Home মতামত রাজহংসী

রাজহংসী

71

অনুপমা চক্রবর্তী: মকর সংক্রান্তি হচ্ছে পৌষের সমাপ্তি আর মাঘের আবাহন। এই কনকনে শীতে প্রতি বছর প্রতীক্ষার ঘন্টা বাজিয়ে সার্বজনীন উৎসব দেবী সরস্বতীর অর্চনায় সমবেত হয় নানা ধর্মাবলম্বীর শত শত মানুষ; প্রত্যেকের প্রত্যাশা পার্থিব জ্ঞান আহরণের এ মূর্ত প্রতীক মনুষ্যকূলে শ্বেতশুভ্রতা ছড়িয়ে দিবে, তাঁর প্রতিকী বিভিন্ন চিহ্ন ধরনীর মানসলোকে অজ্ঞানতা দূর করে জ্ঞানের দুত্যি ছড়িয়ে যাবে অন্ধকারমুক্ত অধ্যায়ের পরিসমাপ্তিতে। জীবন হবে গতিময়, পরম প্রশান্তির; আর তাইতো সরস্বতী দেবী হয়ে উঠেন আলোকিত জীবনময়তার প্রতীক; শুভ্রবর্ণ শুচিতা, শুভ্রতা, শুদ্ধতা ও পবিত্রতার প্রতীক।

মাঘ মাসের শুক্ল পক্ষের শ্রী পঞ্চমী তিথিতে হিন্দুধর্মের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দেবীর আরাধনা সমগ্র জাতির কাছে অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বিদ্যার এ দেবী জ্ঞান ও কলার প্রতীক হিসেবে সকলের কাছে পূজিত, বন্দিত ও চর্চিত। জ্ঞান সদা উদার ও উন্মুক্ত যেখানে কোন সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে না; যে দেশ ও জাতি যত বেশি শিক্ষিত হবে, হবে তত বেশি উন্নত। সুতরাং, উন্নয়নের লক্ষ্যে
জ্ঞানের বিকল্প বলে কিছু নেই। বিদ্যা নামক এই অধ্যাখ্যাত শব্দের প্রতীক সরস্বতীর সামগ্রিক রূপ এক একেকটি বিশেষতা নিয়ে সমৃদ্ধঃ যেখানে মনুষ্যজাতি সকল কুসংস্কারাচ্ছন্ন থেকে মুক্ত হয়ে সন্ধান খুঁজে পায় প্রকৃত সংস্কৃতি কিংবা সুশিক্ষার।

সাধকদের মতে শ্বেত পদ্মের উপর উপবিষ্টা দেবীর দেহে ছয়টি পদ আছেঃ (১) বিশুদ্ধ পদে আরোহন করলে সারহৃত জ্ঞান লাভ হয়, (২) পদ্মাসীনা বলতে দেহ প্রাণবায়ুকে উত্তোলন করার কৌশল নির্দেশ করা হয়েছে, (৩) শুভ্রবর্ণ আমাদের মনকে শুচি, শুভ্র ও শুদ্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছে কারণ মনশুদ্ধি না হলে চিত্তশুদ্ধি হয় না আর চিত্রশুদ্ধি ছাড়া জ্ঞান লাভ অসম্ভব, (৪) হংসবাহনার মাধ্যমে এই নির্দেশ প্রকাশিত হয় যে সার ও অসার মিশ্রিত এ বিশ্বসংসারে মানুষ যেন সারবস্তু গ্রহন করে, (৫) দেবীর হাতের পুস্তিকা জ্ঞানচর্চার প্রতীকরূপে প্রকাশ করেন সব যোগের পরিপক্ক ফল অর্থাৎ সংযতেন্দ্রিয় ও তৎপর হয়ে তত্ত্ব জ্ঞানে শ্রদ্ধাবান ব্যক্তির দ্বারাই কেবল এ জ্ঞানলাভ করা সম্ভব এবং (৬) হস্তবীণায় বাঁধা আছে সা-রে-গা-মা-পা-খা-নি এই সপ্তম্বর যেখানে প্রথম দুটি বর্ণ ‘স’ এবং ‘র’ যোগে দেবীর নামের আদ্যাক্ষর সূচিত হয়, ‘গ’ এবং ‘ম’ যোগে ঊর্ধ্ব গমন করা, ‘প’ পবিত্রতার পরিচয় বহন করে, “থ” অর্থে ধারণ এবং ন’ অর্থে আনন্দকে বোঝানো হয় অর্থাৎ সুরের লহরি বা এ সঙ্গীতবিদ্যা মানুষকে বিমোহিত করে প্রাণে আনন্দের সঞ্চার ঘটিয়ে।
এসব পরিপূর্ণতার কারণে সম্প্রদায়গত সকল ব্যবধান এড়িয়ে রাজহংসীর আরাধনায় বিশেষ সামাজিক গুরুত্ব বহন করে আসছে আবহমান
বাংলা। এ যেন মহা মিলনমেলা, সংহতি ও সম্প্রীতির অতুলনীয় সৌন্দর্য।

উল্লেখ্য যে, পুরাণে সরস্বতীর সহচরী হিসেবে ময়ূরের সংযোগও পাওয়া যায় তবে রাজহংসের ব্যাপারটি যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। শ্বেতশুভ্র হাঁসের সামনে যদি একটি পাত্রে জলের সাথে দুধ বা ক্ষীর মিশিয়ে রাখা যায় তাহলে সে নাকি মিশ্রণ থেকে দুধ বা ক্ষীরটুকু শুষে পান করবে আর পাত্রে পড়ে থাকবে শুধু জল: রাজহংসের এই বুদ্ধিমত্তা জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যা দেবী আদর্শের একটা
বিশেষ দিক নির্দেশ করে। আরো লক্ষণীয় যে, হাঁস জলে ভেসে বেড়ায় অথচ তার পাখনা জলে ভেজে না; জল লাগলেও ঝেড়ে ফেলে দেয় রাজহাঁস- বিদ্যা অর্জনের পদ্ধতিটিও একই।

মানুষ যত জ্ঞান অর্জন করবে তত আসক্তিমুক্ত হবে আর এ কারণেই বিশুদ্ধ জ্ঞানের বাহন বলে সরস্বতীকে রাজহংসী বলা হয়ে থাকে। শীতের অবসন্নতা কাঁটিয়ে প্রকৃতিকে ইঙ্গিত দেয় বসন্তের রাজত্বে বসন্ত পঞ্চমী; সর্ব সাধারণের কাছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেবী হয়ে আসেন প্রত্যাশা ও শান্তির আলো। আশায় নব জাগরণ ঘটে, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দ্বারা তাঁর আশীর্বাদ সবসময় বজায় থাকবে আমাদের এই মনুষ্যকুলে- “শুভ সরস্বতী পূজা”।

-লেখক : কবি ও সরকারি কর্মকর্তা।