এম এইচ নাহিদ ।। উন্নয়নশীল দেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, নিজস্ব আয়ে পদ্মা সেতুর স্বপ্নযাত্রা পূরণ’সহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়েছে বাংলাদেশ। টানা তিন মেয়াদে থাকা ক্ষমতাসীন সরকার দেশকে পৌঁছে দিয়েছে বিশ্ব দরবারে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ দেওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ‘ভুখা বাঙালি’ বলা পাকিস্তান সহ বিশ্ব নেতাদের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। মহামারি করোনার মতো কঠিন দুঃসময় মোকাবেলা করতেও তেমন বেগ পেতে হয় নি। কিন্তু ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বিপর্যস্ত বিশ্ব অর্থনীতির ধাক্কায় একেবারেই নাজেহাল হয়ে পড়েছে। কঠিন সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশ। সামনে আরো ভয়াবহ সংকট আসছে তার ইঙ্গিত মিলছে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে। বার বার কৃচ্ছ্রসাধনের পরামর্শ, নানামুখী পদক্ষেপেও মিলছেনা সংকট উত্তরণের পথ। ক্রমাগত মুদ্রাস্ফীতি, ডলার বাজারের উর্ধ্বগতি, আকাশছোঁয়া পণ্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধিতে জনজীবন একেবারে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন হলো এমন কঠিন পরিস্থিতির জন্য কি কেবল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ’ই দায়ি! বিশ্ববাজারে তো জ্বালানি মূল্য কমেছে, আন্তর্জাতিক পণ্যমূল্যও তো নিম্নমুখী-তাহলে বাংলাদেশের বাজারে অস্থিরতা কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, এই কঠিন পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ি সিন্ডিকেট। মূলত সিন্ডিকেটের কালো থাবায় নাকাল বাংলাদেশ। এ থাবায় নাকাল গরিব-মধ্যবিত্তরা, অনেকটা অসহায় সরকার।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সচেতন মানুষ বলছেন, এখন এক মহাতঙ্কের নাম ‘সিন্ডিকেট’। বাজার থেকে সংসদ-সর্বত্র সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। ব্যাংক-বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শেয়ারবাজার, শিক্ষা, চিকিৎসা, পরিবহন, অর্থপাচার, বাজার ব্যবস্থা, প্রশাসন, এমনকি রাজনীতিও সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে। রাষ্ট্রপতি নিজেই বলেছেন, “রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে।” ফলে তাদের ইশারায় ঘুরছে বাংলাদেশ। আজ পর্যন্ত কোনো সেক্টরের সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কিছুই করা যায় নি। তাদের জবাবদিহীও করতে হয় নি। কারণ এদের ক্ষমতা ও অর্থের জোর অপরিসীম। ক্ষমতার কালোহাত এতই লম্বা যে সংসদের বাজেটও জনবান্ধব নয়, হয় ব্যবসায়ী বান্ধব। এ কালোহাত ভেঙে দেওয়া যায় না কেন?-কারণ ওরা কোনো দলের নয়, ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে ওরাই ক্ষমতাসীন দলের নাটাই ঘুরায়।

ফলে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মাধমে বছরে ৬৪ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। আর ২০১৬ থেকে ২০২০ পর্যন্ত-৫ বছরে পাচার এরাই দেশ থেকে বিদেশে পাচার করেছে ৩ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা-এ তথ্য জানাগেছে গ্লোবাল ফিন্যালন্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে।

সম্প্রতি ডলার বাজারের অস্থিরতার জন্যও দায়ি সিন্ডিকেট। বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিযান প্রতিবেদনে সেটাই ফুটে উঠেছে। মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ব্যাংক ও হুন্ডি ব্যবসায়ীরা শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে ডলার বাজার অস্থির করে তুলেছিল। যার মাশুল দিতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। দিনকে দিন ডলার উর্ধ্বগতিতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে হু হু করে, কমেছে বার্ষিক রিজার্ভের পরিমাণ। শেয়ার বাজারের হাজার হাজার মানুষের আহাজির পিছনেও রয়েছে সিন্ডিকেটের কারসাজি। তাদের অদৃশ্য কালোহাতের কারণেই বাজার উঠা-নামায় বহু মানুষ পথে বসেছেন, এমনকি সব হারিয়ে আত্মহত্যাও করেছেন।

উৎসব, বন্যা, খরা, হরতাল, অবরোধ হলেই বাজার সিন্ডিকেট ‘অজুহাত’ নামক তৃতীয় হাত খাড়া করে বাজারকে অস্থির করে তুলে। হু হু করে বাড়ে নিত্যপণ্যের দাম। পেঁয়াজ সিন্ডিকেটের থাবায় পেঁয়াজের ঝাঁজে ক্রেতার চোখের পানি ঝড়েছে, সে পানি এখনো ঝড়ছে। এই সিন্ডিকেট কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবং দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৩০০ টাকা কেজিতে ওঠা পেঁয়াজের ঝাঁজ কমতে না কমতেই লবণ সিন্ডিকেট হঠাৎ করেই দাম বাড়িয়ে দেয়। তাই দেখে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মুনাফার লোভে নানাভাবে পণ্যের দাম বাড়ায়। করোনা মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে এলেও তাদের জন্য তা ছিল আশির্বাদ। নীতিহীন অসাধু বাজার সিন্ডিকেট করোনার অজুহাতে সকল পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

সে ধাকা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আসে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। বিশ্ববাজারে জ্বালানি মূল্য ও পণ্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির ধুয়ো তুলে একের পর এক বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। ডিজেলের দাম বৃদ্ধিতে বাজারে রীতিমতো আগুন ধরেছে। নিত্যপণ্যের গগণচুম্বী দামে বাড়ছে ক্রেতার হাহাকার। আকাশছোঁয়া সয়াবিনের মাঝে কিছুটা কমে আবার বেড়েছে। বাজারে তেল নেই। দাম বাড়ার সাথে সাথে তেলের ব্যারেলের মুখ যেন খুলেগেছে। এখন আর সংকট নেই। সবই তেল উৎপাদনকারী পাঁচ কোম্পানির সিন্ডিকেটের খেলা।

একই সাথে চলছে চাল সিন্ডিকেটের চালবাজি। মিলাররা দোষ দিচ্ছে আড়ৎদার ও পাইকারি ব্যবসায়ীকে, আর আড়ৎদার ও পাইকারি ব্যবসায়ী দোষ দিচ্ছে মিলারদের। মূলত উভয় মিলে গড়ে তোলা সিন্ডিকেটের কালো থাবায় বাজারে চাল কিনতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের। ডিম সিন্ডিকেটের খেলাও দেখলো বাংলাদেশ। হঠাৎ করেই ডিমের হালি হয়ে গেল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। এছাড়া বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই ডাল, চিনি, মুরগি, সবজি সহ সকল নিত্যপণ্য আজ অগ্নিমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে যে ভেজাল পণ্যের ছড়াছড়িও তাদের কারসাজিতেই। বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হওয়া সঙ্গে সঙ্গে সরব হয়ে উঠেছে ইলেট্রনিক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। বাড়ছে জেনারেটর, চার্জার ফ্যান, লাইটের দাম।

অন্যদিকে চিকিৎসার নামে গলা কাটছে চিকিৎসা সিন্ডিকেট। প্রাইভেট ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক ব্যবসায়ী ও চিকিৎসরা মিলে মানুষের পকেট থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে হাজার হাজার টাকা।  বেড়েছে সকল ওষুধের দাম। বাধ্য হয়েই অসহায়ের মতো বেশি টাকায় চিকিৎসা ও ওষুধ কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ যাদের দেখার দায়িত্ব, তারাই নির্বিকার।

সড়কে জীবনের নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিন পাখির মতো মানুষ মরলেও তার প্রতিকার হচ্ছে না। অথচ নানা অজুহতে পরিবহণ ভাড়া বাড়ছে ক’দিন পরপর’ই। এখানেও পরিবহণ মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। যার কাছে নতিস্বীকার করেছে বিআরটিসি। দেশের অর্থনৈতিক সংকটের পিছনে অন্যতম দায়ি ব্যাংকিং ও আর্থিক খাত। এ খাতের নৈরাজ্যের পিছনে সিন্ডিকেটের বিশাল হাত রয়েছে। তারা নানাভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলেছে।

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য শিক্ষা খাতেও। শিক্ষাভবন থেকে স্কুল, কলেজ-দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এক বিশাল সিন্ডিকেটের কারণেই শিক্ষার আজ বেহাল দশা। এছাড়া অন্যায়-অনিয়ম, অপরাধ জগতের যে দাপট-তার পিছনেও রয়েছে সিন্ডিকেট। প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতা সে সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। ফলে অপরাধ করেও অপরাধীরা ঘুরে বেড়ায় পুলিশের নাকের ডগায়। মাদক-দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার জিরোটলারেন্স ঘোষণা করলেও দেশকে মাদক-দুর্নীতিমুক্ত করা যায় নি। কারণ ‘সর্ষের মধ্যে ভুত’ দিয়ে ভুত তাড়ানো যায় না। তাই দেশ আজ মাদক ও দুর্নীতির আগ্রাসী থাবায়।

সিন্ডিকেটের কালো হাত রয়েছে প্রশাসনে। তানাহলে কেন কোনো সেক্টরের সিন্ডিকেট ভাঙা যায় না-এমন প্রশ্ন আজ সকলের। প্রশ্ন উঠাই স্বাভাবিক। যেখান থেকে সিন্ডিকেটের কালো থাবা মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ নেওয়া হবে-সেই সংসদে’ই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। মোট সাংসদের মধ্যে ১৮২ জনই ব্যবসায়ী। অন্যান্য পেশার সংখ্যা মিলে সেখানে প্রকৃত রাজনীতিবিদের সংখ্যা খুবই অল্প। ক্ষমতা হারানোর ভয় আর অর্থের লোভে তাদের ভয়েসও দুর্বল। দুই/এক জন থাকলেও তাদের কণ্ঠস্বর সংসদের সবার কানে পৌঁছে না। ফলে জনতার কল্যাণে নয়, সেখানে আইন ও বাজেট পাস হয় ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায়।

দেশজুড়ে সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম্যের মূল কারণ হলো গরিব মানুষের কোনো সিন্ডিকেট নেই। নেই মধ্যবিত্তের সিন্ডিকেট। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা কৃষকও কোনো সিন্ডিকেট করতে পারেন না। সিন্ডিকেট গড়ে তুলতে পারছেন না নব্যদাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী শ্রমিকরা। অথচ বাংলাদেশের অর্জন অক্ষুন্ন রেখে সামনে চলা এবং সামগ্রীক মুক্তির জন্য পুঁজিবাদী সিন্ডিকেট ভেঙে জনতার সিন্ডিকেট গড়ে তোলা জরুরি। তার সাথে জরুরি প্রকৃত রাজনীতিবিদদের ঐক্যবদ্ধ সিন্ডিকেট-মন্তব্য রাজনৈতিক বোদ্ধা ও বিশ্লেষকদের।