Home জাতীয় সংকুচিত হচ্ছে খেলার মাঠ, ব্যাহত মানসিক বিকাশ

সংকুচিত হচ্ছে খেলার মাঠ, ব্যাহত মানসিক বিকাশ

38

ডেস্ক রিপোর্ট: শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দরকার খেলাধুলা। আর খেলাধুলার জন্য দরকার পর্যাপ্ত খেলার মাঠ। কিন্তু রাজধানীতে দিন দিন খেলার মাঠসহ বিনোদনের জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেক এলাকায় মাঠ ও পার্ক থাকার কথা সেখানে তা পর্যাপ্ত নেই। আবার যা আছে তা দখল হয়ে যাচ্ছে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড রয়েছে ১২৯টি। কিন্তু তাদের আওতাধীন খেলার মাঠ রয়েছে মাত্র ২০টি। এর মধ্যে উত্তর সিটির রয়েছে আটটি আর দক্ষিণের রয়েছে মাত্র ১২টি। এর মধ্যেও শিশু- কিশোরদের জন্য উন্মুক্ত নেই সব খেলার মাঠ। কিছু জায়গায় তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন আবার কিছু জায়গায় উন্নয়নের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে মাঠ।

নগরবিদরা বলছেন, রাজধানীতে মাঠের সংখ্যা কমার অন্যতম কারণ হচ্ছে, অভিভাবকত্ব ও তদারকির অভাব। অন্যান্য দেশে যেমন মাঠ তদারকির জন্য আলাদা কর্তৃপক্ষ রয়েছে কিন্তু আমাদের দেশে মাঠ তদারকির জন্য একক কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ধূপখোলা মাঠে চলছে মার্কেট নির্মাণের কাজ, যার কারণে নির্মাণসামগ্রী মাঠের মধ্যে রাখা হয়েছে। মাঠের একপাশে বহুতল ভবন নির্মাণকাজের কারণে মাঠের আয়তন কমে গেছে।

আগে বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর এখানে খেলাধুলা করতে পারত সেটি এখন কমে গেছে। সেখানকার স্হানীয় এক বাসিন্দা জানান, বহু বছর ধরে খেলাধুলার জন্য এ মাঠ ব্যবহার হয়ে আসছে, কিন্তু এখন সেই চিরাচরিত রূপ হারাচ্ছে মাঠটি। এমন ঐতিহ্যবাহী মাঠের এ অবস্হা দেখে আসলেই খারাপ লাগছে।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ১২টি মাঠ রয়েছে। এগুলো হলো :বাংলাদেশ মাঠ, গোলাপবাগ মাঠ, মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মাঠ, লালবাগ শ্মশানঘাট খেলার মাঠ, খিলগাঁও খেলার মাঠ, ধানমন্ডি খেলার মাঠ, কলাবাগান খেলার মাঠ, মরহুম হাজি আলী ঈদগাহ মাঠ, বালুর মাঠ ঈদগাহ মাঠ, আরমানিটোলা খেলার মাঠ, ধূপখোলা মাঠ ও জোড়াপুকুর খেলার মাঠ।

অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মাঠ হলো আটটি। এগুলো হলো :বনানী মাঠ, বনানী খেলার মাঠ, বড় মগবাজার খেলার মাঠ, গোলার টেক মাঠ, তাজমহল রোড মাঠ, জাকির হোসেন রোড খেলার মাঠ, সলিমুল্লাহ রোড খেলার মাঠ ও বৈশাখী খেলার মাঠ। এর মধ্যে বড় মগবাজার মধুবাগ মাঠটি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে উন্নয়ন কাজের জন্য।

স্হানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রায় বছরখানেক ধরে মাঠটি টিন দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। সিটি করপোরেশন আধুনিকায়ন করবে বলে এটি বন্ধ করে রেখেছে। মাঠটির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের ভেতর চারপাশে ওয়াকওয়ের কাজ চলছে। পানি নিষ্কাষণের জন্য ড্রেনের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র। এছাড়া পুরো মাঠে নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে এলোমেলোভাবে।

কবে নাগাদ কাজ শেষ হতে পারে এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মতিউর রহমান রোলেন বলেন, কবে নাগাদ শেষ হবে বলা যাচ্ছে না। তবে কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। এখানকার ষাটোর্ধ্ব এক বাসিন্দা জানান, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করত। এখানে খেলাধুলার জন্য মাঠটি উন্মুক্ত থাকত। কবে উন্নয়ন শেষ হবে আর কবে এটি খুলে দেওয়া হবে তা তো কাজের গতি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

ইতিহাস বলছে, মাঠ রক্ষা করতে বহু আগে থেকেই তরুণ প্রজন্মকে সোচ্চার হতে হয়েছে। বর্তমান আবাহনী মাঠের সৃষ্টি হয় এমনি এক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে। ধানমন্ডির ২২ নম্বর সড়কের পার্শ্ববর্তী খেলার মাঠটি (বর্তমান আবাহনী মাঠ) তত্কালীন পাকিস্তান সরকার গোপনে মূল নকশা ও পরিকল্পনায় বাসস্হানের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি শেখ কামাল। তার নেতৃত্বে তরুণরা প্রতিবাদ শুরু করে এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলেন। পরে শেখ কামালের জোরালো ভূমিকার কারণে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কাছে শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। রক্ষা পেয়ে যাওয়া সেদিনের খেলার মাঠটি আজকের আবাহনী মাঠ হিসেবে পরিচিত।

মগবাজার মধুবাগ মাঠের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) খেলার মাঠ-পার্ক উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, এ বছরের জুনের দিকে আমরা মাঠটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেব। উন্নয়ন কাজের জন্য সাময়িকভাবে এটি বন্ধ রাখা হয়েছে।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের কাজ হচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মাঠ বৃদ্ধি করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। তবে সিটি করপোরেশনের বাইরেও যেসব সংস্হার মাঠ রয়েছে সেগুলোও সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করলে সিটি করপোরেশন তার আধুনিকায়নে কাজ করবে ও তা যেন দখল না হয়ে যায় সেটি দেখবে।

ধূপখোলা মাঠে মার্কেট নির্মাণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন কখনো মাঠ দখল করে মার্কেট নির্মাণ করছে না বরং মাঠ যেন সড়ক থেকে দেখা যায়, খোলামেলা থাকে। তাই মাঠের পাশের দোকানগুলোকে পুনর্বাসন করার জন্য মাঠের এক কোনায় একটি মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। আর মাঠের মধ্যে আধুনিকায়ন করে ফুটবল ও ক্রিকেট যেন একত্রে খেলা যায় সে ব্যবস্হা করা হচ্ছে। উন্নয়ন কাজ চলায় খেলাতে হয়তো কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে। অচিরেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) ঢাকার মাঠ নিয়ে ২০১৯ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে দেখা যায়, ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি মাঠের সংখ্যা প্রায় ২৩৫টি। এর মধ্যে ১৪০টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ, যেগুলো সবাই ব্যবহার করতে পারে না। কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি। ১৬টি সরকারি মাঠ বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। এর বাইরে মাত্র ৪২টি মাঠ আছে, যেগুলো সবাই ব্যবহার করতে পারে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক নগরপরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকায় বর্তমানে সরকারিভাবে যে মাঠ রয়েছে সেটি তিনটি সংস্হার। এর মধ্যে যেহেতু সিটি করপোরেশন জনপ্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত সেহেতু মাঠ তদারকির ক্ষেত্রে তাদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকার খালের মতো খেলার মাঠ ও পার্কগুলোও সিটি করপোরেশনের অধীনে দিতে হবে। আর পাড়ামহল্লায় তা তদারকির জন্য কমিটি করে দিতে হবে।
সঠিক তদারকির অভাবে সরকারি ও বেসরকারি মাঠগুলোতে বিভিন্ন স্হাপনা উঠে সেগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। অনেকে মাঠকেন্দ্রিক ক্লাব করেও মাঠ বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করে। এটি থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, আমাদের সমাজ অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক ও মুনাফাকেন্দ্রিক হওয়ার কারণে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠগুলো দখল হয়ে যাচ্ছে। মাঠগুলো ভিন্ন উদ্দেশ্য ব্যবহার করা হচ্ছে।

আগে যেখানে শিশু-কিশোররা আড্ডা দিত, তাদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতো সে জায়গাগুলো কমে যাওয়ায় শিশুরা অনেকটা ঘরকুনো হয়ে উঠেছে। তাদের স্মার্টফোনে আসক্তি বেড়েছে, বিভিন্ন অপরাধে জড়িত হয়ে পড়ছে। যার প্রভাব পড়ছে সমাজে ও ভবিষ্যত্ প্রজন্মের বেড়ে ওঠায়। সরকারের উচিত হবে, এ সব মাঠ উদ্ধার করে শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা।-ইত্তেফাক