Home মতামত বহুদিন পরে, প্রশান্তের পাড়ে!!!

বহুদিন পরে, প্রশান্তের পাড়ে!!!

47

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন:

রোজা রেখে সারাদিন রোদে রোদে বাইরে ঘুরলে ইফতারের আগে আগে যেমনি প্রচন্ড পানির পিপাসা লাগে, কোয়ারেন্টাইনের নামে তথাকথিত জেলখানায় থেকে আমার শোনিমকেও একটানা না দেখে দেখে তেমনি তৃষ্ণার্ত ছিলাম আমি। অবশেষে আফছা অন্ধকারের হালকা আলোয় ওর মুখটা দেখতে পেয়ে খুব শান্তি লাগছে। হোক না সেটা এক পলকের দেখা, হোক না সেটা দূর থেকে দেখা। তবুও দেখা! তবুও শান্তি!
শান্তি আর শান্তি! মনে হচ্ছে প্রচন্ড গরমের ইফতারে বরফদেয়া পানি ঢকঢক করে গিলে খেয়েছি। তবে শান্তি ক্ষণস্থায়ী। এ্যাপ্সের মেসেজের জ্বালায় বেশিক্ষণ শান্তি ভোগ করা যায় না। একটু পরপরই মেসেজ আসে। পুংপুং করে আওয়াজ দিয়ে আসে। বদ্ধ ঘরে আটকে রেখেও জানতে চায় কোথায় আছি। এরচেয়ে মশকরার আর কিছু আছে কি! আমিও তেদরামী করি। আগে লিখতাম, রুমে আছি। এখন লিখি, শুয়ে আছি; বসে আছি। নচেৎ লিখি, টয়লেটের কমোডের উপরে আছি।
এভাবে প্রথম দু’দিন খারাপ ছিলাম না। তবে ৩য় দিন মহা বিপদ হলো আমার। জেটলেগের কারণে দু’চোখ ঘুম ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। কথায় কথায় ঘুম আসে। কখন ঘুমিয়ে পড়ি টেরও পাইনা। এদিন দুপুরের খাবার দেরী করে খেয়ে টুপ্পুস করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গভীর ঘুম। ঘুমের ঘোরে মেসেজ টের পাইনি টানা তিনঘন্টা। এদিকে এ্যাপ্সের মাধ্যমে মেসেজ আসে, ভিডিও কলও আসে। আমি সাড়া দেইনা, ওরাও আমাকে পায় না। মহা কেলেংকারী কান্ড আর কি!
ঘুম ভাঙতেই দেখি চরম খারাপ মেসেজ; আমরা ক্রসচেক পদ্ধতিতে নিশ্চিত হয়ে বুঝতে পারছি তুমি কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে নেই। নিশ্চিত ভাবেই তুমি প্রতিশ্র“তি তথা রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করেছো। রাষ্ট্রের কাছে দেয়া প্রতিশ্র“তি ভঙের কারণে তোমাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তিন রকমের শাস্তি হতে পারে। অর্থদন্ডও হতে পারে। কিংবা হতে পারে কারাদন্ড। ভিসা স্টেটাস বাতিল করে দেশ থেকে বহিস্কারের মত দন্ডও হতে পারে তোমার।
আমি শেষ। ঘুমও শেষ; দমও শেষ। মরার এই ঘুম আমাকে কঠিন বেকায়দায় ফেলে দিল। এখন বসে বসে দন্ড মাপো। জীবনে এটাও কপালে ছিল! বিনাদোষে ফাঁসি হবার মত অবস্থা। ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেলাম। ভাবতেছি তিনটি দন্ডের মাঝে কোন দন্ডটি তুলনামূলক বেটার হবে। মানে, আমাকে কিছুটা নিস্তার দেবে। অবশ্য দন্ড তো দন্ডই। এরমধ্যে ভাল আর মন্দ কি? নিস্তারেরই বা কী আছে!
ভাবতে ভাবতে বেহুশের মত বিছানায় পড়ে আছি আমি। কতক্ষণ গেছে জানি না। হঠাৎ শুনলাম, কে যেন দরজা নক করছে। একবার, দুবার। এভাবে বারবার নক করাতে দরজা খুলে দিলাম। মুখে ভাল করে মাস্ক লাগিয়ে ঠিকঠাক আছে কি না চেক করে তারপর খুলে দিলাম। ভূত দেখছি না তো! নীল পোশাক পড়া তিনজন পুলিশ দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। শুধু পিপিই পড়া নয়। মুখে হেলমেট লাগিয়ে তার উপরে পড়েছে গ্লাস কভার। প্রটেকশান যাকে বলে। করোনার বিরুদ্ধে কঠিন প্রটেকশান।
আমাকে নিতে এসেছে। যমদূত যেভাবে ফাঁসির আসামীকে ফাঁসিকাষ্ঠে ধরে নিয়ে যাবার সময় আটঘাট বেঁধে আসে, ওরাও ঠিক তেমনি ভাবে এসেছে। আইনভঙ্গের অপরাধে আমাকে বিচারের মুখোমুখি করবে। যে তিনজন এসেছে, ওর মধ্যে একটা একটু বেশি মোটা। ওর হাবভাবও বেশি। টাইটফিট প্যান্টশার্ট পড়া। হাতে হ্যান্ডকাফ নিয়ে এসেছে। আমাকে ঘরে ঢুকিয়েই কড়া হুকুম, যাও! পোটলাপাটলী যা আছে নিয়ে তৈরী হও।
আমি গোছানো শুরু করলাম। গোছানো আর কি? পোটলাপাটলী সব তো শোনিমদের রুমে। আমার সংগে আছে একটা হাতব্যাগ মাত্র। ওটার মধ্যে ল্যাপটপটা ভরে গায়ে জামা পড়ে নিব। দ্যাটস অল। টেবিলে থাকা ঔষধের পোটলাটাও ভরে নিয়েছি। তাড়াতাড়ি করো, তাড়াতাড়ি করো; মোটা ব্যাটাটার তাড়া। তাড়াহুড়ার চোটে একপায়ে মোজা ছাড়াই জুতা পড়ে নিয়েছি কেবল। অমনি হাতদুখানা এক সাথে করে পড়িয়ে দিল হ্যান্ডক্যাফ।
কে যেন হঠাৎ ফোন করলো। বড় বেসময়ে রুম ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠায় লাফিয়ে ওঠলাম। লাফিয়ে ওঠলাম মানে, বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম। খুব খারাপ স্বপ্ন দেখা থেকে বেঁচে গেলাম। যা দেখেছি এতক্ষণ বা আমার সাথে যা হয়েছে সবই অবচেতন মনের কল্পনা কিংবা তন্দ্রাচ্ছন্ন ক্ষণের স্বপ্ন মাত্র। গা থেকে ঘাম বেরুনো শুরু হয়েছে। উঠে বসেছি বিছানায়। লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছি। কী একটা খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যে যাচ্ছিলাম ভাবলে এখনো পশম দাঁড়িয়ে যায়।
অবশেষে তিনদিনের কঠিন এবং জটিল কোয়ারেন্টাইন শেষে জেলখানা তথা হোটেল চেকআউটের জন্যে শোনিমকে নিয়ে নীচে নেমে এসেছি। বড় ফুরফুরা লাগছে মন আমার। মুক্ত হাওয়ায় মুক্ত বিহঙ্গ। টানা তিনদিন পরে তিনজন একসাথে হওয়ায় মনে হচ্ছে ঈদ লেগেছে মনে। হোটেল লবীতে দাঁড়িয়ে সবাই সবাইকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে দেখছি। আনন্দে উদ্বেলিত মনে জল ছলছল চোখে।
দুপুরের হালকা রোদে লিমোজিন বাস আমাদেরকে নিয়ে হাইওয়ে বেয়ে এগিয়ে চলছে নারিতার দিকে। বাসে আমরা ছাড়াও ভারতীয়, পাকিস্তানি আর আফ্রিকানও ছিলাম। বাইরে মিষ্টি রোদ, মিষ্টি বাতাস। ভালই লাগছে। বেশি ভাল লাগছে তিনদিনের কঠিন সময় থেকে মুক্তি পাওয়াটা। আজ থেকে তিনজন একসাথে থাকতে পারবো। বদ্ধ জীবন, বন্দি জীবন কতটা যে কষ্টের তা বলাই বাহুল্য। এটা মানি, কোয়ারেন্টাইন দরকার। কিন্তু করোনা টেস্টেট নেগেটিভ রোগীদের যেভাবে কোয়ারেন্টাইন এ রাখলো, সেটার দরকার ছিল না।
এটা বাড়াবাড়ি। খুব বাড়াবাড়ি। করোনা পজিটিভ হলে ঠিক ছিল। বাড়াবাড়ি ছিল না; মেনে নিতে সমস্যা ছিল না। কিন্তু জাস্ট এক সপ্তাহের মধ্যে পরপর তিনবার টেস্টেট নেগেটিভ মানুষদের নিয়ে ওরা যা করলো। সেসব তো জাস্ট ফাজলামো। এমন জঘন্য ফাজলামো করার সামান্য দরকারও ছিল না। এটা কোয়ারেন্টাইন নয়। কোয়ারেন্টাইনের নামে মানুষকে হেয় করা। অপদস্ত করা। সুযোগ পেয়ে অপেক্ষাকৃত গরীব দেশের গরীব মানুষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। জাপানীজ অথবা আমেরিকান কিংবা বৃটিশ নাগরিক; যাদের ডাবল ডোজের টিকা নেয়া, তাদের বেলায় এই আইন নেই। তারা সোজা ইমিগ্রেশান করে বাসায় চলে যাচ্ছে। কারণ কি? কারণ একটাই। তারা পূর্ণডোজের টিকা নিয়েছেন। পূর্ণডোজের টিকা তো আমরাও নিয়েছি। মেইড ইন বাংলাদেশি টিকা নয়। অক্সফোর্ডের টিকা। ওরা যে টিকা নিয়ে কোয়ারেন্টাইন মাফ পেয়ে গেল। সেই একই টিকা নিয়ে আমরা মাফ পেলাম না। আটকা পড়ে গেলাম।
কারণ তো আর কিছু হতে পারে না। কারণ একটাই। তা হলো, আমরা বাংলাদেশি। ৩য় বিশ্বের নাগরিক। আমাদের বেলায় আইন ভিন্ন। আমরা অচ্ছুত। আমরা নোংরা। বাংলাদেশি, ভারতীয়, পাকিস্তানি কিংবা আফ্রিকানরা আবার মানুষ হয় কেমনে! অমানুষদের চোখে মানুষ হওয়া কি এতই সোজা! বড় বিচিত্র এই পৃথিবী। বড় বিচিত্র পৃথিবীর নিয়মকানুন। এখানে বড়দের বড় বড় কথা আছে। নীতি কথা। কিন্তু সবই ওদের জন্যে করা। আমাদের জন্যে কিচ্ছু নেই। আমরা অসহায়।
বড় অসহায় এই আমরা এখন বাসায় যাচ্ছি। সেখানেও শান্তি নেই। আছে কোয়ারেন্টাইন। ১১ দিনের বাকী কোয়ারেন্টাইন আছে ওখানে। কোর্স পুরো করতে হবে। কোন ছাড়াছাড়ি নেই। পার্থক্য কেবল এইটুকু যে, সবাই এক বাসায় একসাথে থাকতে পারবো। বাইরেও যেতে পারবো। তবে দিনে মাত্র একবার। মাত্র তিরিশ মিনিটের জন্যে। শুধু খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটার জন্যে।
এখানেও প্রত্যেককে দিনে ২ বার ভিডিও কল করে দেখবে বাসায় আছি কি না। ক্যামেরা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখবে। এটাও একখানা ছোটখাটো জেলখানা। অনেকটা গুলশানের ফিরোজার মত। খালেদা জিয়ার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সাথে ফিরোজায় অবস্থানের যে পার্থক্য, আমরা একটু পর ঠিক তেমনই এক অবস্থানের বাসায় উঠতে যাচ্ছি।
বেলা প্রায় শেষের দিকের টোকিও। বিকেল ৪টার পরপরই সন্ধ্যা নামে। সূর্যোদয়ের দেশে সূর্যাস্ত ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তার ধারে কিংবা আশেপাশের দু’চারটি ভবনে আলো জ্বলতেও শুরু করেছে। দিনের চেয়ে রাতের টোকিও বেশি সুন্দর। হাইওয়ে ধরে আমাদের সাদা মাইক্রোবাসটি তীব্র গতিতে নারিতা থেকে সেই টোকিওর দিকেই যাচ্ছে। বড় শান্ত স্নিগ্ধ বড় প্রশান্ত মহাসাগরের পাড় ধরেই যাচ্ছে!!