Home সাহিত্য ও বিনোদন মঞ্চ প্রস্তুত, প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায় দিশেহারা শিল্পীরা

মঞ্চ প্রস্তুত, প্রশাসনিক অনুমোদন না পাওয়ায় দিশেহারা শিল্পীরা

443

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি: বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী বিনোদন মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম যাত্রাপালা। কিন্তু প্রশাসনিক অনুমোদন , রাজনৈতিক জটিলতায় এই শিল্পের অবস্থান এখন গভীর অস্তিত্বসংকটে। বহু প্রাচীনকাল থেকে এসব মাধ্যম গ্রামীণ জনসাধারণের চিত্তবিনোদনের পাশাপাশি লোকজীবনের সৃজন ও মননচর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন তা বিলীয়মান। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন থাকার পরেও মিলছে না অনুমোদন। যাত্রা শুরু হলো না অথচ যাত্রায় অশ্লীলতার কারণ দেখিয়ে অনুমোদন মিলছে না কেন। আজকে দীর্ঘ ২০-২৫ দিন এই মেলায় প্রায় শতাধিক শিল্পী নিয়ে অবস্থান করছি অথচ আমরা কিভাবে চলছি, কি খাচ্ছি এগুলো দেখার কি কেউ আছে। আমাদের সংসার জীবন কিভাবে চলবে,খাব কি।

বলছিলাম ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার নেকমরদ ঐতিহ্যবাহী ওরশ মেলায় অবস্থানরত চৈতুলী অপেরার শিল্পীদের কথা।

লোকসংস্কৃতির এই মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো যাত্রাপালা, পুতুলনাট্য বা পুতুলনাচ ও সার্কাস। অথচ যাত্রা পালা আয়োজনে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা, পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, প্রশিক্ষণ না থাকা এবং আরও নানান কারণে খুব জনপ্রিয় এই সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোর নিয়মিত কার্যক্রম প্রায় বন্ধই করে দেয়া হচ্ছে। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অনিবার্য প্রয়োজনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাম ও আঙ্গিক পরিবর্তন করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এতে এগুলোর মূল আঙ্গিকে বিকৃতি ঘটছে।

চৈতুলী অপেরার সত্তাধিকারী মোঃ কুতুবুল আলম শাহিন জানান,সামাজিক শিক্ষা বা লোকশিক্ষার ক্ষেত্রেও যাত্রাপালার আছে বলিষ্ঠ ভূমিকা। আদি যাত্রাপালার ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় শুরুর দিকের যাত্রাপালাগুলো মূলত কাহিনী নির্ভর, আর সেসব কাহিনী জুড়ে আছে ধর্মীয় সব চরিত্র। অথচ আমার চৈতুলী অপেরা সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধিত হওয়া সত্ত্বেও ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্যবাহী নেকমরদ ওরশ মেলায় মিলছে না অনুমোদন।যাত্রা শুরু হলো না অথচ অশ্লীলতার কারণ দেখিয়ে অনুমোদন মিলছে না। শুরু হোক যদি আপনাদের নজরে অশ্লীলতার কোন দৃশ্য আসে তখন বন্ধ করে দিবেন। যাত্রাপালা নেহাতই বিনোদনের মাধ্যম ছিলো, ছিলো লোকশিক্ষার্জনেরও এক সাংস্কৃতিক পাঠশালা।

যাত্রাশিল্পের এখন ঘোর দুর্দিন। যাত্রাপালা আয়োজনে জেলা প্রশাসনের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। কিন্তু যাত্রার কথা শুনলেই প্রশাসন আর অনুমোদন দিচ্ছে না। আক্ষেপ করে বাংলাদেশ যাত্রা মালিক পরিষদের সহ-সভাপতি প্রদীপ কির্তনীয়া বলেন, আদি সংস্কৃতি হলো যাত্রা। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। নেকমরদ ওরশ মেলায় দুটি যাত্রা দল এসেছে। আজকে ২০-২৫ দিন এই মেলায় অবস্থানরত যাত্রাশীল্পীরা।যাত্রা শুরু হলো না অথচ অশ্লীলতার দায়ে অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না। দেশে যেখানে ৩০০-এর বেশি যাত্রা দল ছিল, এখন ৩০টি দলও সংগঠিত হচ্ছে না। প্রায় দুই বছর করোনা কালিন সময় ধরে যাত্রাপালা বন্ধ। এই শিল্পের জীবন মান উন্নয়নে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।যাত্রা শুরুর অনুমতি দেয়া হোক যদি অশ্লীল নৃত্য পরিবেশন দেখেন তবে না হয় বন্ধ করে দিবেন।

নেকমরদ ওরশ মেলায় অবস্থানরত দুটি যাত্রাপালার প্রায় শতাধিক শিল্পী কলাকুশলী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,সরকার শিল্প–সংস্কৃতিচর্চায় উৎসাহ দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেও মাঠপর্যায়ের অবস্থা তার বিপরীত। কখনো আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, কখনো জঙ্গি হামলা , অশ্লীল নৃত্য এমন নানা ওজর-আপত্তি তুলে যাত্রার অনুমোদন দেওয়া বন্ধ করছে।

শিল্পকলা একাডেমি প্রতিবছর যাত্রা দলের নাম নিবন্ধনের জন্য প্রত্যেক দলের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা করে নেয়। কিন্তু তারাও যাত্রাশিল্পের উন্নয়নে বিশেষ কিছুই করে না।

যাত্রাশিল্পের সঙ্গে বহু লোকের জীবিকাও জড়িত। প্রতিটি দলে শিল্পী, কলাকুশলী মিলিয়ে জনাচল্লিশেক লোক থাকে। এ হিসাবে তিন শতাধিক যাত্রা দল অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার লোকের জীবিকার সংস্থান। পালা মঞ্চস্থ না হওয়ায় এসব মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। অনেকেই চলে গেছেন অন্য পেশায়। অনেক দক্ষ অভিনেতা–অভিনেত্রী, গায়ক বাদক, পালাকার চলে গেছেন দল ছেড়ে। ফলে ক্রমেই রুগ্ণ, ক্ষয়িষ্ণু, নিষ্প্রভ হয়ে পড়ছে ঐতিহ্যবাহী যাত্রার জৌলুশ।

রাষ্ট্র বরাবরই এ মাধ্যমটাকে ভয় পেয়েছে। তাই তো বিধিনিষেধ কিংবা কালাকানুন জারি করে সরকারিভাবে যাত্রার যাত্রাপথ বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। অথচ চিরায়ত সত্য এটাই যে, যাত্রা বা যাত্রাগান যুগে যুগে মানুষকে আনন্দ দিয়েছে। যাত্রার আসরে শোনা যেত বীর পুরুষদের কাহিনি, রাজা-বাদশাহর যুদ্ধের গল্প। লেখাপড়া না-জানা মানুষ যাত্রাগান শুনে অনেক কিছু শিখত। বুঝতে পারত। দেশপ্রেম ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত হতো হাজার হাজার মানুষ।

আক্ষেপ করে যাত্রাশিল্পীরা আরো বলেন ,কী হবে যাত্রাশিল্পের? এ সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ কী? করোনার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত যাত্রাশিল্পীরা আবার নতুন করে বাঁচতে চায়। নির্মাণ করতে চায় নতুন যাত্রাপালা। যে পালায় থাকবে বঙ্গবন্ধুর কথা, স্বাধীনতার কথা। এর জন্য প্রয়োজন জাতীয় পৃষ্ঠপোষকতা।