স্টাফ রিপোর্টার ক’দিন পরেই রমজান। দুনিয়ার বহু দেশে ব্যবসায়ীরা সারা বছর ব্যবসা করে এই মাসে ভোক্তার সেবা করে। আর বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা পবিত্র এই মাসে সবচেয়ে বেশি মুনাফা লুটে। কেবল পণ্যের দামই বাড়ায় না, ভেজাল মেশাতেও দ্বিধা করে না। বিগত কয়েক বছর ধরে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট তাদের মুনাফা লুটের কৌশল খানিকটা পাল্টিয়েছে। আলোচনা এড়াতে তারা রমজানের দু’মাস আগেই বাড়িয়ে দেয় নিত্যপণ্যের দাম। এবারো তার ব্যতিক্রম হয় নি। তাই বাজারে রমজানের আঁচ লেগেছে আরো আগে। সেই আঁচে জ্বলছে ক্রেতার পকেট। বাজার বিশ্লেষকদের আশঙ্কা নিত্যপণ্যের উর্ধ্বমুখী পাগলা ঘোড়া রমজানে আরো বেপরোয়া হবে। ফলে রমজানে সেহরি ও ইফতার নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন গরিব-মধ্যবিত্তরা।

বহু আগেই তো মধ্যবিত্ত এবং সীমিত আয়ের মানুষের ভাতের থালা থেকে মাছ-মাংস উঠে গেছে। শ্রমজীবী মাছ, মাংস, ডিম তো দূরের কথা, তিন বেলা খাবার জুটাতেই হিমশিম খাচ্ছেন। অনেকে খাবারের সময়’ই কমিয়েছেন। তিন বেলার জায়গায় দু’বেলা খেয়েও সংসারে চলছে টানাটানি। কোনো রকমে টিকে থাকার লড়াই করছেন। ফলে রমজান যত এগিয়ে আসছে গরিব-মধ্যবিত্তের কপালে চিন্তার ভাঁজ ততো বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে বাজারের অস্থিরতা। ইতোমধ্যে বাজারে রমজানের আঁচ লেগেছে। বেড়ে গেছে সকল নিত্যপণ্যের দাম। সাধারণ মানুষের হাপিত্যেশ শুরু হয়েছে। কি করে পার হবে রমজান!

সূত্রমতে গত রমজানেও রোজাদারদের সেবায় ৮০০টিরও বেশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানোর ঘোষণা দেয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার। অথচ আমাদের দেশে তার উল্টো চিত্র। এবারও রমজান আসার আগেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। আকাশচুম্বী মুরগির বাজার। গরু-খাসিতে তো হাত’ই দেওয়া যায় না। এছাড়া অগ্নিমূল্য রমজানে অপরিহার্য অন্যান্য নিত্যপণ্যের। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র মতবিনিময় সভা এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একাধিক বৈঠকে ব্যবসায়ীরা ‘আশ্বাস’ দিয়েছিলেন, রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না। কিন্তু সে ‘আশ্বাস’ সভা-সেমিনারেই রয়ে গেছে। ব্যবসায়ীদের প্রতিশ্রুতির ছিটেফোঁটাও মিলছে না বাজারে। রমজান শুরু হওয়ার আগেই আরেক দফা বেড়েছে কয়েকটি নিত্যপণ্যের দাম।

রমজান মাসে ইফতারি তৈরিতে ছোলা, অ্যাঙ্কর ডাল ও বেসন বেশি ব্যবহার হয়। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা রোজার দুই সপ্তাহ আগেই ছোলায় কেজিতে বাড়িয়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। ৮৫ থেকে ৯০ টাকা কেজির ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকা। ছোলার তৈরি বুটের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। বাজারে ছোলাবুট বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকা দরে। অ্যাঙ্কর ডালের দামও বেড়েছে। এক কেজি অ্যাঙ্করে ১০ টাকা বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এ ছাড়া বেসনের কেজি ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।

রমজানে খেজুরের দাম ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। তা শুনেই বাজারে খেজুরের দাম চড়তে শুরু করেছে। কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে সপ্তাহ সাধারণ মানের জাহেদি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা দরে। ভালো খেজুরের দাম বেড়েছে আরো বেশি। আজোয়া ও মরিয়ম জাতীয় খেজুরের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। এই দুই খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৭০০ থেকে ৮৫০ টাকা দরে।

সরকারি দর মানা হচ্ছে না ভোজ্যতেলে। করোনার পর থেকে ভোজ্যতেলের বাজারে যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে, তা এখনো চলছে।

গত ছয় মাসে চিনি দাম চার বার বাড়ানোর পরও চিনির বাজারের হৈচৈ থামছে না। আমদানিতে শুল্ক কমানো, অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার করার পরেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না চিনির বাজার। প্রতি কেজি খোলা চিনি ১১৫ থেকে ১২০ এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া লাল চিনি (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকা দরে।

এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে দেশি পেঁয়াজ ৩০ থেকে ৪০ এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

মাছ-মাংস এখন অনেকটাই স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। গরিব মানুষ তো দুরের কথা মধ্যবিত্তরাও মাছ-মাংস কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাজারে বয়লার বিক্রি হচ্ছে ২৪০ থেকে ২৫০ টাকা, সোনালি জাতের মুরগি ৩৩০ থেকে ৩৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ডিমের বাজারও কিছুটা বেশি। প্রতি হালি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা। গরুর মাংসের দাম ৬৫০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। গরিবের তেলাপিয়া, পাঙাশ ও চাষের কই আর গরিবের ঘরে যাচ্ছে না। তেলাপিয়ার কেজি ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। কই কিনতে গেলেই কেজিতে গুনতে হচ্ছে ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা। চিংড়ি, ইলিশ কেনা তো বিলাসিতা।

লেবুর বাজারও বেশ চড়া। হঠাৎ করেই অস্থির হয়ে গেছে। এক হালি লেবু আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে প্রতিটি লেবুর দাম পড়ছে প্রায় ১৩ থেকে ২০ টাকা। বেগুনে তো রীতিমতো আগুন লেগেছে। রমজানে বেগুনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে আগেই ‘আগুন লেগেছে’ গোল বেগুনের কেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। লম্বা বেগুন ৫০ থেকে ৭০ টাকা। বাজারে শসার টান নেই। তবু দাম কমছে না। বেড়েছে কাঁচামরিচের ঝাল।

ব্যবসায়ীরা অজুহাত হিসেবে আমদানি খরচকে সামনে আনছে। কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার আমদানি খাতে অনেক সুবিধা দিয়েছে। তার পরেও বেশি মুনাফার নেশায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। বাড়ছে প্রতারণা।

তাই রমজানের আগেই কঠোর হস্তে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভোক্তার প্রতারণার বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। কিন্তু এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের দেখা মিলছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণে যেমন নজরদারি নেই, তেমনি নেই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের আইনগত পদক্ষেপ। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর অন্যতম অন্তরায় দক্ষ জনবল ও আইনের দুর্বলতা। তাই সবার আগে জনবল কাঠামো ও আইনের পরিবর্তন জরুরি। মানুষের প্রত্যাশা এবারের রমজানে যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।