Home মতামত হিরোশিমার পথে পথে!!!

হিরোশিমার পথে পথে!!!

55

সরদার মোঃ শাহীন:

হিরোশিমা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমায় ছাড়খার হয়ে যাওয়া জাপানের দুটো শহরের একটি হিরোশিমা। আর অন্যটি নাগাসাকি। শহর দুটি জাপানের হলেও বিশ্ববাসীর কাছে খুবই পরিচিত। কথা ছিল শোনিমের কিছুটা বোঝার বয়স হলেই ওকে নিয়ে অন্তত একটি শহরে যাবো। বোঝার বয়স বলতে কলেজে ওঠাকে বুঝিয়েছিলাম। করোনাকালীন এই দুঃসময়ে শোনিম কেবল কলেজে ওঠেনি; কলেজ শেষও করেছে।

ভাবলাম তাহলে আর দেরী কেন! অফিসিয়াল কাজে কাছাকাছিই যেহেতু যাচ্ছি, সুযোগটা কাজে লাগাই। আমার শোনিমকে নিয়েই যাই। বলা মাত্রই হুররে বলে শোনিম লাফিয়ে ওঠলো। তবে একগাদা দাবী জানাতেও ভুললো না। ওর দাবী, বিমানে নয়; ট্রেনে করে যাবো হিরোশিমা। দাবীটি যৌক্তিক। বিমানসহ হিরোশিমা যাবার নানা ধরনের অপশন আছে। তবে সবচেয়ে কমফোর্ট হলো রেলপথে যাওয়া। চমৎকার সুন্দর ভ্রমণদায়ক জাপানের রেলপথ।

টোকিও থেকে দুপুরের ট্রেন। বুলেট ট্রেন। সমস্যা হলো শোনিমের ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে। টানা তিন বছর রাতভর অনলাইনে ক্লাস করা ছেলেটি এখনো অভ্যাসবশত ঘুমুতে যায় ভোর ছয়টায়। ট্রেন ধরার জন্যে তেমনটা না ঘুমিয়ে কেমন করে আগেভাগে বিছানা ছেড়ে রওনা দেবে সেই টেনশনে ছিলাম। তবে শোনিম সহযোগীতা করেছে। সময় মত ওঠেছে এবং সময় মতই টোকিও স্টেশনে পৌঁছে ট্রেনের নির্ধারিত সিটে বসতেও পেরেছে।

বুলেট ট্রেনকে জাপানীজ ভাষায় বলে শিনকানছেন। সমগ্র জাপান ছেয়ে আছে উচ্চ গতিমাত্রার এই ট্রেনটি। দেশটির এক মাথা থেকে আরেক মাথা; যেখান থেকে যেখানেই কেউ যাক না কেন, শিনকানছেন আছেই। যেমনি প্লেন আছে। তেমনি শিনকানছেনও আছে। প্লেন আর শিনকানছেন; ভাড়ার পার্থক্যও তেমন নেই। সার্ভিসেরও নেই। প্লেনে এয়ারপোর্ট ফরমালিটিজে অনেক সময় ক্ষেপণ হয়। বুলেট ট্রেনে হয় না। গেলাম আর উঠলাম; ঠিক এমন।

প্রচন্ড দ্রুতগতির এই বুলেট ট্রেন। ঘন্টায় ৩৫০ কিমিঃ বেগে আমাদের নিয়ে শা শা করে ছুটে চলছে ট্রেনটি। তবে আরো বেশি গতির নতুন ট্রেনও আসছে। ২০২৭ সালে এর গতি দাঁড়াবে ৫৫০ কিমিঃ। বর্তমান ট্রেন ব্যবস্থায় ঢাকা চট্টগ্রাম ২৪৮ কিমিঃ যেতে সময় লাগে ৫ ঘন্টা ৩৩ মিনিট। সর্বোচ্চ গতির বুলেট ট্রেন বাংলাদেশ চালু করতে পারলে যেতে পারবো মাত্র ৩৩ মিনিটে। ঢাকা থেকে মাত্র আধা ঘন্টায় চট্টগ্রাম!

এটা এখন আর কেবলই স্বপ্ন নয়। বাংলাদেশের ট্রেন ব্যবস্থার পরিবর্তনে সরকার নানা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম ঢাকা চট্টগ্রাম হাইস্পীড ট্রেন লাইন। এই রুটে বুলেট ট্রেন হবার সম্ভাবনাই বেশি। সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে। খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত আসছে। এ ছাড়া সমগ্র দেশের মধ্যে যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হিসেবে সরকার রেলপথকেই এগিয়ে নিচ্ছে। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে পদ্মাসেতু হয়ে ঢাকা বেনাপোল রেলপথ। ঢাকা বরিশাল রেলপথের টেন্ডারও হবে শীঘ্রই। আগামী বছরেই চালু হবে ঢাকা কক্সবাজার রেলপথ।

দেশের এমন সব চমৎকার ডেভেলপমেন্টের কথা ভাবতে ভাবতে কখন হিরোশিমা পৌঁছেছি টের পাইনি। হোটেলে পৌঁছতেও দেরী হয়নি। হিরোশিমা পিস মিউজিয়ামের পাশেই আমাদের হোটেল। প্রথম দিনটা কাজে লাগানোর জন্যে কোন রকমে মালছামানা হোটেল রুমে রেখেই বেরিয়ে পড়েছি। সাথে থাকা তিনজন জাপানীজ যতটুকু সম্ভব গাইড দিয়ে যাচ্ছিলেন। চাপা স্বভাবধর্মী গাইড। হিরোশিমা ট্রাজেডি মূলত জাপানীজদের জন্যে লজ্জার। বিশ্বযুদ্ধে হেরে যাবার লজ্জা। পরাজয়ের লজ্জা। হয়ত এ কারণেই তারা খুব বেশি উচ্ছসিত ছিল না।

উচ্ছসিত না হবার কারণ আছে। জায়গাটি ওদের জন্যে ভীষণ রকমের সেনসেটিভ। আর ঘটনাটি সাংঘাতিক রকমের নির্মম, কষ্টের এবং হৃদয় বিদারক। শুধু ওরা স্তম্ভিত হয়নি, সারা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল এই নিউক্লিয়ার বোমা। যার ভয়াবহতা ভাষায় তুলে আনা অসম্ভব। মিউজিয়ামে রক্ষিত ধ্বংসলীলার স্মৃতিচিহ্ন, স্থির চিত্র, ভিডিও ফুটেজ এবং পারমাণবিক বিষক্রিয়ায় তৎক্ষণাৎ কিংবা সময় নিয়ে তিলে তিলে মৃত্যুর গল্প অনেকেরই দেখতে বারণ। কেননা সবাই নিতে পারে না। অজ্ঞান হয়ে পড়ে কিছুটা দুর্বল চিত্তের অনেকেই।

মিউজিয়ামটি করা হয়েছে বোমাটি মাটিতে যেখানে আঘাত করে ঠিক সেখানেই। পুরো মিউজিয়ামটি একবার ঘুরে দেখলে নিউক্লিয়ার বোমার বিভিষীকা নিয়ে মোটামুটি ধারণা পাওয়া যায়। শোনিম ঘুরে ঘুরে দেখছিল আর চেষ্টা করছিল বিষয়টি বোঝার। মিউজিয়ামের পাশ ঘেষে বয়ে চলা নদীর উল্টো পাড়ে ধ্বংসলীলার সাক্ষী হয়ে আজো অবিকল দাঁড়িয়ে আছে সেই ভবনটির ধ্বংসাবশেষ। যেটা ছিল তখনকার সরকারি সিটি অফিস।

১৯৪৫ এর ৬ আগস্ট মানুষে গিজগিজ করছিল অফিসটি। ভোরের হিরোশিমায় নিত্যদিনের মত সাধারণ মানুষ কাজে বের হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বই কাঁধে নিয়ে স্কুলের পথে নেমেছে। গৃহিণীরা স্বামীকে কাজে পাঠিয়ে কেবল ঘরের কাজে হাত দিয়েছে। হঠাৎ মাঝ আকাশে আলোর ঝলকানি। কেউ বোঝার আগেই সর্বত্র আগুনের ঝড় বইতে শুরু করেছে। নিউক্লিয়ার বোমার আঘাতে ঘরে বাইরের সবার শরীর যখন লাল আগুনের ঝলকানীতে পুড়ে উঠছিল, দিশাহীন মানুষের দল তখন সিটিভবন থেকে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল সামনের নদীতে। একটু ঠান্ডা পানির আশায়; একটু বাঁচার আশায়!

কেউ বাঁচেনি! বাঁচতে পারেনি!! নদী বেয়ে হাজার হাজার মানুষের লাশ সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে। রক্তগঙা বয়ে গেছে শহরের উপর দিয়ে বয়ে চলা টলটলে মিঠা পানির নদীতে। আগুনের লেলিহান শিখায় ঘরবাড়ী, আসবাবপত্র সব গলে গলে একাকার হয়েছে। যারা তৎক্ষণাৎ মারা যায়নি তারা বেঁচে ছিল চামড়াবিহীন রক্তমাখা শরীর নিয়ে। সে সবের বর্ণনা পড়ে এবং ভিডিও দেখে পিস মিউজিয়ামের সামনে রক্ষিত শিখা অনির্বাণে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা শোনিম বিড়বিড় করে শুধু বলছিল, মানুষ কেন যুদ্ধ করে?

সফরসঙ্গী আসাদা সান কিংবা কিউচি সান উত্তর দিতে পারেনি। পারেনি ফুজিওয়ারা সানও। কলকল রবে সামনে বয়ে চলা নদীর জলের দিকে তাকিয়ে শুধু নিঃশ্বাস ফেলেছে বড় করে। নিঃশ্বাস কষ্টের হলেও ফুজিওয়ারার আছে ভিন্ন আদলের গল্প। বেঁচে যাবার গল্প। ফুজিওয়ারার বাবা তখন ছোট। প্রাইমারীর ছাত্র। বিশ্বযুদ্ধের সময় বাবাকে নিয়ে দাদা এই শহরেই ছিলেন। বোমার শহর; হিরোশিমা।

প্রতিদিনই কোথায়ও না কোথাও আমেরিকান বোমা হামলা হতো। বাতাসেও নানা গুঞ্জন, নানা জল্পনা। নানাজনের নানা কথা। আমেরিকা খারাপ মতলব আটছে। খুব খারাপ বোমা নিয়ে হয়ত খেলবে। আতঙ্কিত দাদা মনস্থির করে পরিবার নিয়ে হিরোশিমা ছেড়ে দূরের শহর ককুরায় চলে গেলেন। তার ক’দিন পরেই হিরোশিমায় এটম বোমা পড়ে। বেঁচে যায় ফুজিওয়ারার পরিবার।

কিন্তু বিপদ ছাড়ে না তাদের। তাড়া করে ফেরে। আমেরিকা মূহুর্মুহু আক্রমণ শুরু করে ককুরা সিটিতে। হিরোশিমায় এটম বোম ফেলার দু’দিন পরে আমেরিকান বিমান এটম ফেলতে আসে ককুরায়। পারে না। জাপানের পাল্টা আঘাতে ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যায়। যাবার পথে অপরিকল্পিত ভাবে নাগাসাকিতে ফেলে যায় ২য় বোমাটি। হিরোশিমার ছাড়খাড় হয়ে যায় নাগাসাকি। আবারো বেঁচে যায় ফুজিওয়ারার পরিবার। এটাই ভাগ্য। ফুজিওয়ারার পরিবারের ভাগ্য।

কিন্তু দুর্ভাগ্য ছিল জাপানের। জাপান নির্মমভাবে যুদ্ধে হেরে যায়। হেরে যেয়েও যুদ্ধে পরাজয়ের চিহ্ন আজও ধরে রেখেছে। স্মৃতি ধরে রেখেছে। আর আমরা! আমরা এই বাংলাদেশীরা কোন যুদ্ধে হারিনি। না ভাষার যুদ্ধে হেরেছি, না স্বাধীনতার যুদ্ধে। অথচ যুদ্ধজয়ের চিহ্ন তথা প্রকৃত ইতিহাস মুছে দেবার জন্যে আমাদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার কমতি নেই। দলবদ্ধভাবে জাতির বড় একটা অংশ আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে বর্বরতাকে ভুলে, ইতিহাসকে ঠেলে শত্রুর অপরাধকে ছোট করে দেখতে। গর্বের ইতিহাসকে পায়ে ঠেলে গর্বহীন সাজার মিছে চেষ্টা এক বাঙালী ছাড়া পৃথিবীর আর কোন জাতি করেনি!!!

-লেকক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।