Home সারাদেশ নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না রাজউক

নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না রাজউক

31

অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই অনেক বেশী

স্টাফ রিপোটার: নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না রাজউক। আর অনুমোদিত ভবনের চেয়ে অনুমোদনহীন ভবনের সংখ্যাই অনেক বেশী বলে রাজউক সূত্র জানিয়েছে।
অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মিত ভবনগুলোর বিষয়ে মামলা হলেও রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের শিথিলতার কারণে ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ভবন নির্মাণে বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদ করা হচ্ছে না। নেপথ্যে অথারাইজড অফিসারদের দুর্নীতি বলে সংশ্লিস্টরা জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, রাজউকের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক এক প্রতিবেদন মতে ১৫ হাজার ৯৯৩টি ভবন পরিদর্শন করা হয়। তার মধ্যে মাত্র ২০৪টি ভবনে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। ফলে বিচ্যুতির তুলনায় উচ্ছেদের ঘটনাও নগন্য।
এদিকে রাজউক অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি বা ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভবন নির্মাণের অভিযোগে মো. মনির হোসেন রাজ গং এর নিযুক্ত ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ এর ব্যবস্থা পরিচালক সামছুল হক ফরাজী, ৩১২/৪/এম-১ (মাজেদা ইউনিটি), লালকুঠি (শাপলা হাউজিং সংগগ্ন ) ঢাকা মহানগরীর দারুস সালাম থানা। পূর্ব-কান্দির মোজাস্থিত সি এস দাগ নং-২০ (অংশ) ঢাকা রাজউক স্বারক নং রাজউক /ন অ অ-৩/৩ সি-৭২/১০.৪০৪। গত ২০১০ সালের ২৯ এপ্রিল এর মাধ্যমে মো. মনির হোসেন রাজ গং এর নিযুক্ত আমমোক্তার ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামছুল হক ফরাজীর নামে সাত তলা আবাসিক /এ-টু ইমারতের লে.আউট নকশার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে নির্মাণ কাজ করা হয়েছে বলে রাজউকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্রটি আরো জানায়, উল্লেখিত ভবনের সম্মুখ দিকে ন্যূনতম সেটব্যাক এর পরিমাপ ১.৫২ মিটার এর স্থলে ১.০০ মিটার করা হয়েছে। আর বর্ধিত করে তা নির্মাণ করা হয়েছে ১.০০ মিটার। আবার পশ্চাত দিকে ২.৬৪/১.৯৬ মিটারের স্থলে সেটব্যাক ০.৬৪ মিটার এবং বর্ধিক অংশে ২.০০ মিটার করা হয়েছে। তাছাড়া. ডান দিকে ১.৫০ মিটরের স্থলে সেটব্যাক এর কোন জায়গা না রেখে বর্ধিত অংশে ১.৫০ মিটার রাখা হয়েছে। আর বাম দিকে ২.১৮ মিটারের স্থলে সেটব্যাক রাখা হয়েছে ৭.৭৮ মিটার এবং ১.৪০ মিটার বর্ধিত করে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।
এছাড়াও অনুমোদিত লে. আউট নকশা অনুযায়ী সিড়ি, লিফট না রেখে ভবনের অবস্থান পরিবর্তন করে নির্মাণ করা হয়েছে। আবার উল্লেখিত ভবনের নীচ তলায় আর সামনের দিকে সেটব্যাক এর সাথে দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে ভবনটি ৮ তলা (সাত তলার উপরে অর্ধেক অংশে ফ্ল্যাট ) নির্মাণ করা করা হয়েছে। এতেই প্রতিয়মান হয়ে যে, উক্ত ডেভলোপার কোম্পানী ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে ইমারত বা ভবন (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘণ করে ভবন নির্মাণের কাজ করা হয়েছে।
রাজউকের সংশ্লিস্ট সূত্র জানায়, এসব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তপূর্বক গত ২০২২ সালের ২৩ জুন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জোনাল অফিস. মহাখালী ঢাকা এর অরাইজড অফিসার-৩-১ স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে উল্লেখিত ভবন নির্মানের বিষয়ে ব্যত্যয়কৃত অংশ কেন ভেঙে ফেলা হবে না, তা উক্ত ‘ইউনিটি বিল্ডার্স এন্ড হাউজিং লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সামছুল হক ফরাজী এবং মো. মনির হোসেন গং এর কাছে কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। আর ওই পত্রের অনুলিপি কপি রাজধানীর দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)’র কাছেও প্রেরণ করা হয়। কিন্তু ওই পত্র প্রেরণের পর রাজউকের সংশ্লিস্ট জোনের অথারাইজড কর্মকর্তাসহ জালিয়াতচক্রের সদস্যরা অনৈতিকভাবে লাভবান হয়ে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি বলে জানা গেছে।
অপরদিকে রাজধানীর পূর্ব রামপুরা এলাকার বাসিন্দারা গত ৮ জানুয়ারি রাজউকের চেয়ারম্যানের কাছে এক লিখিত অভিযোগ করেছেন। উক্ত অভিযোগে বলা হয়েছে, পূর্ব রামপুরার জাকের রোডস্থ ২৪৮, ২৪৬/২-এ নম্বর ভবনগুলো রাজউকের অনুমোদিত নকশা মতে নির্মাণ করা হয়নি। ফলে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ন বলে তারা ধারণা করছেন। আর একই অভিযোগ গত ২৬ জানুয়ারি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। উক্ত অভিযোগে ২৪৬/১, ২৪৭/১ ও ২৪৮/১ ভবনগুলো অত্যান্ত ঝুঁকিপুর্ন যে কোন সময় বড় ধরণের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
অভিযোগে জানা গেছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর সংশ্লিস্ট প্রকৌশলী জোটন দেবনাথ ও তার সহযোগিদের ছত্রছায়ায় অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে রাজউকের অনুমোদিত নকশার বিচ্যুতি ঘটিয়ে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে রাজউকের জোন – ৬ এর অথারাইজড অফিসার প্রকৌশলী জোটন দেবনাথ এর সেল ফোনে একাধিকার বার ফোন করা হলেও তিনি তার ফোনটি রিসিভ করেননি। পরে তার সহকারী অফিসার আওরঙ্গজেব নান্নু মিয়া ও আমিনুল ইসলামের সেল ফোনে যোগাযোগের চেস্টা করা হলেও তাদের সঙ্গেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
রাজউকের এক সূত্র জানায়, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন ও তদারকির দায়িত্বে থাকা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকায় গত ২০০৬-১৬ সাল পর্যন্ত নতুন স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে ৯৫ হাজার। এর মধ্যে অনুমোদন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে কেবল ৪ দশমিক ৬ শতাংশ অবকাঠামো। এছাড়া, ২০২২-৩৫ সালের জন্য করা বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (ড্যাব)অনুমোদন ছাড়া নির্মিত ভবন বৈধ করতে। এজন্য ড্যাপের আওতায় বিধিমালা প্রণয়নে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়। আর ওই কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগ-১-এর অতিরিক্ত সচিবকে।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ধরণের ব্যত্যয় শুধু জরিমানার বিনিময়ে বৈধ করা শহরের বাসযোগ্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।একই সঙ্গে উৎসাহিত হতে পারে অবৈধভাবে নির্মাণকাজ। তাছাড়া যেসব স্থাপনা অননুমোদিত কিংবা বিধিমালা বা অনুমোদনের শর্ত ভেঙে নির্মিত হয়েছে, তা অপসারণের বিধান বিদ্যমান ইমারত বিধিমালাতেই রয়েছে। ফলে বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো ধরনের ব্যত্যয় বহাল রেখে জরিমানার মাধ্যমে সেই স্থাপনা বৈধ করার সুযোগ নেই।
একজন নগর পরিকল্পনাবিদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কয়েকদিন আগে তুরস্ক-সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে জানানো হয়েছে, জরিমানা দিয়ে যেসব অবৈধ ভবন বৈধ করা সেগুলোই বিধ্বস্ত হয়েছে। এজন্য কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাদেরও বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। ছোট একটি সিদ্ধান্ত যেন বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়।’