Home মতামত মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের পথ!

মৃত্যু মাত্র কয়েক মিনিটের পথ!

71

সরদার মোঃ শাহীন:

গ্রামের একেবারে পাশ ঘেঁষে থাকা বিভাগীয় শহরের হোটেলে ফিরে এসেছি সন্ধ্যা নামার অনেক পরে। দালানকোঠা কিংবা রাস্তাঘাট দেখলে কারোরই বোঝার উপায় নেই, শহরটি রাজধানী শহর নয়, মফস্বল। রাস্তায় প্রচুর গাড়ি চলাচল। বাস-ট্রাক তো আছেই। যদিও রিক্সার আধিক্য এখনো বেশি। তবে যে যাই বলুক, গেল ক’বছরে আসলেই দেশ অনেক বদলেছে। দশ-পনের বছর আগেও সন্ধ্যা নামলে এসব শহরের আশেপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যেত।
এখন শোনা যায় না। এখন শহর আলো ঝলমল। আলো ঝলমল হোটেলটিও। আগেও থেকেছি হোটেলটিতে। মন্দ নয়। বোর্ডারদের ভাল সেবা দেয়ার চেষ্টা করে। ডিজাইন ডেকোরেশনও মানসম্মত। আগে যখন এসেছি মনে তখন একটা ফুরফুরা আমেজ থাকতো। আজ মোটেও তেমনটা নেই। শাশুড়ি মাকে কবরে শুইয়ে রেখে তেমনটা থাকার কথাও না। মায়ের মুখখানা বারবার ভাসছে চোখে। কবরের মাটিতে সাদা কাফনে ঢাকা মুখখানি। বন্ধ থাকা দু’চোখে কোথায় যেন সামান্য একটু মুচকি হাসির ঝলক।

যেন বলছেন, এখানে ভাল লাগছে বাবা! ভালই থাকবো! তোমরা ভাল থেকো! এসব ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি ঠিক মনে নেই। কয়েক দিনের প্রচন্ড ক্লান্তিতে এমনিতেও দেহমন খুব দুর্বল ছিল। একটা বড় ধকল শরীর এবং মনের উপর দিয়ে বেশ ভালভাবেই গেছে। খাওয়া দাওয়া কিংবা ঘুম; কোনটিই ঠিকমত হয়নি। বলা যায়, দিন এবং রাত্রির পার্থক্যটাও বুঝতে পারিনি গেল ক’দিনে।
অসুস্থ শোনিমের আম্মুকে নিয়েও মহা টেনশানে আছি। শরীরটা তার খুবই খারাপ যাচ্ছে ক’দিন থেকেই। খারাপ মানে, বেপরোয়া রকমের খারাপ। প্রেসারটা এত বেশি ওঠানামা করছে যে বারবার মেপে মেপে দেখতে হয়। তার ঘুম দরকার। অথচ ঘুমের ঔষধ দেয়া যাবে না। তাই রুমে নার্সিং এর জন্যে সিষ্টার ঊষাকে রাখা হয়েছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে রেখে আমি এসেছি পাশের রুমে ডক্টর মনিরকে নিয়ে।
ভোরের দিকে ঘুম ভাঙায় মিটিমিটি চোখে তাকালাম। ডক্টর মনিরকে বিছানার পাশে নামাজ পড়তে দেখে বুঝলাম ফজরের সময় হয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর মনির আমার বন্ধু। খুবই ঘনিষ্ঠ জন। কষ্ট এবং বিপদের দিনে আমার পাশেই থাকেন। এবারও আমাকে ঢাকা থেকে একা ছাড়েননি। সঙ্গে চলে এসেছেন। তাকে নামাজরত দেখে আড়মোড়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গেলাম ফজরের প্রস্তুতি নিতে। সমস্যাটার শুরু ঠিক তখন থেকে। ঘুমের ঘোরে বার বার চেষ্টার পরও নাকে আটকে থাকা ময়লা বের হচ্ছিল না। গলায় আটকে গিয়েছিল।
ভীষণ বিপদে পড়ে গেলাম। অনেক চেষ্টার পরে আটকে পড়া ময়লা ছোটাতে না পেরে বাথরুমের বাইরে এসে বন্ধুর সাহায্য নিলাম। কিছুতেই কিছু হলো না। আস্তে আস্তে ময়লায় গলা আরো আটকে আসলো। বাঁচার জন্যে প্রবল আকুতি করছি আমি। দৌঁড়ে পাশের রুমে শোনিমের মায়ের কাছে গেলাম। ওখানে নাকের ড্রপ রাখা আছে। নাকের ড্রপও দিলাম। ফলাফল শূন্য। এদিকে দম প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট শুরু হয়েছে। গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। নাক দিয়েও শ্বাস নিতে পারছি না। অগত্যা বন্ধু মনিরের গায়ে হেলে পরে বললাম, সেইভ মি প্লিজ! সেইভ মি!
হোটেলের ঠিক সামনেই শহরের সবচেয়ে বড় প্রাইভেট হাসপাতাল। অন্তত বাহিরের ডিজাইন ডেকোরেশন তাই বলে। হোটেল কর্তৃপক্ষও তাই বললো। দেরি না করে বন্ধু মনির আমাকে নিয়ে দৌঁড়ে কোনভাবে রাস্তা পার হয়ে ঐ হাসপাতালেই পৌঁছলো। ভোরের আলো ফুটতে তখনও ঢের বাকী। রাতের আফছা অন্ধকার তখনও কাটেনি। হাসপাতালের নিচতলায় আধা ভেড়ানো দরজায় একজনকে পাওয়া গেল। আমাকে দেখে তার কোন মায়া হলো না। দয়াও হলো না। অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের কোন ইমার্জেন্সি নাই। তয়, ডাক্তার আছে। ৭ তলায় গেলে পাইবেন।
শোনিমের মা অনুরোধ জানিয়ে বললো, মানুষটাকে একটু বাঁচান। দয়া করে একটু অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেন, প্লিজ। দয়া পেল না বেচারার। উদাস ভঙিতে মাথা নীচু করেই জানালো, এহানে অক্সিজেন নাই। দিমু কেমনে! অগত্যা লিফট বেয়ে ৭ তলায় গেলাম। বন্ধ দরজায় ধাক্কাধাক্কির পর ডাক্তার বেরোলো বটে। কিন্তু আমার অবস্থা দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। আমতা আমতা করে বললো, আমার কাছে ওনাকে চিকিৎসা দেবার মত কিছু নেই। আমি ইমার্জেন্সি ডাক্তার নই। ডিউটি ডাক্তার। ইন্টার্নী করছি। এই হাসপাতালে ইমার্জেন্সি ইউনিটই নেই। আর টুকটাক যা কিছু আছে তা তালাবদ্ধ করে ম্যানেজার বাসায় চলে গেছেন। আমার নিজের জ্ঞান খুবই সীমিত। আমাকে মাফ করবেন।
সব শুনে আমার জানটুকু এখন যাবার পালা। আর পারছি না। অগত্যা বেঞ্চেই শুয়ে পড়ে নাক দিয়ে বাতাস নিয়ে টেনে টেনে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি। যতই করছি গলা ততই বন্ধ হয়ে আসছে। আটকে পড়া ময়লা ততই যেন শক্ত হয়ে বাসা বাঁধছে। নিরুপায় হয়ে হেল্প মি, হেল্প মি বলে চিৎকার শুরু করেছি। কিন্তু আমার কথা পরিষ্কার বের হচ্ছে না। কেউ বুঝতেও পারছে না। উপায়হীন হয়ে বড় অসহায়ের মত আল্লাহকে ডেকে ডেকে কলেমা পড়া শুরু করলাম।
আমার এমনি কষ্ট দেখে অসহায় শোনিমের আম্মু পাগলের মত হয়ে উঠলো। নিরুপায় বন্ধু মনিরও সহায়হীন হয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে। একে ওকে অনুরোধ করছে। বিভাগীয় শহরের সবচেয়ে বড় বেসরকারি হাসপাতালে শুধু একটু অক্সিজেনের জন্যে কাকুতি মিনতি করছে ঢাকার একটি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতাকে বাঁচানোর জন্যে। সেই হাসপাতালটি ততটা বড় মাপের নয় বটে। কিন্তু বড় মানের। মোটামুটি অনেক কিছুতেই সমৃদ্ধ। অনেক সেবাই বিদ্যমান।
৭ তলায় সামান্যতম মেডিকেল সার্ভিস পেতে ব্যর্থ হয়ে কোনমতে ধরে আমাকে নিচে নামিয়ে ওদের এম্বুলেন্সটি চাইলো যেন শহরের মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালটিতে সহজেই পৌঁছতে পারি। এম্বুলেন্স ড্রাইভার বাসায় থাকায় ওটাও জুটলো না। ইতিমধ্যেই শোনিমও হাসপাতালে ছুটে এসেছে ওর মামী এবং সঞ্জীবকে নিয়ে। সঞ্জীব এর চেষ্টায় একটা সিএনজি জুটলো। কিন্তু লোক বেশি হওয়ায় ওটাতে আমার শোনিমের জায়গা হলো না। অবশেষে তাপিতা এবং ঊষার কাছে ওকে রেখেই আমাকে নিয়ে ছুটলো সিএনজি।
সিএনজি যাচ্ছে আর সিএনজির পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে শোনিম। একেবারেই চেনা জানাহীন এই শহরে ছেলে আমার দৌঁড়াচ্ছে আমারই গাড়ির পিছু পিছু। গাড়ির স্পীডের সাথে পাল্লা দিয়ে শোনিম যে কিছুতেই পারবে না, সেটা জেনেও দৌঁড়াচ্ছে। এতদিন যে ছেলেটিকে বিশ্বাস করে কারো কাছে রেখে কোথায়ও যায়নি, আজ সেই ছেলেকেই অচেনা শহরের রাজপথে রেখে ওর মা আমাকে নিয়ে ছুটছে। বড় পাষন্ড আর স্বার্থপরের মত ছুটছে।
গেল সন্ধ্যায় নিজ মাকে কবরে শুইয়ে শোনিমের আম্মু কেবল প্রথম বিনিদ্র রজনীটুকু পার করেছে। আর ভোরেই দৌঁড়াচ্ছে প্রায় মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে। সিএনজিতে শোনিমের আব্বুকে শক্ত করে ধরে বসে আছে সে। পেছনে দৌঁড়াচ্ছে একমাত্র সন্তান। প্রাণের চেয়ে প্রিয় সন্তানের দিকে তাকাবার সময়ও তার নেই। সন্তানের বাবাকে বাঁচাতে হবে। যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে।
এদিকে পথ আর শেষ হয় না। যেন কোনকালেও শেষ হবার নয়। সিএনজি তার নিজস্ব গতিতেই চলছে কিন্তু পথ শেষ হচ্ছে না। খুবই চিন্তিত চোখে পথের দিকে চেয়ে চেয়ে সেই পথেরই শেষ হওয়া দেখতে চাইছে বেচারী। অথচ হচ্ছে না। সিএনজি থেকে মাথা ঘুরিয়ে কেবলই দেখার চেষ্টা করছে দূর হতে হলেও অন্তত হাসপাতালের ভবনগুলো দেখা যায় কি না! না, সেসবও দেখা যায় না!! জলেভেজা ঝাপসা চোখে কিচ্ছু দেখা যায় না!!! চলবে….