Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি ভোজ্যতেলের দাম লিটারে বাড়ল ২৫ টাকা

ভোজ্যতেলের দাম লিটারে বাড়ল ২৫ টাকা

36

ডেস্ক রিপোর্ট: ভোজ্যতেলের বাজারে আবারও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। পাম অয়েলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক ইন্দোনেশিয়া রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণায় বাজারে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। একদিনের ব্যবধানে সয়াবিনের দাম প্রতি লটারে ২০ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম প্রতি লিটারে ২৫ টাকা বেড়েছে। সরকার নির্ধারিত দামে কোথাও তেল মিলছে না। এমনকি বাজারে সয়াবিনের সরবরাহও কমে গেছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দামও বাড়ছে। এ কারণে মিল মালিকরা আবারও ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু সরকার এ দাবি নাকচ করে দিয়ে বলছে-ঈদের পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে ঈদ সামনে রেখে ভোজ্যতেলের চাহিদা বাড়ায় বাজারে এখন সয়াবিনের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন। তবে মিল মালিকরা বলছেন তারা চাহিদা অনুযায়ী তেলের জোগান দিয়ে যাচ্ছেন। সরবরাহ কমানো হয়নি।

ইন্দোনেশিয়া নিজেদের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমাতে ও জোগান বাড়াতে শনিবার পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়। এ সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হবে। এখন যেসব তেল রপ্তানির জন্য জাহাজীকরণের পাইপলাইনে রয়েছে, সেগুলো রপ্তানি করা যাবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। এরপর থেকে আর তেল রপ্তানি করা যাবে না। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর সূত্র জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া থেকে যেসব পাম অয়েল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেসব এলসির অর্থ পরিশোধ করা তা দেশে আনার জন্য ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করছেন। তবে এখন আর নতুন এলসি খোলা হচ্ছে না। একই সঙ্গে নতুন করে এলসির অর্থ পরিশোধও বন্ধ রাখা হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের ৩৯ শতাংশই রপ্তানি করে ইন্দোনেশিয়া। মালয়েশিয়া করে ২৭ শতাংশ। বাকি পাম অয়েল রপ্তানি করে অন্যান্য দেশ। তবে মালয়েশিয়া এখনো পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করেনি। দুটি দেশই পাম অয়েল উৎপাদন সোয়া ৫ শতাংশ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া উৎপাদন করবে ৪ কোটি ৭১ লাখ টন এবং মালয়েশিয়া করবে ১ কোটি ৮৯ লাখ টন।

ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করার ঘোষণার পর একদিনের ব্যবধানে রোববার দেশের বাজারে খোলা সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ২০ টাকা বেড়ে ১৮০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। অথচ সরকার নির্ধারিত মূল্য হচ্ছে ১৩৬ টাকা। কোথাও এই দরে তেল পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়তি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও করে ফেলেছেন। তারা মনে করছেন একদিনে আটকে রাখতে পারলেই দাম বেশি পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে সরকার প্রতি লিটার খোলা পাম অয়েলের দাম ১৩০ টাকা নির্ধারণ করে। কিন্তু ওই দামে বাজারে পাম অয়েল পাওয়া যায়নি। এক মাস আগে ছিল ১৪০ টাকা লিটার। এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫০ টাকা। দুই দিন আগে ছিল ১৬০ টাকা। রোববার বাজারে প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ১৭৫ টাকা।

বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার যুগান্তরকে বলেন, তেল নিয়ে যাতে ঈদের আগে নতুন করে নৈরাজ্য না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। ইতোমধ্যে দাম বেড়ে যাওয়ার তথ্য আমাদের কাছে এসেছে। আমরা ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করব। কোনো দেশ এখন যদি রপ্তানি বন্ধ করে, এতে দেশের বাজারে এখনই দাম বেড়ে যাওয়ার কথা নয়। কারণ এই প্রভাব বাজারে পড়তে সময় লাগবে। আমরা তা খতিয়ে দেখছি। পাশাপাশি ভোজ্যতেল নিয়ে যাতে কোনো ধরনের কারসাজি বা কৃত্রিম সংকট না করতে পারে, সেজন্য পর্যাপ্ত নজরদারি করা হচ্ছে। মিল থেকে শুরু করে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। মিলে কী পরিমানে মজুত আছে, সে হিসাব নেওয়া হচ্ছে। কী দরে আমদানি করা হয়েছে, সেদিকে লক্ষ রাখা হচ্ছে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা তেলের দাম বাড়াতে প্রস্তাব দিয়েছে। ঈদের পর সভা করে দাম বাড়ানো হবে কি না, এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে। পরিস্থিতি যা হোক, তেল নিয়ে আর নৈরাজ্য হতে দেওয়া হবে না।

বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা বলেন, ইন্দোনেশিয়ার এ নিষেজ্ঞার কারণে সব ধরনের ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে। এরই মধ্যে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে, সামনে আরও বাড়বে।

সূত্র জানায়, দেশে বছরে শিল্প ও খাদ্য মিলে সাড়ে ২৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ২০ লাখ টন ব্যবহৃত হয় খাদ্য হিসাবে। বাকি ৪ লাখ টনের বেশি ব্যবহৃত হয় শিল্প খাতে। দেশে মোট চাহিদার ৬৭ শতাংশই পাম অয়েল দিয়ে মেটানো হয়। এর মধ্যে খাদ্যের চাহিদা ৫৮ শতাংশ। ৩৭ শতাংশ মেটানো হয় সয়াবিন তেল এবং বাকি ৫ শতাংশ অন্যান্য তেল দিয়ে। সয়াবিনের চেয়ে পাম অয়েলের আমদানি বেশি হলেও বাজারে বেশি পাওয়া যায় সয়াবিন তেল। অনেক সময় সয়াবিনের নামে পাম অয়েল বিক্রি করার অভিযোগ পাওয়া যায়।

বিশ্বের বৃহত্তম পাম অয়েল উৎপাদনকারী দেশ ইন্দোনেশিয়া। মোট চাহিদার ৩৯ শতাংশই তারা রপ্তানি করে। এর পরেই মালয়েশিয়ার অবস্থান। এর বাইরে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, চীন, শ্রীলংকা সীমিত আকারে পাম অয়েল উৎপাদন করে। বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ১৬ লাখ টন পাম অয়েল এবং সাড়ে ৮ লাখ টন সয়াবিন তেল আমদানি করে। অর্থাৎ সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ পাম অয়েল আমদানি হয়। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৭৪ কোটি ডলারের ৯ লাখ টন এবং মালয়েশিয়া থেকে ১৮ কোটি ডলারের ২ লাখ টন পাম অয়েল আমদানি করে। এছাড়া সিঙ্গাপুর থেকে বাণিজ্যিকভাবে ৬৬ লাখ ডলারের ৭ হাজার টন, চীন থেকে আড়াই লাখ ডলারের ২৭০ টন পাম অয়েল আমদানি হয়।

দেশের মোট চাহিদার ৭২ শতাংশ পাম অয়েল ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি হয়। এখন ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করলে ভোজ্যতেলের বাজারে বড় সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের পাশাপাশি পাম অয়েলের দামও বাড়তে শুরু করেছে। ইন্দোনেশিয়া তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞার কারণে পাম অয়েলের দাম আরও বেড়েছে। সয়াবিন তেল এক বছর আগে প্রতি টন বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০ ডলারে। এর দাম বেড়ে গত সপ্তাহে ২ হাজার ৫ ডলারে ওঠে। পরে কিছুটা কমে ১ হাজার ৮৮৬ ডলারে নেমে এসেছে। ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করার পর শনিবার থেকে এর দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। ওইদিন গড়ে ১ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯০০ ডলারে উঠেছে। রোববার তা আরও বেড়ে ১ হাজার ৩০ ডলারে উঠেছে। এদিকে এক বছর আগে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম ছিল ৯৬০ ডলার। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৪৫০ ডলার। রোববারও বন্ধের মধ্যেই পাম অয়েলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। ওইদিন প্রতি টন ১ হাজার ৭৬৫ ডলারে বিক্রি হয়েছে। আজ সোমবার আন্তর্জাতিক বাজার পুরো চালু হলে এর দাম আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান ড. গোলাম রহমান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়বে-এটাই স্বাভাবিক। তবে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ে ৩০ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। সে মোতাবেক তদারকি জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজার পর্যালোচনা করতে হবে। যদি দাম বাড়াতে হয়, তবে সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তার স্বার্থ বিবেচনায় আর কীভাবে সহায়তা দেওয়া যায়, তা পর্যালোচনা করে যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে হবে। তেল নিয়ে যাতে নৈরাজ্য না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। পাশাপাশি টিসিবির মজুত বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ বাড়াতে হবে। এতে সাধারণ মানুষ একটু হলেও স্বস্তিতে থাকতে পারবে।

সূত্র জানায়, দেশে সয়াবিন ও পাম অয়েলের চাহিদার চেয়ে বেশি মজুত রয়েছে। যে পরিমাণ অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে, সেগুলো দিয়ে কমপক্ষে আরও তিন মাস চলবে। এদিকে বাড়তি দামে যেসব তেল আমদানি হবে, সেগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়া থেকে পাম অয়েল দেশে আসতে ২ মাস সময় লাগবে। এগুলো পরিশোধিত হয়ে খুচরা বাজারে আসতে আরও ২ মাস সময় লাগবে। সব মিলিয়ে আরও ৪ মাস সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে সয়াবিন তেল আমদানি হয় ব্রাজিল, কানাডা, ইউক্রেন, চীন থেকে। এসব দেশ থেকে বাড়তি দামে সয়াবিন আসতে কমপক্ষে তিন মাস সময় লাগবে। সেগুলো পরিশোধিত হয়ে বাজারে আসতে সময় লাগবে আরও ২ মাস।

কিন্তু মিল মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে এখনই দাম বাড়াতে চাচ্ছে। অথচ এসব তেল কমপক্ষে তিন মাস আগে আমদানি করা হয়েছে। তখন সয়াবিনের দাম ছিল প্রতি টন ১ হাজার ৬০০ ডলার এবং পাম অয়েলের ১ হাজার ১৬০ ডলার। কম দামে তেল আমদানি করে বেশি দামে বিক্রির জন্য একটি সিন্ডিকেট উঠেপড়ে লেগেছে। তারা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দাম বাড়াতে চাচ্ছে। এদিকে সরকার দাম না বাড়ালেও মিল মালিক ও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।

আমদানি করা পাম অয়েলের মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ টন শিল্প খাতে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রুটি, বিস্কুট, তৈজসপত্র রয়েছে। বেশি দামে পাম অয়েল আমদানির কারণে এগুলোর দামও বাড়বে।

জানা যায়, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পাম অয়েল আমদানি করে ভারত। দ্বিতীয় স্থানে চীন, তৃতীয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং চতুর্থ স্থানে পাকিস্তান। বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষ ১০ আমদানিকারক দেশের মধ্যে রয়েছে।

এদিকে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা মেটাতে তেলবীজ উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে পাম উৎপাদনে এখন বেশি নজর। কেননা পাম অয়েলে লাভ বেশি। এক একরে পাম চাষ করে মাসে এক লাখ টাকা আয় করা সম্ভব। প্রতি গাছে মাসে ১ হাজার টাকা আয় হয়। একটি পরিবারের সারা বছরের চাহিদা মেটাতে দুটি গাছই যথেষ্ট। একবার বিনিয়োগ করলে ৬০-৭০ বছর আয় করা যায়। রোপণের ৩-৪ বছর থেকেই ফল দিতে শুরু করে। অন্যান্য গাছের চেয়ে ১০ গুণ বেশি অক্সিজেন দেয়।

দেশে বর্তমানে ৭ লাখ ২৪ হাজার একর জমিতে পাম চাষ করা হয়। এ চাষাবাদ আরও ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রায় ২০ লাখ হেক্টর জমিতে চাষ করা সম্ভব। পাম ফল সিদ্ধ করে পিষে তেল বের করা যায়। মেশিনেও করা যায়। টঙ্গীর মাজুখানে ইতোমধ্যে পাম অয়েল পরিশোধন কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কুমিল্লায়ও পাম চাষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে পাম অয়েল থেকে তেল পরিশোধনের যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এখন পর্যন্ত ২০ লাখ পামচারা রোপণ করা হয়েছে।-যুগান্তর