Home সারাদেশ ধর্ষণ মামলার আসামী রাজশাহী বিএম কলেজ অধ্যক্ষ মারুফ বহাল

ধর্ষণ মামলার আসামী রাজশাহী বিএম কলেজ অধ্যক্ষ মারুফ বহাল

64

পাভেল ইসলাম মিমুল রাজশাহী অফিস:
ধর্ষণ মামলার আসামী হয়েও গুরুত্বপূর্ণ দুটি পদে বহালতবিয়তে রাজশাহী হড়গ্রাম মডেল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ ড. মারুফ হোসেন। তার বিরুদ্ধে একই কলেজের এক নারী প্রভাষক নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় ধর্ষণ মামলাটি দায়ের করেছেন। ইতোমধ্যে এই মামলায় তিন তিনবার আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন তিনি। বাদির আইনজীবি জানান, মামালা রজু হওয়ার পর কিছুদিন পলাতক থেকে উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের জামিন পান তিনি। এরপর ধার্য তারিখে রাজশাহীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে হজ্জে যাওয়ার কারন দেখিয়ে দ্বিতীয়বার জামিন পান অধ্যক্ষ ড. মারুফ। সেই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে ধার্য তারিখে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে হাজির হয়ে এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন বলে তৃতীয় বারের মত জামিন পান তিনি।

আসামী ড. মারুফ হোসেন রাজশাহীর হড়গ্রাম ইউনিয়নের ফুদকীপাড়া খিরশিন টিকর এলাকার আমজাদ হোসেনের ছেলে। বর্তমানে তিনি রাজশাহী হড়গ্রাম মডেল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি তিনি কারিগরি শিক্ষক সমিতির মহানগরের সাধারণ সম্পাদকের পদেও রয়েছেন। এখন প্রশ্ন উঠেছে এমন নেক্কারজনক ঘটনার পর তিনি কিভাবে এসব পদে থাকেন। কমিটির একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, একজন ধর্ষণ মামলার আসামী শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত এমন সুশৃংখল সংগঠনে থাকার অধিকার রাখে না। এতে করে সংগঠনের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।

এছাড়াও কলেজের অধ্যক্ষ পদে থাকারও তার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। তবে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ সব কিছু জানার পরেও কেনো এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছেন না তা তাদের বোধগম্য নয়।

বিশ্বস্তসূত্রে জানা গেছে, অধ্যক্ষ মারুফ বিপুল অর্থ সম্পদের মালিক। টাকা আর সংগঠনের প্রভাব খাটিয়ে তিনি সবকিছু ম্যানেজ করে রেখেছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতার নাম ভাঙ্গিয়েও নানা ধরনের সুবিধা নিয়েছেন তিনি। এছাড়াও মারুফের বাবা আমজাদ হোসেন এই কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি, তার দুই ভাই সদস্য, মহিলা সদস্য তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী, আর এক সদস্য অধ্যক্ষের মেজ ভাইয়ের শ্যালক,মহিলা শিক্ষক প্রতিনিধি তার ফুপাতো বোন এবং পুরুষ শিক্ষক প্রতিনিধি তার বন্ধু। নিজের সুবিধা নিতে এমন পকেট কমিটি বানিয়ে রেখেছেন মারুফ। ফলে তারাও এ বিষয়ে কোন ব্যবস্থা নেননি।

কথা হয় অভিযুক্ত অধ্যক্ষ ড. মারুফ হোসেনের সাথে। তিনি জানান, আমাকে সমাজে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই এই মামলা করা হয়েছে। বিষয়টি সংগঠন জানে। আমি তাদেরকে মৌখিক ভাবে জানিয়েছি। এখন পর্যন্ত সংগঠন আমার বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। তবে তারা কি ধরনের ব্যবস্থা নেবেন তা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অবগত আছে। তারা বিষয়টি সমঝোতা করে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

ধর্ষণ মামলার আসামী হয়ে আপনি স্বপদে বহাল আছেন কোন যুক্তিতে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলাটি আদালতে চলমান। যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে আমি দোষী সার্ব্যস্ত বা প্রমাণিত না হবো ততক্ষণ পর্যন্ত এসব পদে থাকতে কোন বাঁধা নেই।

বিষয়টি নিয়ে সংগঠনের সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক জানান, রাজশাহী বিএম কলেজের অধ্যক্ষ ড. মারুফ হোসেনের বিরুদ্ধে একই কলেজের এক প্রভাষক নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি ধর্ষণ মামলা করেছেন। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে বিচারাধীন। আসামী মারুফ জামিনে আছেন। সে আমার এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের দুইজনের সাথে সম্পর্ক এবং মামলার বিয়য়ে সংগঠন অবগত আছে। অভিযুক্তের সাথে আমার মৌখিক আলোচনা হয়েছে। তাকে আমরা সতর্ক করেছি। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকেও মৌখিক ভাবে বিষয়টি জানানো হয়েছে। কেন্দ্র এখন পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত দেয়নি। কেন্দ্র যে সিদ্ধান্ত দেবে সেটা আমরা বাস্তবায়ন করবো। তবে লিখিত ভাবে কেনো জনানো হলো না এবং তার বিরুদ্ধে কেনো ব্যবস্থ নেয়া হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তার বিরুদ্ধে কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা অচিরেই লিখিত ভাবে জানাবো। তবে এমন ঘটনায় আমরা বিব্রত।

চলতি বছরের ২১ এপ্রিল কলেজের অধ্যক্ষ ড. মারুফ হোসেনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করেন একই কলেজের এক প্রভাষক। মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, আসামী মারুফ মামলার বাদির আপন মামাতো ভাই এবং রাজশাহী হড়গ্রাম মডেল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ। চাকরির সুবাদে বাড়িতে এবং কর্মস্থলে তার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে।

এই সম্পর্কের সুযোগ নিয়ে ২০১৬ সালের ২০ আগস্ট ভুক্তভোগীর বাড়িতে কেউ না থাকায় তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ধর্ষণ করে এবং বিষয়টি কাউকে জানালে চাকরির সমস্যা হবে বলে হুমকি প্রদান করে। ঘটনাটিকে পুঁজি করে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ প্রায় ৭ বছর ঐ নারীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক চালিয়ে যায় অধ্যক্ষ ড. মারুফ।

মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভয়-ভীতি দেখিয়ে কলেজের বিভিন্ন কাজ ও প্রোগ্রামের অজুহাতে ২০১৭ সালের ৭ মার্চ থেকে ৮ মার্চ ঢাকার ফার্মগেটে হোটেল সুপার স্টারের ১৬ নং রুমে, ২০১৯ সালে ৮ মে থেকে ৯ মে ৪ নং রুমে, ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর চাঁপাইনবাবগঞ্জের হোটেল আল নাহিদ, ২০১৭ সালে ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর এবং ২০১৮ সালের ০১ জানুয়ারী হতে ০২ জানুয়ারী আগারগাঁও বোর্ড রেষ্ট হাউজ, ২০২২ সালের ১৮ অক্টোবর হতে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত শহীদ বুদ্ধিজীবী হোস্টেলের (নায়েম) অষ্টম তলার ৮১১ নং কক্ষে, ২০২২ সালের ১১ ডিসেম্বর হতে ১২ ডিসেম্বর এবং ঐ বছরের ৩০ ডিসেম্বর হতে ২০২৩ সালের ০২ জানুয়ারী পর্যন্ত শ্যামলীর স্যাপ বাংলাদেশ রেষ্ট হাউজে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে সরিয়াহ্ মোতাবেক বিয়ের কথা বললে তাতে আসামী মারুফ অস্বীকৃতি জানায়। এবং ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে কর্মস্থলে নানা ধরনের মিথ্যে অভিযোগ আনেন। পরে ঐ প্রভাষক নারী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় মারুফ হোসেনকে আসামী করে মামলা দায়ের করেন।

ভুক্তভোগী ঐ নারী গনমাধ্যমকে জানান, মামলা করার পূর্বে সমস্যার প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সচিব, পরিচালক (কারিকুলাম), রাজশাহী জেলা প্রশাসক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা রাজশাহী অঞ্চলের উপ-পরিচালক, মতিহার থানা শিক্ষা অফিসার, বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন), বাংলাদেশ বি এম টি কলেজ শিক্ষক কল্যাণ সমিতির আহবায়ক বরাবর আবেদন করেও কোন ফল পাইনি। নিরুপায় হয়ে আইনের আশ্রয় নিয়েছি। ভুক্তভোগী ঐ নারী অভিযোগ করে বলেন, সেখানেও তদন্তের নামে কালক্ষেপন করা হচ্ছে। আসামী নানা ভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রেও সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিতকরে আমাকে একা করে রেখেছে অধ্যক্ষ মারুফ।

সর্বশেষ চলতি মাসের ১৭ আগস্ট কলেজের কয়েকজন শিক্ষক অন্যান্য শিক্ষক কর্মচারীদের সামনে আমাকে মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে এবং কলেজ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে ৯৯৯ এ ফোন দিলে নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানা পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন।

এ ঘটনায় কলেজের শিক্ষক প্রতিনিধি বাংলা প্রভাষক মোঃ গোলাম কবির আজাদ, ব্যবস্থাপনা বিষয়ের প্রভাষক মোঃ মাহমুদুর রহমান শিমুল, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক রাকিবুল ইসলাম এবং কম্পিউটার বিভাগের প্রভাষক তাইজুল ইসলামের নামে কাশিয়াডাঙ্গা থানায় সাধারণ ডায়েরী করেছি। তিনি বলেন, আসামী হড়গ্রাম মডেল টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড বিএম কলেজের অধ্যক্ষ ড.মারুফ হোসেন বিভিন্ন ভাবে প্রভাব খাটিয়ে মামলাটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তিনি এই জঘন্যতম ঘটনার সঠিক তদন্তের জন্য প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানান।