Home মতামত সমস্যাটা আসলে কোথায়!!!

সমস্যাটা আসলে কোথায়!!!

28

সরদার মোঃ শাহীন:

নিজ দেশ থেকে প্রবাসীদের প্রবাসে ফিরে যাওয়াটা সব সময়ের জন্যেই কষ্টের হয়। যথেষ্ঠ কষ্টের। প্রবাস জীবন যতই স্বাচ্ছন্দের হোক না কেন, ততটা মজার হয় না কখনোই। দেশের মজা দেশেই হয়। এ মজা অন্য কোথায়ও হবার নয়। প্রবাসী হিসেবে বিষয়টা আমি হাঁড়ে হাঁড়ে আঁচ করতে পারি সর্বক্ষণ। বিষয়টা আমাকে কষ্টও দেয়। আজ পর্যন্ত একটিবারও এই কষ্ট পাওয়া ছাড়া দেশ থেকে বের হতে পারিনি। প্রতিবারই প্রবাসে রওনা দেবার দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসে, কলিজার মধ্যে মোচড়ামুচড়ি ততই বাড়তে থাকে।

এই মোচড়ামুচড়ি নিয়ে আমার পুরো জীবনের প্রায় অর্ধেকটাই কেটে গেল। কেননা জীবনের অর্ধেকটাই যে প্রবাস জীবন। প্রতিবারই প্রবাসে ফেরার সময় ঝামেলা বাঁধে। ঝামেলা বাঁধায় আপনজনেরা। আপনজনদের ঘরে রেখে বেরিয়ে আসার সময় একটা আবেগঘন পরিবেশ তৈরী হয়। বিদায়ী পরিবেশ। কাঁদো কাঁদো চোখেমুখে বিদায় জানাতে আসে সবাই। নিমিষেই খারাপ হয়ে যায় মুহুর্তগুলো। বেশ খারাপ হয়।

এটা এক রকমের খারাপ লাগা। ভাল লাগা মেজাজে খারাপ লাগা। তবে উল্টোটাও আছে। খারাপ লাগা মেজাজে খারাপ লাগা। যার শুরু হয় এয়ারপোর্টে পৌঁছার পর থেকেই। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন এটা শুরু করে। এয়ারপোর্টের ডিপারচারে ওঠার র‌্যাম্পের মুখে ঝিকঝাক ব্যারিকেট দিয়ে রাখা আনসার পুলিশের ক্যাম্প। এটা চেকপোস্ট। যাত্রীছাড়া গাড়ীতে অন্য কেউ আছে কি না এটা চেক করে। চেকের কারণে একটার বেশি গাড়ি উপরে উঠতে পারে না একসাথে। ফলে বাকী সব গাড়ি পেছনে লম্বা লাইনের জ্যামে পড়ে। দুইলেনকে একলেন করে রাখে বলেই জ্যাম পড়ে।

এটা জাস্ট হয়রানী। যাত্রী তথা জনগণের সাথে মজা করা। নিরাপত্তার নামে শুধু শুধু জ্যাম বাঁধিয়ে মজা করা ছাড়া এটা অন্য কিছু না। এমনিতেই মহাসড়কে কঠিন জ্যাম পেরিয়ে দোয়া-মন্ত্র পড়তে পড়তে যাত্রীসকল এয়ারপোর্টে আসে। ‘এই বুঝি ফ্লাইট মিস হয়ে গেলো’ ভাবতে ভাবতে গলদঘর্ম হয়। ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে অনেকে ফ্লাইট মিসও করে। এত কিছুর পর যদি জাস্ট ভিতরে ঢোকার মুখে এভাবে বসিয়ে রেখে হয়রানী করে এটাকে কী বলবো? জামাই আদর? নাকি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে তথাকথিত আদর পর্ব? আসলেই কি এভাবে নিরাপত্তা দেয়া যায়? মানলাম নিরাপত্তাই দিচ্ছেন। তাহলে ব্যবহার এত চটাং চটাং কেন? রুক্ষ্ম কেন? যাত্রী সকল কি চোর না ডাকাত? ভাল ব্যবহার কি করা যায় না? ভাল ব্যবহার দিয়েও তো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়। কী সিকিউরিটি চেক, কিংবা কী চেকইন অথবা ইমিগ্রেশন; সবাই যেন মিলিটারী ম্যান। কথায় কথায় চটাং চটাং ব্যবহার। চেয়ারে বসেই শুরু। সারাক্ষণ চোখেমুখে অনীহা, অস্বস্থি আর বিরক্তির ভাব নিয়ে যাত্রীদের সাথে কথা বলা শুরু।

কারো মুখে হাসি নেই। যেন তারা হাসতে জানে না। এটা যে সার্ভিস সেক্টর, এখানে হাসিমুখে সার্ভিস দেয়াই যে তাদের একমাত্র দায়িত্ব এদের কারো কোন কথায় তা মনে হয় না। মনে হয় তারা এখানে আছে আসামী ধরতে। কঠিন চেহারায় আমাদেরকে শুধু আটকাতে। পদে পদে আটকানোই তাদের কাজ। বিদেশ যাওয়া রুখে দিতে পারলেই যেন তাদের শান্তি হয়। তারা শুধু যাত্রীদের ভুল খোঁজে। ভুল শোধরানোর কোন পথ তারা খোঁজে না।

বিষয়টা শুধু এয়ারপোর্টে নয়। সবখানে; পুরো দেশে। আমাদের দেশে সার্ভিস সেক্টরের সব লোকেরা সার্ভিসে থাকাকালীন একটা কৃত্রিম মুডে থাকে। এমন মুডে থাকে যেন শুধু সে নয়, তার চৌদ্দগোষ্ঠীও জীবনে হেসে দেখেনি। অথচ রাস্তাঘাটে কিংবা পারিবারিক বা ব্যক্তি জীবনে থাকে হাহা হিহি মুডে। তখন স্বাভাবিক মানুষের মত আচরণ করে।

অপরদিকে বিদেশ কিংবা জাপান? ঠিক উল্টো চিত্র। ব্যক্তি জীবনে চুপচাপ পার্সোনালিটি সম্পন্ন মানুষ। কিন্তু সার্ভিসে একেবারেই ভিন্ন চেহারা। যেন তাদের মত সহজ, সরল, কোমল আর উপকারী কেউ হয় না। তাদের লক্ষ্য হয় না জনগণকে সমস্যায় ফেলা। বরং সারাক্ষণের একমাত্র লক্ষ্য হয় সার্ভিসের মাধ্যমে যাত্রী তথা জনগণের সমস্যার জট খুলে ফেলা।

আমাদের দেশে আমরা সবকিছুতেই যেন উল্টো। ক’দিন আগে বড়বড় দুটি ব্রীজ একসাথে উদ্বোধন হলো। একটা কালনা আর অন্যটা নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায়। প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরপরই ব্রীজ দেখতে মানুষের ঢল নামলো। মানুষের সে কী আনন্দ। তো শুধু আনন্দ থাকলেই তো হবে না, প্রকাশও করতে হবে। প্রকাশের নামে আনন্দের আতিশয্যে ব্রীজের উপর থেকে নীচে ঢিল ছোড়া শুরু হলো। একটা একটা নৌযান লক্ষ্য করে ঢিল। নৌযানে থাকা মানুষদের মাথা ফেটে একাকার।

প্রশ্ন হলো সদ্য খুলে দেয়া নতুন একটা সেতুতে এত ঢিল কোথা থেকে আসলো? নিশ্চয়ই আগেভাগে বুদ্ধি করে দশনার্থীদের দল সাথে করে নিয়ে এসেছিল। এটা হলো শীতলক্ষ্যা সেতুর কথা। আর পদ্মার কথা তো এখনও চোখে ভাসে। খুশীতে মানুষ উম্মাদ হয়ে উঠলো। শুরু হলো ব্যস্ত সেতুতে নেমে ছবি তোলার হিড়িক। কেউ ভিডিও করে, কেউ করে টিকটক। যত না পুরুষের দল করলো, মেয়েরা করলো তারচেয়েও বেশী। নামাজীর দলও জুটলো। তারা কাতার করে দাঁড়িয়ে গেল জামাত পড়ার জন্যে। এই পর্যন্ত যেমন তেমন। সেতুতে বসে কিংবা দাঁড়িয়ে হিশু করার লোকেরও অভাব ছিল না। এই না হলে আমরা বাঙালী!

বাঙালী বলেই হয়ত কথায় কথায় সব দোষ সরকারের উপর দেই। দেই পলিটিশিয়ানদের উপর। আমি নিজেও মনে করি এদেশের সরকারের দোষের সীমা পরিসীমা নেই। কিন্তু আমরা এই জনগণের দল কি বিনা দোষে আছি? আমরা কি দেশের আইন মানছি? সরকারের সব কথা কি শুনছি? শুনছি না। একদিকে নিজেরা আইন অমান্য করি। অন্যদিকে সারাক্ষণ হাজারো অন্যায় করেও মুখে ফেনা তুলে ফেলি সরকার এবং সরকারবিরোধী পলিটিশয়ানদের দোষত্রুটির কীর্তন করে। কিন্তু কেউই নিজের দোষ দেখি না। কেউ নিজের উপর অর্পিত দায়িত্বটি ঠিক মত পালন করিনা ।

স্বপ্রণোদিত হয়ে দায়িত্ব পালনের নমুনা দেখলাম এবার জাপানে পা দিয়েই। খুব ভোরের সকালে নারিতা এয়ারপোর্টে নেমেই দেখলাম জাপানের জনগণ কেবল সরকারী নির্দেশই যে যথাযথ ভাবে পালন করে তা নয়। উপরন্তু কখনো কখনো তার চেয়েও বেশী করে। সরকারের উপর নির্ভর না করে নির্ভর করে নিজের বুদ্ধি বিবেচনার উপর। করোনার তীব্রতা কমে আসায় অক্টোবর ১১ থেকে মাস্ক পড়ার বাধ্যবাধকতা জাপান সরকার তুলে নিয়েছিল। ভেবেছিলাম এয়ারপোর্টে এর নজির চোখে পড়বে। মাস্কবিহীন অন্তত কিছু লোক পাবো।

একজনকেও পাইনি। যেমনি এয়ারপোর্টে পাইনি, তেমনি পাইনি সারা জাপানের কোথায়ও। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, রেস্তোরা কিংবা অফিস আদালত। অথবা ট্রেন কিংবা বাস। গেল একমাসে কোথায়ও মাস্কবিহীন একজনকেও পাইনি। তারা প্রমাণ করেছে রাষ্ট্রের আইন মেনে চলাটা যেমনি নিজের ভেতর থেকে আসতে হয়, তেমনি সচেতনতা বোধও নিজের ভেতর থেকে আসতে হয়। এমনিতর শিক্ষিত অথচ সচেতন নাগরিকে দেশ ভরপুর থাকলে রাষ্ট্রের ভূমিকা কোন কোন ক্ষেত্রে গৌণ হয়ে যায়।

আমাদের এই বাংলায় দরকার ওদের মত সচেতন নাগরিকের। খুবই দরকার। সন্দেহ নেই এদেশে অনেক কিছুরই অভাব। তবে সবচেয়ে বড় অভাব এই সচেতন জনগোষ্ঠীর। দেশের নেতারা চাইলে আমাদেরকে এমন একটা জাতি উপহার দিতে পারতো। দুঃখজনক হলো কোনদিন তারা চায়ওনি, পারেওনি। জাতিকে সচেতন করবে কি? নিজেদেরই তো সচেতন হবার মুরোদ নেই। নিঃসন্দেহে তারা পুরোপুরি ব্যর্থ।

তারা না নিজেরা সচেতন হয়েছে, না পুরো জাতিকে সচেতন করতে পেরেছে। অথচ তারা চাইলে হাজার বছরের ঐতিহ্যমাখা সংগ্রামী বাঙালী জাতিকে সচেতন করে গড়ে তুলতে পারতো। পারতো অপরূপ রূপের বাংলাকে অপূর্ব মহিমায় সাজাতে। একটা সুশৃঙ্খলজাতি তথা রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে। তারা পারেনি। শত বছরেও পারবে বলে মনে হয় না।

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।