Home জাতীয় পদ্মা সেতু: দশ বছরে বদলে গেলো বাংলাদেশ

পদ্মা সেতু: দশ বছরে বদলে গেলো বাংলাদেশ

46

সঞ্জীব রায়: ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার অর্থায়নে পদ্মাসেতু প্রকল্প শুরু হবার পরই দুর্নীতির অভিযোগ তুলে হাত গুটিয়ে নেয় দাতা সংস্থাগুলো। পদ্মাসেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে সংকট, সংশয় আর সন্দেহের কালো ছায়া নেমে আসে জাতির জীবনে। সেই অন্ধকার ভেদ করে ২০২২ সালের জুন মাসে পদ্মাসেতুর আলো জ¦লে উঠেছে। অপবাদ আর মিথ্যাচারকে পরাজিত করে দশ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোলমডেল। হ্যা, এই পদ্মাসেতুই বাংলাদেশকে অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা, নিষ্ঠা, সৎসাহস আর সাফল্যের রোল মডেলে পরিণত করেছে।

বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর দেশের বোদ্ধা অর্থনীতিবিদ, নামকরা শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীরা সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে কোনভাবেই পদ্ম সেতুর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সেদিন দেশে-বিদেশে কেউই পাশে দাঁড়ায়নি। ২০১২ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সফররত জাপানের তৎকালীর উপপ্রধানমন্ত্রী কাতসুয়া ওকাদা বিশ্বব্যাংকের সাথে সমঝোতা করতে পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশকে। এছাড়া এককভাবে জাপানী অর্থায়নের সম্ভাবনাও নাকচ করে দিয়েছিলেন তিনি। রাজপথে আন্দোলন, রাজনীতিতে ষড়যন্ত্র আর পরারাষ্ট্রের অসহযোগিতার অমানিষা কাটিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাক দিলেন বাংলার মানুষকে। কঠোর ও কঠিন ভাষায় বিশ্বব্যাংকে জবাব দিলেন। মহান সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি এককভাবে জনতার শক্তিতে পদ্মাসেতু বাস্তবায়নের রূপরেখা দিলেন। কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করলেন চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে। বললেন, “বিশ্বব্যাংককেও হিসাব দিতে হবে”।

৮ জুলাই ২০১২ সালে মহান সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সেই বক্তব্য ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “আমরা নিজেরাই সেতুর কাজ শুরু করতে পারি। এরমাঝে, বিদেশিরা যদি আসতে চায়, আসতে পারে।” প্রবাসী বাংলাদেশি, দলীয় নেতা ও সাংসদসহ সবার সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন “দেশবাসীর যে অভ‚তপূর্ব সাড়া পেয়েছি, তা আমার চলার পথে পাথেয় হয়ে থাকবে।” স্কুলের শিক্ষার্থীরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে পদ্মা সেতুর জন্য সাহায্য করতে আগ্রহী উল্লেখ করে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের কৃচ্ছতা সাধন করে পদ্মা সেতুর জন্য টাকা জমানোর পরামর্শ দেন। আবারো তিনি মনে করিয়ে দেন, “বাংলার মানুষে মাথা নত করতে জানে না”। বিশ^ব্যাংকে তিনি মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশ ভিক্ষা নিতে চায় না, নেয়না; বরং ঋন নিয়ে সুদে-আসলে ফেরত দিয়ে দেয়। বাংলাদেশকে চিরতরে গরীব আর পরনির্ভর করে রাখার বিদেশি সংস্থার প্রেসক্রিপসনেরও কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।

জুন ২০১২ থেকে জুন ২০২২ – শুধু দশটি বছরের ব্যাবধানে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বদলে গেলো। এই ভাবমূর্তি নিয়ে কতো কথা, কতো বিতর্ক-আলোচনা হয়েছে যখন কথিত দূর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিলো দাতারা। দাতাদের সেই নেতিবাচক মনোভাবেরও আমূল পরিবর্তন হয়েছে এই দশ বছরে। ঠিকই দেশের মানুষের নিজস্ব শক্তিতে, আর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের দৃঢ়চেতা মনোভাবে বিদেশি দাতা ও সহযোগি দেশগুলোও তাদের হাত বাড়িয়ে দেয়া শুরু করে আবার। আজ জাপান এককভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগি দেশ। আজ বিশ্বব্যাংক রিপোর্ট প্রকাশ করে বলছে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়নে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া কতোটা এগিয়ে যাবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে যিনি একইসাথে প্রধানন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা, সজীব ওয়াজেদ জয়ও দেশের মানুষকে দিলেন এই সেতু বাস্তবায়নের কৃতিত্ব। পদ্মাসেতু যে শুধু একটি অবকাঠামো আর উন্নয়নের নিদর্শনই নয় বরং মর্যাদার প্রতীক, তা মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এটি বাঙালি জাতির গর্ব, আত্মমর্যাদা ও অহংকারের প্রতীক। এই সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব প্রতিটি বাঙালির।

২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে যারা পদ্মাসেতু নির্মাণে এগিয়ে এসেছিলেন, সাহস যুগিয়েছিলেন আর আত্মবিশ্বাসে বুক বেধেছিলেন তাদের স্বপ্ন সার্থক হবার মাস এটি। যারা দ্বিধায় ছিলেন, সংকোচ আর সংশয় প্রকাশ করেছিলন। যারা বিরোধীতাও করেছিলেন এই ভেবে যে নিজেরা পারিনা, পারবো না। তাদেও জন্যও এটি বার্তা। তাদের সংশয় শেষ হবে আশা করি। আর তারা হবেন ইতিবাচক। অন্তত এটুকু চিন্তা করতে চেষ্টা করবেন যে মাত্র দশ বছরে দেশকে একটি সার্থকতার মডেল উপহার দেয়া যায়। আত্মবিশ্বাস আর সৎসাহস থাকলেই যে সাফল্য আসে, সেই শিক্ষাটাও তারা নেবেন বোধ করি।