Home প্রচ্ছদ বিপন্নপ্রায় তিতপুঁটি ও নারিকেলি চেলার প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন

বিপন্নপ্রায় তিতপুঁটি ও নারিকেলি চেলার প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন

33

ডেস্ক রিপোর্ট: এবার একসঙ্গে ফিরছে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির দুই মাছ তিতপুঁটি ও নারকেলি চেলা। অত্যন্ত সুস্বাদু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নারকেলি মাছটি যেমন খুবই জনপ্রিয়, তেমনি তিতপুঁটির চচ্চরি পছন্দ করেন না এমন ভোজনরসিকও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ মাছ দুটি এখন বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে। তবে আশার কথা হলো, সম্প্রতি মিঠা পানির মাছ দুটির কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করেছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা।

চলতি বছরের মে মাসে এই সফলতা অর্জিত হয়। ইনস্টিটিউটের নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র থেকে নারকেলি চেলা ও ময়মনসিংহের স্বাদুপানি কেন্দ্র থেকে তিতপুঁটি মাছের কৃত্রিম প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করা হয়। চেলা মাছের প্রজনন গবেষণায় ছিলেন প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. খোন্দকার রশীদুল হাসান, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. ইশতিয়াক হায়দার ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তাশরিফ মাহমুদ মিনহাজ ও শ্রীবাস কুমার সাহা। আর তিতপুঁটি মাছের গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. অনুরাধা ভদ্র, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সেলিনা ইয়াসমিন ও মো. শাহীন আলম।

এ প্রসঙ্গে গবেষক শাহীন আলম বলেন, ‘মলা, ঢেলা, পুঁটি ইত্যাদি মাছ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর পুষ্টির অন্যতম উৎস হিসেবে একসময় বিবেচিত হতো। কিন্তু এসব মাছের উৎপাদন প্রাকৃতিক জলাশয়ে কমে যাওয়ায় পুষ্টি থেকে সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে। তাই মানুষের পাতে এসব মাছ ফিরিয়ে আনতেই আমরা কাজ করছি।’

বিএফআরআই জানিয়েছে, নারকেলি চেলা বা কাটারি মাছটি নদী, পুকুর, বিল, হ্রদ ও খালের তলদেশে বসবাস করে। সুস্বাদু হওয়ায় উত্তরাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছটি খুবই জনপ্রিয়। মাছটিতে মানবদেহের জন্য উপকারী অণুপুষ্টি উপাদান ভিটামিন ‘এ’ ও জিঙ্ক বিদ্যমান রয়েছে। এই মাছের প্রাচুর্যতাও বর্তমানে প্রকৃতিতে ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রজাতিটি বিপন্নের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র সৈয়দপুরের বিজ্ঞানীরা গত ২০২১ সালে উত্তরাঞ্চলে তিস্তা ও চিকলী নদী থেকে পাঁচ-সাত গ্রাম ওজনের নারকেলি চেলা মাছ সংগ্রহ করে উপকেন্দ্রের পুকুরে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, একটি পরিপক্ব (১০-১৭ গ্রাম) ওজনের নারকেলি চেলার ডিম ধারণক্ষমতা ওজনভেদে ২ হাজার ৫০০ থেকে ১১ হাজার ৫০০ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

অন্যদিকে, তিতপুঁটি মাছটি একসময় দেশের নদীনালা, খালবিল, হাওর-বাঁওড় ও পুকুরে পাওয়া যায়। একসময় তিতপুঁটি মাছের চচ্চরি দিয়ে অনেকের রসনা পূরণ হতো। মাছটি বাংলাদেশসহ ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে পাওয়া যায়। আইইউসিএন ২০১৫-এর তথ্য অনুযায়ী, মাছটি বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তিতপুঁটির শরীর রুপালি রঙের এবং বক্ষ পাখনার ওপরে একটি এবং পুচ্ছ পাখনার গোড়ায় একটি গোলাকার কালো ফোঁটা রয়েছে।

এই মাছে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান এবং অন্যান্য অনুপুষ্টি পর্যাপ্ত পরিমাণে রয়েছে, যা মানবদেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টি, ভিটামিন, মিনারেল ও খনিজ লবণের চাহিদা পূরণ করে। মাছটি অ্যাকুরিয়ামের বাহারি মাছ হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। তিতপুঁটি সিদল ও শুঁটকি তৈরিতেও প্রচুর ব্যবহৃত হয়। মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ২০২১ সালে ময়মনসিংহের বিজ্ঞানীরা নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এবং ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে সংগ্রহ করে কেন্দ্রের পুকুরে গবেষণা শুরু করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছটির প্রজননকাল মে থেকে আগস্ট। তবে সর্বোচ্চ প্রজননকাল জুন মাসে।

গবেষকেরা জানান, প্রযুক্তি দুটি উদ্ভাবনের ফলে নারকেলি চেলা ও তিতপুঁটি মাছের পোনাপ্রাপ্তি ও চাষ সহজতর হবে এবং মাছ দুটি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি মাছের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষিত হবে।

এ প্রসঙ্গে ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, দেশীয় ছোট মাছ বাঙালির সংস্কৃতি ও কৃষ্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই বিপন্ন প্রজাতির মাছ দুটি টিকিয়ে রাখতেই গবেষণায় হাত দেওয়া হয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত দেশে বিপন্ন প্রজাতির ৬৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে নারকেলি চেলা, তিতপুঁটিসহ মোট ৩৬ প্রজাতির মাছের জিনপুল সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব দেশীয় বিপন্ন মাছের প্রজনন কৌশল উদ্ভাবন করে তা ফিরিয়ে আনা হবে।

উল্লেখ্য, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ফিরিয়ে আনা উল্লেখযোগ্য মাছের মধ্যে রয়েছে পাবদা, গুলশা, টেংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, গজার, রাণী, বাতাসি, পিয়ালি ইত্যাদি।
-ইত্তেফাক