Home রাজনীতি রাজনীতির মঞ্চে উঠতে পারলে কী কী হয়

রাজনীতির মঞ্চে উঠতে পারলে কী কী হয়

48

ডেস্ক রিপাের্ট: মঞ্চে উঠে একবার চেহারা দেখাতে পারলে এলাকায় সালাম বা সম্মান তেমন হয়তো জোটে না সত্য; কিন্তু ফেসবুকে কিছু লাইক বা শেয়ার পাওয়া যায়। আবার মঞ্চে দেখানো ‘চেহারা’ নানাভাবে কাজে লাগানোরও সুযোগ হয়। সরকারি দপ্তরসহ বিভিন্ন জায়গায় নিজের পরিচয় যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারলে এলাকাভিত্তিক নানা ‘বাণিজ্যের’ ভাগ আসা নিশ্চিত হয়। তবে মঞ্চে ওঠার জন্য সবার আগে দরকার নেতা হওয়া।

এখন আর কর্মী পরিচয়ে মঞ্চে ওঠার সুযোগ হয় না। একটা ‘পদ–পদবি’ না থাকলে এ যুগে মঞ্চের কাছাকাছিও ঘেঁষা যায় না। এ রকম কঠিন একটা পরিস্থিতিতে মঞ্চে ওঠার জায়গা করে দিতে দলের বা সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে লোক বাড়াতে হয়, নতুন পদ বানাতে হয়। এতেও কাজ না হলে বিচিত্র নামে সংগঠন গড়ে তুলে (ফেসবুকে, পোস্টারে, সাইনবোর্ডে, কখনো শুধু ভিজিটিং কার্ডে) নেতা হিসেবে নিজের নাম–ছবি প্রচার করতে হয়—এই নীতি এখন প্রতিষ্ঠিত।
সব সময় দর্শকের চোখ থাকে মঞ্চে, তাই মঞ্চে ওঠার সুপ্ত বাসনা কারও মধ্যে থাকলে সেটি কিছুতেই ‘দোষ’ হতে পারে না। আর মঞ্চে (তা যে মঞ্চই হোক) উঠলেই যে কিছু একটা ‘করে দেখাতে’ হবে, বিষয়টি এখন আর এমনও নয়। এই সেলফির যুগে কিছুক্ষণের জন্য মঞ্চে ওঠাও একটা ‘ইজ্জতের’ ব্যাপার হয়ে গেছে। আর সেই মঞ্চ যদি ক্ষমতাবানদের হয়, সামনে অসংখ্য ক্যামেরা থাকে, সেখানে উঠতে না পারলে অনেকের রাজনৈতিক ‘ক্যারিয়ার’ ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। এর ফল হচ্ছে, নেতার ভিড়ে মঞ্চে এখন পা রাখারও জায়গা থাকে না।
কর্মীর সংখ্যা কমে দলে নেতার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় কয়েক বছর ধরেই প্রকাশ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজের ক্ষোভের কথা বলে আসছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ২০১৩ সালের জুন মাসে নোয়াখালীর সেনবাগে এক অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে তিনি বলেছিলেন, ‘খেতের ফসল মার খেলেও নেতার বাম্পার ফলন। এরা হাইব্রিড নেতা। এসব হাইব্রিড নেতার ডিজিটাল চেহারায় বাংলাদেশের সবুজ মাঠ, ফসল, নদী, পাহাড় দেখা যায় না। এই ডিজিটাল ও হাইব্রিড নেতাদের চেহারা দেখে মানুষ বিরক্ত।’
নেতার সংখ্যা নিয়ে ওবায়দুল কাদেরের এই বিরক্তি দেখা গেছে গত ১০ ডিসেম্বরও। সেদিন ঢাকার সাভারে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আজ এই সমাবেশমঞ্চ থেকে তাকিয়ে দেখছি, নেতা আর নেতা। সিকি নেতা, আধুলি নেতা, পাতি নেতা—সব নেতা। কর্মী কোথায়?’

নিজ দলের মতো ছাত্রলীগেও নেতার ভিড় দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ওবায়দুল কাদের। গত ২ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের সম্মেলনে মঞ্চে নেতাদের ভিড় দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘সব নেতা (ছাত্রলীগে)? কর্মী কোথায়? এত নেতা স্টেজে (মঞ্চে), কর্মী কোথায়? এই ছাত্রলীগ চাই না।’
১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন ছাত্রলীগেও পদ পাওয়া কতটা আকাঙ্ক্ষিত, সেটি বোঝা যায় গত ৬ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পরও। এক যুগ পর গত ৫ অক্টোবর ওই কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত পদ না পেয়ে দুধ দিয়ে গোসল করে (৬ অক্টোবর) রাজনীতি থেকে ‘বিদায়’ নেওয়ার ঘোষণা দেন ছাত্রলীগের এক নেতা। দুধ দিয়ে গোসল করার ভিডিও নিজের ফেসবুক আইডিতেও পোস্ট করেন সেই নেতা। পরে সেটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। মো. আরমিন নামের ওই নেতাকে কমিটিতে ১ নম্বর সহসভাপতি করা হয়েছিল, যেটি তাঁর মনঃপূত হয়নি।
গত নভেম্বর মাসেই বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর তা প্রত্যাখ্যান করে সংগঠনের কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছেন পদবঞ্চিত নেতারা। তাঁদের অভিযোগ ছিল, টাকার বিনিময়ে বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়ে কমিটি করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে পাল্টাপাল্টি হামলা, সংঘর্ষ, সড়ক অবরোধের ঘটনাও নতুন কিছু নয়। ‘নেতা–বাণিজ্য’ এখন বাস্তবতা, এটি নিয়ে লুকোছাপার কিছু নেই—বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরাই প্রকাশ্যে এসব কথা বলেছেন।

ছাত্রলীগের যেকোনো কমিটিতে পদ পেলে ক্ষমতার দাপট দেখানোর পাশাপাশি নানা জায়গা থেকে নানা কিছুর ভাগ বা সুবিধা পাওয়া যায়—এটিও এখন আর কেউ অস্বীকার করেন না। চাঁদাবাজির অভিযোগ ওঠার পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোয় নেতা হওয়ার হিড়িকের পেছনে কী, সেটি আকার–ইঙ্গিতে বলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর খিলগাঁওয়ে দলের এক অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে—এটা বিএনপির হতে পারে, আওয়ামী লীগ এ চর্চা করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন—এ চর্চা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।’
টাকা দিয়েই হোক আর টাকা ছাড়াই হোক, নেতার সংখ্যা বেশি হলে সেটি দল বা সংগঠনের জন্য কী পরিণতি নিয়ে আসে, তার খানিকটা দেখা গেছে ৬ জানুয়ারি ছাত্রলীগের ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। মঞ্চে নেতাদের ভিড়ে অনুষ্ঠান চলার সময়ই হঠাৎ ভেঙে পড়ে মঞ্চ। তখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন ওবায়দুল কাদের। মঞ্চ ভেঙে অন্তত ১০ জন আহত হন।

ভাঙা মঞ্চেই পরে বক্তব্য দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। তখন তিনি বলছিলেন, ‘যেকোনো অনুষ্ঠানে গেলে সামনের লোকের চেয়ে মঞ্চে লোক বেশি। এত নেতা কেন? নেতা উৎপাদনের এত বড় কারখানা আমাদের দরকার নেই। ছাত্রলীগ হোক কর্মী উৎপাদনের কারখানা। ঠিক আছে?’
প্রথমআলো