Home মতামত মানুষ, হুর ও গেলমান

মানুষ, হুর ও গেলমান

115

জিয়াউল হক মুক্তা:

এক.
শুক্রবার দুপুর। সপরিবারে খেতে বসেছেন রউফ। টেবিলের তিন পাশে তিন জন। তার মুখোমুখি বসেছেন স্ত্রী মিতু আর পাশে ছেলে রাফি, ওর বয়স ছয় বছর। এটাসেটা বলতে বলতে তারা খাচ্ছেন।

আজ জুম্মার পর মুসুল্লিগণ একটা প্রস্তাব দিলেন, রউফ বললেন। সেটা কী তা ছেলের এলোমেলো খাবার গুছিয়ে দিতে দিতে জানতে চাইলেন মিতু।

— আমাকে মসজিদ কমিটির সভাপতি হতে বলছেন।
— অবৈধ ভূমি দখলের মসজিদের?
— ওভাবে বোলো না। লোকজন নামাজ পড়ছেন, বাচ্চারা আরবি শিখছে।
— ও! তা দুনিয়াতে ওরা আর লোক খুঁজে পেলেন না?
— আমি হলে খারাপ কী?
— ভালোটা কী শুনি?
— বয়স হচ্ছে। এখন একটু সম্মান-মর্যাদা পেলে মন্দ হয়না। নিজেদের মহল্লা, একটু ক্ষমতা …
— এজন্য মসজিদ কমিটির সভাপতি হতে হবে? সম্মান-মর্যাদা-ক্ষমতা অর্জনের উপায় কি এই একটাই? তোমার বয়স এখনও চল্লিশ হয়নি। আগামীতে একজন ভালো মানুষ হিসেবে তুমি অনেক বেশি সম্মান-মর্যাদা পেতে পারো। ক্ষমতা হয়তো অতোটা পাবেনা।

তাদের কথোপকথনে প্রথম শ্রেণির অনুসন্ধিৎসু শিক্ষার্থী রাফির অনুপ্রবেশ ঘটলো।

— ক্ষমতা কী বাবা?
— ক্ষমতা? উমম… ক্ষমতা হলো নিজে কিছু করতে পারা বা কাউকে কিছু করতে দেয়া বা না দেয়ার যে ব্যাপার, সেটা।
— ও আচ্ছা। মা মনে হয় চাইছেন না তুমি সভাপতি হও। এটাও কি ক্ষমতা?
— হ্যাঁ বাবা। এটাও ক্ষমতা। এটাকে বলে ভালোবাসার ক্ষমতা।
— ও! মা তোমাকে অনেক ভালোবাসেন।
— বাসেন। তবে তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই। মা তোমাকে যতোটা ভালোবাসেন, তার চেয়ে বেশি ভালো আর কাউকে বাসেন না। দুনিয়ার কোনো মায়ের কাছে তার বাচ্চার চেয়ে বেশি ভালোবাসার কেউ নেই। মাকে কখনও কষ্ট দিও না।
— হুম।
— ক্ষমতা অনেক রকমের হয় বাবা। ভালোবাসার ক্ষমতা, টাকার ক্ষমতা, বুদ্ধির ক্ষমতা, সৌন্দর্যের ক্ষমতা, বন্দুকের ক্ষমতা, গানের ক্ষমতা, ধর্মের ক্ষমতা, সরকারের ক্ষমতা … …

হয়েছে, লেকচার বন্ধ কর। খাও এখন।— বাপ-বেটাকে তাড়া দিলেন মিতু।

খাওয়া শেষে রউফ কিচেনে গেলেন থালাবাসন ধুতে। মিতু টেবিল গোছানোর কাজ সারলেন। রাফি মগ্ন তার আইপ্যাড নিয়ে। আরও একটু পরে মিতু গেলেন রাফিকে ঘুম পাড়াতে, রউফ তাদের শোবার ঘরে।

দুই.
রউফ-মিতুর সংসার অনেক দিনের। প্রায় বারো বছর। স্ত্রীকে খুব বেশি আদর করেন বলে বাচ্চা নেননি দীর্ঘদিন। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পাশ করে প্রেম করেছেন আরো ছয় বছর। সব মিলিয়ে তাদের সম্পর্কটি প্রায় আঠারো বছরের। রউফ পড়তেন অর্থনীতিতে, মিতু নৃবিজ্ঞানে। একই ভবনের নিচ তলা ও উপর তলায় তাদের বিভাগ থাকায়, আবার ক্যাফেটেরিয়া ও লাইব্রেরিও বিভাগের খুব কাছে থাকায়, তাদের সারাদিন কাটতো প্রায় একই সাথে।

রউফ মাঝে মাঝে কিছু সময় ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় নাটকের রিহার্সেলের জন্য বরাদ্দ রাখলে মিতু তাকে সঙ্গ দিতেন, কিন্তু দলে যুক্ত হননি। তিনি বরং পরিচিত ছিলেন কিছুটা আঁতেল হিসেবে। অন্যসব জুটির মতো তারা গাছতলায় পুতুপুতু করেননি, বিভাগ ও ক্যাফেটেরিয়ায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতেন। শরীরী সাহচর্যের আয়োজনটি হতো মিতুর বাসায়— অবশ্যই কাউকে বুঝতে না দিয়ে। সংস্কারমুক্ত মননে পারস্পরিক সহযোগিতা তাদের কাজে লেগেছে বেশ। এমনকি প্রেমের এক বছরের মধ্যে মিতু যখন অজানিতে কনসিভ করলেন, অ্যাবরশনের ব্যাপারটিও তারা সামলে নিয়েছিলেন ভালোভাবে।

মিতু রাজধানীর মেয়ে, বাসা থেকেই ক্যাম্পাসে যেতেন। রউফ মফস্বলের ছেলে, হলে থাকতেন। ক্যাম্পাস ছাড়ার পর রউফ যখন একটি ব্যাংকে ইন্টার্নশিপ করছিলেন আর মিতু একটি বিদেশি গবেষণা দলের অনুবাদক হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের এমাথা-ওমাথা, তখন রউফের বাবা মারা যান। তার মারা যাবার বয়স হয়নি।

রউফ ফিরে এলেন বাড়িতে। কদিন পর মিতুকেও নিয়ে এলেন বউ করে। মিতু বিয়েশাদির আনুষ্ঠানিকতা পছন্দ করেন না, বিশেষ বিবাহ আইনকেও মনে করেন মানবতাবিরোধী, সেজন্য কয়েকজন বন্ধুর সহায়তার তারা কাজি অফিসে বিয়ের কাগুজে ব্যাপারটি সারেন। ব্যাপারটি মিতুর পরিবার মেনে নিতে না পরলেও মেয়েকে তারা প্রত্যাখ্যান করেননি। আর এদিকে রউফের মা তো বউ পেয়ে মহা খুশি। তিনি গত হয়েছেন গত বছর।

বাবা-মার একমাত্র সন্তান রউফ উত্তরাধিকারসূত্রে বেশ জমিজমা আর টাকাকড়ি পেয়েছেন। ব্যাংকে ইন্টার্নশিপের অভিজ্ঞতা তাকে বেশ সাহায্য করছে বাবার মোটর বাইক আর নির্মাণ সামগ্রীর স্থানীয় ডিলারশিপ পরিচালনায়। আয় ভালো; ছোট সংসারের ব্যয় খুব সামান্য। বন্ধুবান্ধবগণ শো রুমেই আসেন আড্ডা দিতে, ফলে তাকে বাইরেও যেতে হয় না খুব একটা।

নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর একজন নারী পেশাজীবন বাদ দিয়ে মফস্বলে গৃহিনীর জীবন যাপন করছেন, তাও আবার মিতুর মতো একজন আঁতেল, এটা তার বন্ধুগণ বিশ্বাস করতে পারেন না, মানতেও পারেননা। তাদের প্রতি মিতুর জবাব স্পষ্ট, আমি আমার জীবন বেছে নিয়েছি। আসল ব্যাপার হলো ভালো থাকা, আমি তা আছি। তোমরা আমার শিক্ষার সামাজিক দায়বদ্ধতার কথা বলতে পারো, কিন্তু তার সময় ফুরিয়ে যায়নি। নৃবিজ্ঞান যে উপলব্ধি করতে পারে, যে এতে আনন্দ খুঁজে পায়, সে কখনো কোনোভাবে নিষ্ক্রিয় মানুষ হতে পারে না। আর তোমরা যারা সক্রিয়তার দোহাই দিচ্ছো, তোমাদের বলি, নৃবিজ্ঞান পড়ে কোন মুখে তোমরা আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের সাথে নিজেদের যুক্ত করো? তোমাদের সামান্য আত্মসম্মান নেই?

তিন.
রউফ শুয়ে আছেন বালিশে বুক রেখে করতলে মুখাবয়ব ধরে। মিতু এলেন ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে। এটাসেটা গোছাচ্ছেন। জলপাই রঙের মাড় ছাড়া টাঙ্গাইল শাড়ি আগোছালো। তার মুখাবয়ব, ঘাড়, ক্লিভেজ, মসৃণ সাদা পেট ও নাভিমূল আর ঋজু কাঁধ ও প্রসারিত নিতম্ব বিভাজনের মেরুদণ্ডরেখা দেখতে দেখতে রউফ তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠলেন। মনে মনে বললেন, এই মেয়েটি আমার চোখে কোনোদিন পুরোনা হবেনা। তিনি ডাকলেন—

— মিতু!
— শুনছি।
— কিছু বললে না?
— কী নিয়ে?
— মসজিদ কমিটি?
— ও!

মিতু রউফের পাশে এসে খাটের উপর বসলেন। তার দিকে তাকিয়ে বললেন— তুমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক। তোমার পর্যবেক্ষণ খুব ভালো না হলেও মন্দ নয়। আমরা কেউ কাউকে কোন বিষয়ে জোর করিনি। আমার মতামতের দরকার নেই। তুমি যা ভালো বোঝ, তা করো। তবে আমি আশা করবো সিদ্ধান্ত নেবার বেলায় নিজের ছেলে আর স্ত্রীর কথা ভাববে। আমাদের জীবন আর আমাদের একার নেই।

রউফের কপালে তিনি আলতোভাবে ভেজা চুমুর এক জলছাপ এঁকে দিলেন। রউফ দু’হাতে তার নিতম্ব বেড় দিয়ে আঁচলের নিচে নাভির কাছে নাক ঘষতে লাগলেন, তাকে আরও বেশি করে পেতে চাইলেন।

— এখনও দুপুরই ফুরোয়নি যে!
— তাতে কী?
— ঠিক আছে, দরোজা দিয়ে আসি।

দুপুরের দোহাই নিছক মিতুর কথার কথা। তিনি জানেন, মানুষ একমাত্র প্রাণি যার সদস্যগণ সারা বছর সব ঋতুতে দিনে বা রাতে মিলিত হতে পারে। উপরন্তু, একমাত্র মানুষ মিলিত হতে পারে বহু ও বিচিত্র ভঙ্গিমায়। পরিবেশ, জৈবসত্তা আর সংস্কৃতি— সব এখানে একাকার। এখানে একমাত্র বাধা হলো অনিচ্ছার মানসিকতা। মানুষের— মানে হোমো স্যাপিয়েন্সের— এই মৌলিক যৌন আচরণ তার প্রজাতির প্রসার সাধনে, কিংবা বলা যায় প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে যোগ্যতমের উর্ধতনের টিকে থাকার পেছনে অন্যতম প্রধান সহায়ক।

ঘেমে নেয়ে ওঠা দুজন একসাথে শাওয়ার নিয়ে ঘুমিয়ে গেলেন।

চার.
রউফ মসজিদ কমিটির সভাপতির পদটি অলঙ্কৃত করেছেন। স্বচ্ছলতা ও সক্ষমতা তাকে সফল করছে। শুক্রবার দুপুরে বাসায় ফিরতে তার বেশ দেরি হয়; কমিটির সভা থাকে। মিতু রাফিকে খাইয়ে দিয়ে রউফের জন্য অপেক্ষা করেন। খাবার সময় একদিন রউফ বললেন—

— কমিটির সবাই হুজুরকে দাওয়াত করে খাইয়েছেন।
— হুজুর? মানে তোমাদের মসজিদের বেতনভুক্ত ইমাম সাহেব?
— হ্যাঁ।
— তো?
— সভাপতি হিসেবে আমারও একদিন দাওয়াত দেয়া উচিত। মানে, আমাদের পেইড স্টাফ হলেও, মসজিদের ইমাম তো! সন্মানিত ব্যক্তি।
— কবে আসবেন?
— আগামী শুক্রবার। রাতে। ভালোমন্দ কিছু কোরো।
— তুমি জানো যে ইমাম হোন বা কর্মচারি হোন, সেটা ব্যাপার না, যে কোনো অতিথির জন্য আমি সর্বোচ্চ করি। তার জন্যও করবো; ভেবো না।

পরের শুক্রবার রাতে ইমাম সাহেব খেতে এলেন। খাবার পর রাফিকে শুইয়ে দিয়ে এসে বসার ঘরে মিতু চা সার্ভ করলেন। ইমাম সাহেব বললেন—

— ভাবি, একটু বসেন না! কিছুক্ষণ গল্প করি।
— অবশ্যই।
— শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহপাক খুব ভালো খাইয়েছেন।
— আল্লাহ নিশ্চয়ই তাঁর প্রতি আপনার এই শুকরিয়া প্রকাশে আপনার জন্য অশেষ নেক বরাদ্দ করবেন।
— জ্বি, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। তা ভাবি, বলছিলাম কি…
— বলুন, প্লিজ।
— ভাই তো মাশাআল্লাহ আল্লাহর জন্য অনেক কিছু করছেন। বেহেশতের দুয়ার তার জন্য অবারিত।
— জ্বি, আপনি দোয়া করবেন।
— তো বলছিলাম যে ধর্ম-কর্ম আপনি পরে শুরু করলেও পারেন, আপাতত একটু পর্দা-পুশিদার দিকে নজর দিলে একটি শুভ সূচনা হতো।
— আচ্ছা!
— আর রাফি বাবাজিও তো মাশাআল্লাহ বেশ বড় হয়ে গিয়েছে। সকালে আমার ওখানে আরবি পাঠের এলেম নিতে পাঠালে পরকালের জন্য আপনাদের সবার সঞ্চয় বাড়তো।
— আচ্ছা!

মিতু রউফের দিকে তাকালেন। রউফ নিস্পৃহভাবে শুনছেন। খুব অস্পষ্টভাবে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে মিতু বললেন—

— হুজুর, পর্দা আসলে প্রত্যেকের দেখায় ও বোঝায়, কাপড়ে নয়। একজন কোন চোখে কাকে কিভাবে দেখছেন তার সাথে কাপড়ের সম্পর্ক কম। অন্যের দেখার দায় আমি আমার উপর নিতে পারিনা। আমাকে তেঁতুল মনে হলে, আমাকে দেখে কারো মুখে লালা ঝরলে, কারো কামভাব জাগলে— আমি দায়ী নই। পোশাক দুনিয়ার বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন রকম। খোলামেলা পোশাকের সমাজে অন্যায়-অনাচার যতোটা হয়, পর্দানশীল সমাজে তা তার চেয়ে অনেক বেশি। নেদারল্যান্ডসে আমস্টারডাম বলে একটা শহর আছে যেখানে মাদক ও যৌন বাণিজ্যে কোনো বাধা নেই; আর আপনি শুনলে অবাক হবেন সে শহরে কোনো ধরনের অপরাধ নেই বললেই চলে। আমস্টারডামের অধিবাসী ও প্রশাসক— সবাই এতে খুশি। আমরা এগুলো জানি।

ইমাম সাহেব এরকমটি আশা করেননি। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আর সবার মতো মিতুও তার নসিহতে ভয় পাবেন। মিতু আবার বললেন—

— আমাদের ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা যথেষ্ট ভাবি। সত্যি বলতে কি, সব বাবা-মা তাদের সন্তানের ভবিষৎ নিয়ে ভাবেন অন্য যে কারো চেয়ে বেশি। ছেলেকে এদেশে মসজিদের ইমাম বা মিডল ইস্টে ক্লিনার বানানোর কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। আরবি ভাষাভাষিরাও এখন তাদের অলস ছেলেমেয়েদের জন্য নিজ দেশে কাজের ব্যবস্থা করছে। আর যদি ধর্মের কথা বলেন তাহলে বলবো, যে ঈশ্বর কেবল আরবি বোঝেন তাকে অন্য ভাষার মানুষের প্রয়োজন নেই। সুতরাং আমাদের ছেলের আরবি শেখার কোনো উপযোগিতা নেই। সে যাই হোক, আপনি আমাদের নিয়ে ভেবেছেন, তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি সপরিবারে ভালো থাকুন।

ইমাম সাহেব রীতিমত হতভম্ব। রউফ কিছুটা বিব্রত; যদিও মিতুর স্পষ্টবাদিতা তার অজানা নয়। গল্প আর খুব একটা এগুলো না। রউফ ইমাম সাহেবকে নামিয়ে দিতে বাইরে গেলেন। ফিরে এস দেখতে পান মিতু বসে আছেন একই জায়গায়। তাকে ক্রুদ্ধ ও অপমানিত মনে হচ্ছে। সদর দরজা বন্ধ করতেই মিতু তাকে বললেন—

— কী স্পর্ধা তোমার হুজুরের! সে আমাকে পর্দা শেখাতে আসে! আমার বাচ্চার ভবিষৎ নিয়ে নির্দেশনা দেয়! আর তুমি বসে বসে শুনছিলে!
— দেখ, মিতু, এসব বলাই ওদের রুটি রুজি। বাদ দাও।
— বাদ দেব? তুমি দেখেছো পুরোটা সময় লোকটা চোখ দিয়ে আমাকে চেটেপুটে খাচ্ছিলো! আমি কি অশালীন পোশাকে ছিলাম? তারপরও কেন? পর্দার কথা কেন? আমাকে চুল ঢাকতে হবে? এইসব লম্পটদের জন্য?
— তুমি বিশ্রাম নেবে চলো। আমি টেবিল-থালাবাসন গুছিয়ে রাখছি।

পাঁচ.
ব্যবসার কাজে রউফ সকালে ঢাকা গিয়েছিলেন। ফিরলেন রাত এগারোটায়; তার হাতে দুটো প্যাকেট— রাফি আর মিতুর জন্য। রাফির জন্য এনেছেন পাকিস্তানি পাজামা-পাঞ্জাবি; মিতুর জন্য ইরানি হিজাব আর রোরকা, খুব ফ্যাশনেবল; দামি তো বটেই! সবই ইমপোর্টেড। রাফি ঘুমিয়ে; মিতু কিছু বললেননা।

খাওয়া শেষে বসার ঘরে মিতু বসলেন রউফের মুখোমুখি।

— পাকিস্তানি পাজামা-পাঞ্জাবি আর ইরানি হিজাব-বোরকা কেন এনেছ?
— দেখ, পাজামা-পাঞ্জাবি পোশাক হিসেবে খারাপ নয়। আর তোমার হিজাব-বোরকাও খুব ফ্যাশনেবল। আমি কি স্ত্রী-পুত্রের জন্য আমার পছন্দের কিছু কিনতে পারি না?
— অবশ্যই কিনতে পারো, কিন্তু এগুলো নয়।
— কেন নয়?
— রউফ, তোমার যুক্তি-বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, তুমি অন্ধ হয়ে গেছ।
— কী বলতে চাইছো?
— তুমি ভালো জানো কোনো কোনো সময় কোনো কোনো সমাজে জীবনাচারের কোনো কোনো উপাদান কোনো কোনো বিশেষ অর্থ বহন করে, বিশেষ পরিচয় প্রদান করে, বিশেষ যোগাযোগ স্থাপন করে। ইন আওয়ার টাইম, ইন আওয়ার কান্ট্রি, দিইজ পাকিস্তানি পাজামা-পাঞ্জাবি অ্যান্ড ইরানি হিজাব-বোরকা হ্যাভ স্পেসিফিক মিনিং। য়্যু নো দ্যাট। আমরা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের অধিবাসী। গোড়ালি ও কব্জির কাছে বায়ুপ্রবাহ বন্ধ করা পাজামা-পাঞ্জাবি আমরা কেন পড়বো? একইভাবে কোট-টাই-ই বা কেন পরবো? মরুভূমির পোশাক হিজাব-বোরকা কেন পরবো? নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় আমরা তো সব সময় এসির মধ্যে থাকিনা। তুমি বলছো ফ্যাশনের কথা! ফ্যাশন বোঝ? একসময় এফ-টিভি তো খুব দেখতে। ফ্যাশন শো কখন আয়োজিত হয় জানো না? প্রত্যেক দেশে ঋতু পরিবর্তন ও আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবের সাথে তাল মিলিয়ে ফ্যাশন হাউজগুলো তাদের পণ্য নিয়ে বাজারে নামে। পাকিস্তানি পাজামা-পাঞ্জাবি বা ইরানি হিজাব-বোরকা আমাদের ভূগোল-পরিবেশ-ঋতু-আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবের কোনটির সাথে যায়?
— মনে হচ্ছে শাড়ি খুব যায়!
— যায় না মানে? অবশ্যই যায়। আঠারো বছর ধরে তুমি জানো যে শাড়িতে আমি শারিরিক-সাংস্কৃতিক-মানসিক স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। তুমি এশিয়া-ইউরোপ-আফ্রিকার প্রাচীন সভ্যতার অনেক ছবি দেখেছো। ওগুলোতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেলাই ছাড়া লম্বা যে কাপড়টি পরিধান করেন, তা শাড়ির পূর্বসূরী। তাই শাড়ি কেবল বাঙালির নয়, বিশ্ব-ঐতিহ্যের উত্তরসূরী। আমরা বাঙালি নারীগণ আমাদের শরীরে পৃথিবীর ইতিহাস জড়িয়ে রাখি। বিশ্ব ইতিহাসের গায়ে স্থানীয় প্রকৃতি-পরিবেশ-বিশ্বাসকে বিচিত্রভাবে বিবিধ মোটিফ দিয়ে শাড়িকে অলঙ্কৃত করেছেন আমাদের শিল্পীগণ— মসলিন, বেনারশি, জামদানি, টাঙ্গাইল, মনিপুরি এসবে। সমকালের নাগরিক শিল্পীগণও শাড়িকে অবলম্বন করেছেন। এসব আমার ভালো লাগে। আকাশ, মেঘ, প্রাণ, বৃক্ষ, লতা, পাতা, পাখি, ভাষা, চিহ্ন, প্রতীক, বিশ্বাস ও রূপকে জড়িয়ে রাখি আমার শরীরে। আমি সম্মান জানাই শাড়িতে মূর্ত মানুষের বিমূর্ত শ্রম ও সৃজনশীলতাকে। এই অপরূপ পৃথিবীর সাথে আমার এক জন্মের সম্পর্কটি আমি উপলব্ধি ও উপভোগ করি শাড়িতে।
— কিন্তু সেদিন তুমি হুজুরের তাকানোর কথা বলছিলে। তোমার চারপাশে সেরকম অনেকেই তো আছেন। সেজন্যও তো হিজাব-বোরকা পরা যেতে পারে।
— তুমি যুক্তি দিতেই থাকবে? আমাকে তোমার হিজাব-বোরকা পরার জন্য কনভিন্স করতেই হবে? একসময় আমাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে তোমার অহংকার হতো। তুমি বলতে, সুন্দরি গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাঁটতে বেরুলে নিজেকে তোমার সম্রাটের মতো মনে হতো; তুমি আরও বলতে, ভেতরে সৌন্দর্য না থাকলে বাইরের সৌন্দর্য আলো ছড়ায় না। আমার ভেতরটা কি এখন পঁচে গেছে? সেজন্য কি আমি দেখতে কুৎসিত হয়ে গিয়েছি? বলো? আমার সাথে চলতে তোমার লজ্জা হয়?

অনেক কথা বলে মিতু রীতিমত হাঁপাতে লাগলেন। রউফ শোবার ঘরে চলে গেলেন। মিতু কাঁদতে লাগলেন বুক চেপে, মুখ ঢেকে।

সে রাতে অঝোর কাঁদতে কাঁদতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়লেন মিতু।

ছয়.
সম্পর্কের সুতোটা বেশ মলিন হয়ে গিয়েছে। বেশ মলিন।

সাত.
আরো মাস তিনেক গিয়েছে। রউফের উপস্থিতি বাসায় দম বন্ধ করা একটা গুমোট আবহাওয়া তৈরি করে। মিতু সারাদিন চেষ্টা করেন রাফির সাথে আনন্দঘন সময় কাটাতে।

রউফ-মিতু পাশাপাশি ঘুমোন এখনও। কিন্তু তাদের মাঝে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হরসুন্দরী ও নিবারণের মাঝের মৃত বালিকা শৈলবালার মতো করে শুয়ে থাকেন জীবন্ত ইমাম সাহেব। কখনও প্রয়োজন হলে রউফ মিতুকে দখল করেন। মিতু বাধা দেননা; সাড়াও দিতে পারেননা; তার ভেজে না; তীব্র ব্যথায় দাঁত চেপে থাকেন। অন্ধকারে রউফ বিষয়টি বুঝতে পারেন না; হয়তো বোঝার ক্ষমতা তিনি হারিয়েছেন; কিংবা তিনি আর বোঝার প্রয়োজন মনে করেন না। অল্প সময়েই রউফের কাজ হয়ে যায়। তিনি ঘুমিয়ে যান। মিতু তাকিয়ে থাকেন ছাদের দিকে।

ছাদের দিকে তাকিয়ে মিতু ভাবেন, একসময় রউফ তার সাথে মেতে উঠতেন প্রচুর আলোতে, অন্ধকার তিনি সহ্য করতেন না, যেন রঙ্গমঞ্চের আলো হলে আরও ভালো হতো। রউফ বলতেন, স্বর্গে খাওয়া, গেলমানের সেবা নেয়া আর হুরের সাথে মিলিত হওয়া ছাড়া পুণ্যবানদের জন্য ঈশ্বর আর কোনো পুরষ্কার রাখেননি। সুতরাং এই স্বর্গীয় খেলার জাগতিক মগ্নতায় কোন অন্ধকার থাকতে পারেনা। আমাকে দেখতে হবে তোমাকে পুরোটা— তোমার দৃষ্টি, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিব্যক্তি, তোমার অনুভবের উচ্ছ্বাস ও উদ্ভাস। তখন মিতু যোগ করতেন, হ্যাঁ, এটা কেবল শরীরের ব্যাপার নয়, মনেরও। মানসিক সম্মতি, প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণ ছাড়া এ খেলা আর খেলা থাকেনা। অসীম একাগ্রতায় সামান্য বিচ্যুতি হলে খেলা ভেঙে যায়। তিনি বলতেন, এসময় যেসব নারী বিবিধ বস্তুগত আবদারে স্বামীকে শপথ করান তা ব্ল্যাকমেইলিং; এ সময়ে তাদের এ লেনদেন-মানসিকতা তিনি ঘৃণা করেন। তার মতে রূপোপজীবিনীগণ বরং সৎ; আগে থেকে তারা দরকষাকষি করে নেন।

মিতু ভাবতে থাকেন, আজকাল নিজেকে তার রূপোপজীবিনীর চেয়েও অসহায় মনে হয়; ভালোবাসার সম্পর্কে দরকষাকষি তার পছন্দের নয়; তাই তার যেন নিরূপায় ধর্ষিত হওয়ার বিকল্প নেই। তার মনে পড়ে, রউফ একসময় তাকে ফ্লার্ট করতেন, তুমি স্বর্গীয় হুরের চেয়েও সুন্দরী; হাড় ও রক্তনালি দেখা যায় এমন কথিত মনোহর হুর দেখলে আমি তো ভয়েই অজ্ঞান হয়ে যাবো! মিতু ভেবে পান না সেই রউফ আজ স্বর্গের হুর আর গেলমানের লোভে অন্ধ হয়ে গিয়েছেন!

আট.
রাফিকে স্কুল থেকে এনে ঘরের কাজ করছেন মিতু। এমন সময় এলেন মহল্লার ক্যাজুয়াল লেবার শম্পা। হন্তদন্ত তিনি রউফের খোঁজ করছিলেন। মিতু বললেন—

— এ সময় তো উনি শো রুমে থাকেন; দুপুরে খেতে আসেন, আবার ফেরেন সন্ধ্যার পর।
— ভাবি, আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে; ভাইকে বলেন আমি বিচার চাই। আমার ছেলের সাথে অন্যায়ের বিচার চাই। মাত্র দশ বছর বয়স, ওর উপর এমন অত্যাচার!
— কী হয়েছে ঠান্ডা মাথায় খুলে বলো। কিছু বুঝতে পারছি না। কী অত্যাচার? কে অত্যাচার করেছে?
— ইমাম সাব, ভাবি। ইমাম সাব। ছেলেটাকে ঘুড়ি কিনে দেবে বলে মসজিদে নিয়ে….

কান্নার বেগের জমিনে আঞ্চলিক ভাষার বিবরণ থেকে মিতু বুঝলেন শম্পার ছেলে আকাশকে ইমাম সাহেব বলাৎকার করেছেন। শম্পা ইমাম সাহেবের কাছে গিয়েছিলেন, উল্টো তিনি হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেছেন যে তার ছেলে মিথ্যা অভিযোগ করেছে আর কোন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শম্পা ইমাম সাহেবকে মিছেমিছি দুষছেন। সব শুনে মিতু শম্পাকে বললেন—

— রক্তপাত হয়েছে? ডাক্তার দেখিয়েছো?
— বুঝতে পারছিনা ভাবি। ছেলেটা শুধু কাঁদছে।
— বোঝা না গেলেও ডাক্তার দেখাতে হবে। ভেতরে রক্তপাত হতে পারে।
— হায় হায়, কোন ডাক্তার দেখাবো, টাকা কোথায় পাবো?

মিতু তাকে কিছু টাকা দিয়ে আকাশকে তার পরিচিত এক ডাক্তারের নিয়ে যেতে বললেন। বললেন, তোমার ভাই একটু পর খেতে আসবেন। আমি সব জানাচ্ছি। এর বিচার হতে হবে।

দুপুরে রউফ খেতে এলে মিতু তাকে ইমাম সাহেবের কাণ্ড সম্পর্কে জানালেন। এর একটা বিহিত করতে বললেন। সব শুনে রউফ ব্যথিত হলেন; সন্ধ্যায় মসজিদ কমিটির জরুরি সভা ডাকবেন বললেন।

বিকেলে শম্পা এলেন। ডাক্তার তাকে জানিয়েছেন যে রক্তপাত কিছুটা হলেও তা আশংকাজনক নয়। প্রেসক্রিপশন করে দিয়েছেন। মিতু তাকে আরও কিছু টাকা দিলেন ঔষধ কিনতে। জানালেন, সন্ধ্যায় এ বিষয়ে মসজিদ কমিটির সভা হবে।

সন্ধ্যার পর রউফ বাসায় ফিরলে মিতু তার দিকে তাকিয়ে রইলেন। রউফ জানালেন—

— কমিটি মনে করে এটা হুজুরের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ, ষড়যন্ত্র। তাছাড়া, প্রচলিত আইন এবং শরিয়তের বিধান মতে সাক্ষি ছাড়া কারো বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায় না। এ ঘটনার কোনো সাক্ষি নেই।
— ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন আছে! প্রয়োজনে ডিএনএ টেস্ট করা যায়! থানায় জানাও!
— সেটা আমাদের কাজ নয়।
— তোমার কমিটির এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তুমি পদত্যাগ করেছো?
— আমার পদত্যাগ আর হুজুরের বিচার কি এক হলো? সে যদি কোনো অপরাধ করেই থাকে, আমি কেন তার দায় নেব?

মিতু স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

নয়.
কয়েকদিন পর। ২৬ মার্চ। সদর উপজেলার পার্কে স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজ থেকে বাসায় ফিরে রউফ দরোজাটি ভেজানো দেখলেন। ভেতরে মিতু বা রাফিকে পেলেন না। খাবার টেবিলে খাবার সাজানো, গ্লাস চাপা দেয়া একটি ইনভেলপ আর ভেতরে একটি চিঠি। মিতু লিখেছেন—

“সোনামনি, আমরা একসাথে পথ চলবো বলে যাত্রা শুরু করেছিলাম। চলার পথে সবার গতি সমান হয়না। গন্তব্যটা ঠিক রাখতে অনেক সময় পথ পাল্টাতে হয়। কিন্তু তোমার শুধু পথ পাল্টায়নি; তোমার গন্তব্য পাল্টে গেছে আর তুমিও পাল্টে গেছ। আসলে তুমি সময়ের বিপরীত দিকের প্রতিব্রহ্মাণ্ডে হাঁটছো— আমাদের ঐকমত্যের সময় থেকে আজকের যে দূবত্ব, তুমি আজ আমাদের সে ঐকমত্যের সময় থেকে ঠিক ততোটুকু পেছনে। আমি এখনও হাঁটছি আমাদের ঐকমত্যের পথে। আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যে। আমি পাল্টাইনি।

“তোমার জন্য নিজের দিক থেকে আমি আপোষ শুরু করেছিলাম। কিন্তু রাফির কথা ভেবে তা আর পারছিনা। একদিন তুমি ওকে বলেছিলে, দুনিয়ার কোনো মায়ের কাছে তার বাচ্চার চেয়ে বেশি ভালোবাসার কেউ নেই। সেজন্য আমাকে চলে যেতে হচ্ছে। তোমার চারপাশ শিশুদের জন্য নিরাপদ নয়। তুমি জগতের শিশুদের পক্ষে নও। স্বর্গের হুর আর গেলমান গ্রাস করেছে তোমার হৃদয়-মন।

“আপপত মা-বাবার কাছে যাচ্ছি। ভেবো না। নানা-নানির সাহচর্যে রাফি ভালো থাকবে। আর, আমি নৃবিজ্ঞানে পড়েছি, জীবনকে যাপন করতে আয়রোজগার আমার জন্য কঠিন হবে না। আমাদের ছেলে অভাবে থাকবে না।

“আমার শরীরে তোমার আদরের ছোঁয়া কোনোদিন মুছে যাবেনা। অনেক ভালো থেকো।

— মিতু”

২৫ অক্টোবর ২০২২; খোলাদ্বার কারাগার।

-লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সম্পাদক, লড়াই।