Home মতামত বাঁকা চোখে আঁকা ছবি!!!

বাঁকা চোখে আঁকা ছবি!!!

39

সরদার মোঃ শাহীন

সেদিন সকাল সকালই রওনা দিয়েছিলাম। ময়মনসিংহ যাবার কথা আসলেই সকাল সকাল রওনা দেই। এটা এক ধরণের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। অভ্যাসবশত আজও তাই করার কথা। তবে কেমন করে যেন আজ একটু দেরী হয়ে গেল। বেলা আটটা বেজে গেল। দেরী হওয়াতে রাস্তায় আটকা পড়ার শঙ্কা ছিল। গেল কয়েক বছরে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে ঘন্টার পর ঘণ্টা লাগার বিষয়টি শঙ্কায় রূপ নিয়েছে। নেয়াটাই স্বাভাবিক।
এই তো গতবারের কথা। উত্তরা থেকে রওনা দিয়ে গাজীপুর যাবার কথা মনে হলেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যেত। মন গাইগুই করতো। না যাবার নানা বাহানা খুঁজতো। কোনভাবে না যাবার সামান্যতম সুযোগ থাকলেই যাত্রা বাতিল করতাম। আর অগত্যা যদি যেতেই হতো, ফজর পড়ে রওনা দিতাম। সবার ঘুম থেকে জাগবার আগেই একেবারে ফাঁকা সড়কে গাজীপুর চৌরাস্তা পাড়ি দিয়ে গন্তব্যে। গন্তব্যে পৌঁছার আগেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম শুধুমাত্র গাজীপুর চৌরাস্তা ভালোয় ভালোয় পাড়ি দিতে পেরেছি বলে।
তবে ফেরার পথে স্বস্তিও ছিল না, নিস্তারও ছিল না। ছিল বরং উল্টো অনুভূতি। ২০ মিনিটের পথ; গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে উত্তরার। লাগতো কয়েক ঘণ্টা। গেল কয়েক বছর ধরেই লাগতো। এই কয়েক বছরে গাজীপুরবাসীর প্রচন্ড বিরক্তি, অমানুষিক কষ্ট, নিদারুণ ভোগান্তি কোনদিনও ভুলে যাবার মত নয়। পাশাপাশি তাদের সহ্যশক্তি আর ধৈর্য্য ধারণের বিষয়টিও ছিল দেখার মত। তবে এসব দেখিয়ে গাজীপুরবাসী সমবেদনা আর প্রশংসা পেলেও বিআরটি প্রজেক্ট সংশি−ষ্ট কারোরই প্রশংসা পাবার সুযোগ নেই।
সুযোগ নেই দায়িত্বে অবহেলার দায় থেকে মুক্তি পাবারও। মুক্তি শুধু জনতার আদালত থেকে নয়, বিচারিক আদালতে নিয়ে গেলেও হবে না। জবাবদিহি তাদের করতেই হবে। কেননা তাদের এই অব্যবস্থাপনার দায় পুরোটাই নিতে হয়েছে সরকারকে। সরকার গাজীপুরবাসীর গালি খেয়েছে নিত্যদিন। খাবার জন্যে গালি নিশ্চয়ই মিষ্টান্ন ভান্ডারের কোন আইটেম নয়। যে গাজীপুর আওয়ামীলীগের অন্যতম ঘাঁটি, সেই গাজীপুরে আওয়ামী সরকারকে প্রকাশ্যে গালি দিয়েছে নিত্যদিনের চলার পথের যাত্রীরা। কোন রকম সংকোচ না করে একেবারেই প্রকাশ্যে; মুখ খোলে দিয়েছে।
যাত্রাপথের অমানুষিক কষ্ট তাদেরকে মুখ খোলতে বাধ্য করেছে। অবশ্য সেই দিনগুলো এখন আর নেই। এখন সময় বদলেছে। গালি দেয়া সেই সকল যাত্রীসকল এখন আর যাত্রাপথে সরকারকে গালি দেয় না। দেয় তালি। যদিও প্রকাশ্যে দেয় না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, মনে মনে দেয়। আগে গালি দিত প্রকাশ্যে আর এখন তালি দেয় মনে মনে। মানুষের মুখের গালিগুলো আজ গাজীপুরবাসীর অন্তরের তালিতে পরিণত হয়েছে। এটা এক সময়ের গালি দেয়া সেই মুখগুলোর বর্তমান মিটিমিটি চোখ দেখলেই বোঝা যায়। চোখগুলো এখন তৃপ্তিতে মাখা। তৃপ্তির ফুলঝুরিতে ঠাসা।
অথচ যেই প্রজেক্টের জন্যে ৬ বছর ধরে জনগণের এত ভোগান্তি, সেই প্রজেক্টটি এখনো চালু হয়নি। পুরোপুরি চালু হতে আরো এক বছরেরও বেশি সময় লাগবে। তবে ধীর গতির বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চরম অব্যবস্থাপনা ইতিমধ্যেই দূর হয়েছে এবং কাজের গতি অভাবনীয় রকমের বৃদ্ধি পেয়েছে। গেল ঈদের আগে অবস্থা এমন হয়েছিল যেন ঘণ্টায় ঘণ্টায় রাস্তার চেহারা বদলে যাচ্ছিল। কাজের অগ্রগতি পরিষ্কারভাবে দৃশ্যমান হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চোখের সামনেই যেন প্রতি ঘণ্টায় মিরাকল হচ্ছে। আর এই মিরাকলেই বদলে গেছে দৃশ্যপট। বদলে গেছে গাজীপুর রুটে মানুষের চলার গতি। ফিরে এসেছে জনমনে স্বস্তি।
জনগণ তো শুধু এটুকুই চায়। একটু স্বস্তিতে থাকতে চায়। আজ সকালেও যথেষ্ট স্বস্তি নিয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা চট করে পার হয়ে গেলাম। মাত্র ২৮ মিনিটে পার। চৌরাস্তা পেরিয়ে গাড়ি শা শা করে শালনা হয়ে শ্রীপুরের দিকে আগাচ্ছে। চারলেনের চমৎকার মহাসড়কটির কারণেই এভাবে আগাতে পারছে। মহাসড়কটি কয়েক বছর আগেই চালু হয়েছে। আর সড়কে এসেছে মহাগতি। কোথায়ও কোন যানজট নেই। দুর্ঘটনাও নেই। আছে শুধু স্বস্তি আর যাত্রাপথের নিশ্চয়তা।
মাশাআল্লাহ! ঢাকা শহরের ভেতরকার যানজটও এখন দিনকে দিন কমে আসছে। কমে আসছে মহাখালী টু এয়ারপোর্টের যানজটও। এয়ারপোর্টের সামনের সড়কের বিআরটি প্রকল্পের দুটি ফ্লাইওভারের একটি ইতিমধ্যেই চালু হয়ে যাওয়ায় আর অন্যটি চালুর পথে থাকায় মহাস্বস্তি নেমে এসেছে এই মহা সড়কটিতে। শহরের বাকী জায়গাতেও স্বস্তি মিলছে। মেট্রোরেলের কাজ শেষের দিকে থাকায় এর সুফল এখনই পেতে শুরু করেছে নগরবাসী।
নগরবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেলের নীচ দিয়ে উত্তরা টু মিরপুর-১২ পর্যন্ত একেবারই নতুন একটা সড়ক চালু হওয়ায় এয়ারপোর্ট সড়কের উপর চাপ অনেকটা কমেছে। মিরপুর ডিওএইচএস এবং ক্যান্টনমেন্টের ভিতর দিয়ে এই সড়কটি হওয়াতে পরম উপকার হয়েছে জনগণের। দারুণ খুশি হয়েছে রাজধানীবাসী। পাশাপাশি মেট্রোরেলের সুফল তো আছেই। মেট্রোরেল এ বছর শেষ নাগাদ মতিঝিল পর্যন্ত চালু হয়ে গেলে ঢাকা শহরের যানজট অনেকটাই কমে যাবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করে।
আমিও এসব মনে মনে ভাবতে ভাবতে কখন যে গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে যাত্র ৫০ মিনিটে ভালুকা এসে পৌঁছেছি আর মহাসড়ক ছেড়ে শাখা রোডে নেমে গফরগাঁওয়ের দিকে যাচ্ছি টেরও পাইনি। সত্যি! সড়ক ব্যবস্থা বদলে গেলে বদলে যায় গ্রাম জনপদ। বদলে যায় জনপদের জীবনযাত্রা। এটা এখন বেশ বোঝা যায়। গ্রাম এখন প্রচন্ড দ্রুত গতিতে বদলাচ্ছে। টিনের ঘরবাড়ি ভেঙে উঠছে একতলা দোতলা দালান ঘর। পাশেই চিরচেনা ধানের ক্ষেত। বোরো ধানের ক্ষেত। হালকা বাতাসে ধানের শিষের সোনালী আভায় দোঁলা দিচ্ছে মৃদুমন্দ বাতাস।
বৈশাখের এরূপ শান্ত বাতাস বড় মিষ্টি হয়। পরিবেশও হয় শান্তির। বোরো ধানের বাম্পার ফলনে এবছর কৃষকের মনেও শান্তি, ঘরেও শান্তি। আশপাশ তাকিয়ে যতটুকু দেখছিলাম, ধানকাটা প্রায় শেষের দিকে। এ বছর সরকারও বেশ সফল এই কাজটিতে। আগাম বন্যার আশঙ্কায় হাওর এলাকায় সরকারি উদ্যোগে ধানকাটা শুরু হয়েছিল প্রায় ১০ দিন আগেই। দলের কর্মী, সাধারণ জনগণকে সাথে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সরকার।
বিশ্ব অর্থনীতিতে যে চরম মন্দা চলছে, এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়া ছাড়া সরকারে আর কোন পথও ছিল না। চরম এই দুঃসময়ে দেশের অর্থনীতিকে নির্দিষ্ট গতিতে রাখতেই হবে। আর এ ব্যাপারে সামনের সারিতে থেকে ভূমিকা রাখতে হবে আমাদের অর্থমন্ত্রীকেই। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সরকারের এই দুঃসময়ে অনেককে সামনে পেলেও কেবল এই মানুষটিকে আমরা কখনোই পাইনা। না পাই মিডিয়ায়, না পাই নিউইয়র্কের আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংকের অতীবও গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ। এমন কি সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাংক সফরের দিনেও সাথে ছিলেন না তিনি।
সাবেক অর্থমন্ত্রী মিডিয়ায় বাড়াবাড়ি রকমের বেশি বেশি আসতেন। আর বর্তমানের জন ঠিক উল্টো, আসেনই না। দুটোর একটিও কি ঠিক? শুনেছি তিনি অসুস্থ। এবং সে জন্যে সামনের সারিতে না থেকে পেছনে থেকেই মন্ত্রণালয় চালাচ্ছেন। এটা হতেই পারে। কিন্তু মন্ত্রণালয় চালানো আর দল চালানো কি একই কথা? অসুস্থই যদি থাকবেন, তাহলে নিজ জেলায় দলের সভাপতির পদটি সেদিন আবার নতুন করে নিতে গেলেন কেন? পেছনে থেকে দল চালানো কি এতই সহজ? এ কি দল চালানোর জন্যে, নাকি বেঁচে যতদিন আছি চেয়ারও ততদিন থাকবে, এই মানসিকতার ফল?
এসব মানসিকতায় স্বাভাবিকতার কোন আচরণ কি আছে? অবশ্য এদেশের রাজনীতিতে যেমনি অস্বাভাবিকতা আছে, তেমনি বলাই যায়, নাই কোথায়? অস্বাভাবিকতা সবচেয়ে বেশি আছে সমাজে, সমাজের সামাজিকতায়। প্রকৃত সামাজিকতার কোন চিহ্ন নেই আমাদের সমাজে। সমাজবদ্ধতার বিষয়টি দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। যে যেভাবে পারছে নিত্যদিন সমাজের রীতি-নীতি ভাঙছে এবং নতুন করে তৈরী করছে একটি অসামাজিক সমাজ ব্যবস্থা। এসবের ফলে একটি বৈষম্যহীন সমাজ যেমনি আজও গড়ে ওঠেনি, তেমনি গড়ার সামান্যতম লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। বরং দিনকে দিন সমাজ নষ্ট হচ্ছে।
দুঃখজনক হলো, নষ্ট হবার এই দূরাবস্থা দেখার কেউ নেই দেশটিতে। নেতৃত্বের জায়গায় বসে রাজনীতির নামে সবাই আমরা ব্যস্ত রাষ্ট্র কাঠামোর মেরামতে। অথচ সমাজ মেরামতে কেউ নেই। এদেশে রাষ্ট্র মেরামতে ক্ষমতায় যাবার এবং থাকার জন্যে আন্দোলন হয়। সমাজ মেরামতে আন্দোলন হয় না। অথচ সমাজই যদি সুন্দরভাবে না দাঁড়ায়, রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে কি করবে? রাষ্ট্রব্যবস্থায় থাকা নষ্ট এই সমাজের দুর্গতি কেবলই চেয়ে চেয়ে দেখবে!!!

-চলবে

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।