Home স্বাস্থ্য সংক্রমণ বাড়ছে, তবে হাসপাতালে রোগী কম

সংক্রমণ বাড়ছে, তবে হাসপাতালে রোগী কম

40

ডেস্ক রিপোর্ট: জ্বর, সর্দি, কাশি, শরীর ব্যথা—এমন উপসর্গ নিয়ে ১০০ জন মানুষ পরীক্ষা করালে ১৫ জনের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। অনেকে এসব উপসর্গকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে কম। শনাক্ত না হওয়া করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি ভাইরাসটি ছড়াতে ভূমিকা রাখছেন। এতে সংক্রমণ বাড়ছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা হলেও উদ্বেগ তৈরি করেছে।

অবশ্য এবার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম। দেশজুড়ে করোনা চিকিৎসার হাসপাতালগুলোতে বেশির ভাগ শয্যা খালি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত ১০ দিনে সারা দেশে ১৭ হাজার ৬০৮ জন নতুন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীসহ সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগী ভর্তি ছিলেন ৫২৫ জন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হাসপাতালে রোগী ভর্তি কম বলে পরিস্থিতি হালকাভাবে নেওয়া যাবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কারণ, করোনার ধরন অমিক্রনের নতুন যে উপধরন ছড়িয়ে পড়ছে, তা নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অমিক্রনের বিএ-৫ উপধরন এতটা পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যে এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বিজ্ঞানী মহল। সুতরাং মাস্কই এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত প্রতিরোধক।

৫১ জেলায় করোনা শনাক্ত
গতকাল দেশের ৫১টি জেলায় করোনা শনাক্তের তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সাত দিন পর পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদকে কেন্দ্র করে পশুরহাট, বাজারঘাট, গণপরিবহনে জনসমাগম বাড়বে। এতে সংক্রমণ আরও ছড়ানোর ঝুঁকি আছে।

সংক্রমণ শুধু বাংলাদেশে বাড়ছে এমন নয়। এটি এখন বৈশ্বিক প্রবণতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন সপ্তাহ ধরে সংক্রমণ বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। তালিকায় আছে ইউরোপ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আমেরিকা। তবে আফ্রিকা ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কমেছে। সংস্থাটি বলছে, যেসব অঞ্চলে সংক্রমণ বেড়েছে, সেসব জায়গায় মৃত্যুও বেড়েছে।

গুরুত্ব কম পাচ্ছে
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম করোনাভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়। এরপর বাংলাদেশসহ সমগ্র বিশ্ব দুই বছরের বেশি সময় ধরে মহামারি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কখনো সংক্রমণ বাড়ছে, কখনো কমছে।

এখন সাধারণ মানুষ অনেকেই ঘরের বাইরে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরছেন না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যাপারটিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। মাঝেমধ্যে সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোয়া অথবা হাতে জীবাণুনাশক ব্যবহারের যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, তা-ও এখন কমে গেছে।

অমিক্রনের বিএ–৫ উপধরন এতটা পৃথক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যে এর গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না বিজ্ঞানী মহল। সুতরাং মাস্কই এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত প্রতিরোধক।
মো. সায়েদুর রহমান, অধ্যাপক, বিএসএমএমইউ
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ মঙ্গলবার দোকান, শপিং মল, বাজার, হোটেল-রেস্টুরেন্টে সবাইকে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরাসহ ছয়টি নির্দেশনা দেয়। মাস্ক না পরলে শাস্তির মুখে পড়তে হবে বলেও সতর্ক করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে তেমন পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য বিভাগেও ঢিলেঢালা ভাব
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, স্বাস্থ্য বিভাগও পরিস্থিতিকে প্রয়োজনীয় গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারা একাধিক উদাহরণ তুলে ধরেছে। যেমন মহামারি পরিস্থিতি পর্যালোচনা ও করণীয় নির্ধারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও জনস্বাস্থ্যবিদদের নিয়ে একাধিক কমিটি গঠন করেছিল। একটি ছাড়া বাকি কমিটিগুলো এখন নিষ্ক্রিয়। সভা হয়েছে শুধু জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির (কোভিড-১৯)। এই কমিটি গত ১৪ জুন সভা করে ছয়টি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথা বলেছিল। এরপর ১৬ দিন পার হলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য বিভাগ।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি যেসব পরামর্শ দিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অন্য কমিটির সভাগুলো সশরীর উপস্থিত হয়ে করা সম্ভব না হলে ভার্চ্যুয়ালি করার চেষ্টা করতে হবে।

এদিকে সরকারি কিছু সেবা বন্ধও হয়েছে। বয়স বেশি, পরীক্ষায় সহায়তা করার জন্য বাড়তি লোক নেই—এমন দরিদ্র মানুষ নমুনা পরীক্ষার সুযোগ পেতেন আইইডিসিআরের কাছ থেকে। ফোন করলে আইইডিসিআরের কর্মীরা বাসায় গিয়ে নতুন নমুনা সংগ্রহ করতেন। খরচ ছিল ৩০০ টাকা। সেই সেবা গত ডিসেম্বর থেকে বন্ধ।

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সেবা আমরা দিতাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায়। সহায়তা বন্ধ হওয়ায় সেবাও বন্ধ।’

নতুন উপধরন নিয়ে উদ্বেগ
দেশে গত ৩০ মে থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত করোনায় কোনো মৃত্যু ছিল না। ২০ জুন একজনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই মৃত্যুর তথ্য দিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল দিয়েছে পাঁচজনের মৃত্যুর খবর।

নতুন উদ্বেগের কারণ হয়েছে করোনার ধরন অমিক্রনের উপধরন বিএ-৪ ও বিএ-৫। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিএ-৫-এর সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী বাড়ছে।

অণুজীববিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা প্রথম আলোকে বলেন, জিন বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অমিক্রনের উপধরন বিএ-৫-এর সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা অনেক বেশি। অর্থাৎ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এড়িয়ে মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষমতা আছে এই উপধরনের। সেঁজুতি সাহা দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ দলের নেতৃত্বে ছিলেন।

অন্যদিকে বিএসএমএমইউর অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টিকায় আপাতত এই ভাইরাস প্রতিরোধ করা সম্ভব হচ্ছে না—এটা প্রায় প্রতিষ্ঠিত সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সায়েদুর রহমান ও সেঁজুতি সাহা দুজনই জানিয়েছেন, অমিক্রন প্রতিহত করার জন্য নতুন টিকা উদ্ভাবনের কাজ করছেন টিকা বিজ্ঞানীরা।

টিকা, ওষুধ ও হাসপাতালের চিত্র
দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য বিভাগ সাফল্য দেখিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ জনসংখ্যার ৭০ দশমিক ৪ শতাংশকে পূর্ণ দুই ডোজ টিকা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে এগিয়ে বাংলাদেশ। এ ছাড়া বাংলাদেশ করোনার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অনুমোদিত ওষুধ ব্যবহার ও উৎপাদনের অনুমোদন দিয়েছে।

হাসপাতালে যে শয্যা খালি, সে তথ্য জানা যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব থেকে। অধিদপ্তর বলছে, সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ১২ হাজার ৫৮৩টি সাধারণ শয্যা ও ১ হাজার ১১৪টি আইসিইউ শয্যা খালি আছে। এ ছাড়া করোনা এইচডিইউ শয্যা খালি আছে ৬৫০টি।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন মুখপাত্রকে একাধিকবার ফোন করে সাড়া পাওয়া যায়নি। ফোন ধরেননি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমও। তবে গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে তিনি বলেছিলেন, হাসপাতাল তৈরি আছে। অক্সিজেন সরবরাহের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে।

পরীক্ষা ‘বাড়ানো’ দরকার
দেশে এখন মোট ৮৮০টি কেন্দ্রে করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়। তবে জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে যত কথা শোনা যাচ্ছে, সেই তুলনায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম। গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় ১২ হাজার ৪০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করানো হয়। এতে শনাক্ত হন ১ হাজার ৮৯৭ জন।

সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘করোনার পরীক্ষা বাড়াতে হবে। মানুষ যেন পরীক্ষা করাতে উদ্বুদ্ধ হন, সে জন্য প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে। পরীক্ষার ফলাফল পর্যালোচনা করতে হবে। তা হলে আমরা রোগের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারব।’
প্রথম আলো