাপ আছে। ব্যাংকেও চাপ আছে। কিন্তু কোনো ব্যাংক আসলে ধ্বসে পড়ার মতো অবস্থায় যায়নি।

একটা ব্যাপার পরিষ্কার। বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদরা তুলনামূলক কম কথা বলছেন। বরং অর্থ নিয়ে কবি, সাহিত্যিক, রাজনীতিক, অ্যাক্টিভিস্টরা বেশি বলছেন। বাংলাদেশ নিয়ে বাংলাদেশীদের প্রচার প্রচারণার যতোটা ‘গেলো গেলো’ বলে চিৎকার আছে, সেই হতাশাটা বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে নেই । কোনভাবেই নেই। বৈদেশিক নানা সংস্থা বরং বাংলাদেশকে ‘চাপে আছে কিন্তু ঝুঁকিতে নেই’- এমন একটা জায়গায় দেখছে।

নিজের অর্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা করা আর দেশের অর্থনীতি কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা কিন্তু এক বিষয় না। দেশের অর্থনীতি কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হলো খুবই জটিল বিষয়। এসব বুঝতে হলে প্রচুর পড়াশুনা থাকতে হয়। জানতে হয়। অথচ আজকে হাটে মাঠে কিংবা ঘাটে এসব নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে। রিজার্ভ নিয়ে কথা হচ্ছে প্রতিটা চায়ের দোকানে। যারা কথা বলছি তারা কি আদৌ এসব বিষয়ে সামান্যতমও জ্ঞান রাখি? নিশ্চয়ই রাখি না। অথচ জ্ঞানগর্ভ ভঙিমায় কথা বলেই চলেছি।

অবশ্য আমি যতই বলি না কেন, লিখি না কেন; কে শোনে আমার কথা। বাংলাদেশে প্রচুর বাংলাদেশী আছেন যারা এসব শোনার জন্যে একটুও অপেক্ষা করেন না। অপেক্ষা করার সময়ও তাদের নেই। তারা মহাব্যস্ত। দিনভর দিবাস্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত। দিবাস্বপ্ন দেখতে দেখতেই দিন পার করেন, আবার এক সময় ঘুমুতেও যান। এই আশায় যান, যেন সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেখবেন, কী ফকফকা! ‘বাংলাদেশ দেউলিয়া’।

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।