Home মতামত সময়ের আলোকবর্তিকা অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম

সময়ের আলোকবর্তিকা অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম

98

প্রিয় কমরেড, পরিবারের সদস্য, আত্নীয়-পরিজন, সহকর্মী, শুভাকাঙ্খী, সুহৃদ সকলেই আজ ২৭ জুন অশ্রুসজল আর দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বিদায় জানালেন তাদের অতি প্রিয় অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুমকে। বিদায় জানালো তাঁর পার্টি অফিস, তাঁর কর্মস্থল সুপ্রিমকোর্ট আর হাই কোর্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আর প্রিয় শহীদ মিনার।
২০২১ সাল, চলছে একের পর এক মৃত্যুর মিছিল। বছর শুরু হয়েছিল নারী আন্দোলনের মহীরুহ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানমের মৃত্যু দিয়ে। একে একে চলে গেলেন আরো অনেকে। গত মে মাসে ২৬ মে আমার বাবা বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, গাজীপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর দেলওয়ার হোসেন মারা গেলেন।তার একদিন আগে ২৫মে হৃদরোগে আক্রান্ত হন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সিনিয়র প্রসিকিউটর, বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট জেয়াদ আল মালুম। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. মালুমকে শ্যামলীতে অবস্থিত একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে লাইফ সাপোর্ট দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্থানান্তর করা হলেমাসাধিকসময় ধরে সেখানেই চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় গতকাল ২৬ জুন রাত ১১টা ৫০মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আমাদের মালুম ভাই। রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে যেকোন মামলা মোকদ্দমার বিষয় হাজির হলেই নির্বিঘ্নে যাঁর নাম মনে আসত তিনি মালুম ভাই, আমাদের আস্থা আর আশা ভরসার প্রতীক।
মালুম ভাইয়ের অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে যে স্মৃতি আমার চোখে এখনও জ্বলজ্বল করে তা হলো ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নেয়ার সেই সময়কালের কথা। জরুরী অবস্থা প্রত্যাহারসহ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতেসেই সময় মিছিল করার দায়ে আমাদের পল্টনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কার্যালয় সংলগ্ন মণিসিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্টের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রায় শ’খানেক পুলিশ যখন ট্রাস্ট ভবনে ঢোকার ভাব করে রাইট টার্ন নিয়ে আমার সামনে এসে বলে ধর এদেরকে। তখন আমি কালক্ষেপন করার কৌশল নেই। অর্থাৎ তাদেরকে নানাধরনের প্রশ্ন করে দেরি করাতে থাকি। উদ্দেশ্য হলো পার্টি অফিস থেকে যেন আমাদের নেতৃবৃন্দরা আসেন দেখতে পান আমাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাহিনী।
খবর পাওয়া মাত্রই সিপিবি অফিস থেকে ছুটে এলেন মালুম ভাই। পরিচয় দিলেন তিনি সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী। কিন্তু পুলিশের বড় কর্মকর্তা বললেন আজ আর কারো কথা শুনবোনা। মালুম ভাই আমাদের রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে পল্টন মোড় পর্যন্ত এলেন। কোন কাজ হলোনা। পুলিশ আমাদের ধরে নিবেই নিবে। ধরা পড়লাম সিপিবি কর্মী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি তখন টিআইবিতে কর্মরত বিপ্লব সাহা, ছাত্র নেতা কল্লোল বণিক ও আমি, ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সভাপতি। আমাদের নেয়া হলো পল্টন থানায়।
তখন এমন একটা অবস্থা আমাদের পার্টি অফিসও পুলিশ দীর্ঘ সময় ধরে ঘিরে রেখেছিলো। কাউকে ঢুকতে বা বের হতে দিচ্ছিল না। দেখা করতে আসলেন শুধুমাত্র ছাত্র ইউনিয়ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, সিপিডিতে কর্মরত মীর আহসান হাবীব রিয়াদ ভাই, আর আসলেন সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের রাষ্ট্রীয় বডিগার্ড (সম্ভবত এসআই পদমর্যাদার)।
পরেরদিন সকাল বেলায় আসলেন কল্লোলের বাবা এবং আইনজীবী আইনুন নাহার লিপি আপা। এর আগেই আমরা সকালবেলার পত্রিকা পড়ে ফেলেছি। জরুরী অবস্থা ভঙ্গের শাস্তি ১৪ বছর জেল। কল্লোলতো পরিকল্পনা করেই ফেললো বিয়ে-শাদি আর করবেনা।
সেই দুঃসময়ে আমাদের রক্ষা করেছিলেন মালুম ভাই। কঠিন আইনী লড়াই করে আমাদের জামিনে মুক্ত করেছিলেন। আদালতে কি তার বলিষ্ঠ কন্ঠ আর জোরালো যুক্তিপূর্ণ উপস্থাপনা, আজো ভোলার নয়।
এরপর এলো ২০০৭ সালের আগস্ট ছাত্র বিক্ষোভ। সেই বিক্ষোভের জের ধরে ছাত্র ইউনিয়ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি মানবেন্দ্র দেবকে শিক্ষা দিবসের প্রাক্কালে ২০০৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। গ্রেফতার হয় আরো আরো ছাত্র ও শিক্ষকগণ। আমরা তখন দিগ্বিদিক হয়ে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াই। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা, কীভাবে কীভাবে মুক্তির রাস্তা বের করা যায়? এরকম অনেক দিন গেছে আমি আর বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রীর তৎকালীন সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন সেগুনবাগিচায় নির্মীয়মান ভবনের আড়ালে বসে বসে নানা ধরনের পরিকল্পনা করছি।
সেইসময়ও রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়ান মালুম ভাই।মালুম ভাই সেইসময়ও ছিলেন জোরালো ও সাহসী ভূমিকা। নিজের মামলা, মানবের মামলা সব মিলিয়ে এত এত ঘন ঘন যেতে হতো যেমেহেরবা প্লাজার মালুম ভাই’র সেই চেম্বার অনেকটা আমার ঘর-বাড়ীর মতই হয়ে গিয়েছিল। তীব্র ছাত্র আন্দোলন ও আইনী লড়াইয়ে ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্ত হন ছাত্র-শিক্ষকগণ।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একে একে জাতীয় নেতারা মুক্ত হতে শুরু করেন। আস্তে আস্তে ঘরোয়া রাজনীতির প্রচলন শুরু হয়। একসময় অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিদায় নেয় সেনাসমর্থিত জরুরী সরকার।
মহাজোট সরকারের আমলে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জোরালো দাবী বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলে রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য আবারো ডাক পড়ে করিৎকর্মা অ্যাড. মালুমের। ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপুর নেতৃত্বে প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। সেই থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজনের বিচারে রাষ্ট্রপক্ষে জোরাল ভূমিকা রাখেন তিনি।
টাঙ্গাইল জেলার সদর থানার করোটিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করা কমরেড জেয়াদ আল মালুম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র । ঢাবিতে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
পরে তিনি বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটিতে দায়িত্ব পালন করেছেন।
জেয়াদ আল মালুম ছাত্রজীবন শেষে ১৯৮৩ সালে ঢাকা জজ কোর্টে আইনজীবী হিসেবে পেশা শুরু করেন। তিনি ১৯৮৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য পদ পান।
এরপর ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
একে একে নিভিছে দেউটি। এই সময়ের আলোকবর্তিকা, একজন মালুম ভাই কত লড়াই-সংগ্রাম আর ত্যাগ-তীতিক্ষার মাধ্যমে গড়ে ওঠেন, নিত্য নতুন কতো সংগ্রামের আশা ভরসার আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠেন! সেই সংগ্রামের প্রতিচ্ছবির আদলে সেই মানুষ তৈরি হওয়ার নিরন্তর প্রক্রিয়া কি আজো সদা প্রবাহমান? না আমরা এক অবিরাম ক্ষরা আর জরার গোলকধাঁধায় হাবুডুবু খাচ্ছি?
আমাদের সামনে আলোকবর্তিকারা একে একে তাঁদের আলোক বিচ্ছুরণ করে বিদায় নিচ্ছেন। এই প্রজন্মের হাতে যে অগ্নি-মশাল রেখে গেলেন আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম তাঁর সম্মান আমাদের রাখতেই হবে। তাঁদের অসমাপ্ত লড়াইকে বিজয়ী করে সেই কাঙ্খিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই একমাত্র সম্ভব তাঁদের স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করা।
-লেখক:সামসুল আলম সজ্জন, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।