Home মতামত থামাতে হবে রাজনীতির উল্টোযাত্রা

থামাতে হবে রাজনীতির উল্টোযাত্রা

184

ইয়াতুননেসা রুমা:
সাংবিধানিক ভাবে বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রে সকল মানুষের যেমন রাজনৈতিক অধিকার থাকে, তেমনি অধিকার আদায়ের সংগ্রামও করতে পারে। সেই সংগ্রামের জন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক দল। ’৭৫ পরবর্তী বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সামরিক শাসন যেমন টুঁটি চেপে ধরেছে, তেমনি গণতন্ত্রে থাবা হানছে পরিবারতন্ত্র। এদেশের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল আজো পরিবারততেন্ত্রর খপ্পর থেকে মুক্ত তো হতেই পারে নি, বরং পরিবারতন্ত্র পরিপূর্ণভাবে বাসা বেঁধেছে।
এই পরিবারতন্ত্রের খপ্পর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বাঁচাতে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে লড়াইয়ের অগ্রভাগে থাকা ছাত্র সমাজ বার বার চেষ্টা করেছে, আজো করছে। এদেশের অনেক প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন সুস্থধারার গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় চেষ্টা করছে। তার জন্য ছাত্র রাজনীতিতে অতীতের মতো মেধাবী ও রাজনীতি সচেতন ছাত্রদের প্রয়োজন। কিন্তু কেবলমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী পরিবারতন্ত্র কায়েমের কর্তাবাবুরা রাজনীতিতে আাধিপত্য বিস্তারের নেশায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজনীতি বিমুখ করার জন্য অভিনব সব কৌশল অবলম্বন করছে। মাঝে মাঝেই ছাত্র রাজনীতিতে লাঠিয়াল বাহিনী, টেন্ডারবাজ, সুবিধাবাজদের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে অরাজকতা সৃষ্টি করে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির অপচেষ্টা করে। এটা আসলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের অশুভ চক্রান্ত। প্রতিবাদের ভাষা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র। অন্যদিকে মেধাবী ছাত্র নেতাদের ব্যবহার করে ছাত্র রাজনীতিকে ক্ষমতাসীনরা উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবেও ব্যবহার করছে। ছাত্র রাজনীতি ধ্বংসের দিকে ধাপিত হওয়ার আরো একটি অন্যতম কারণ হলো নয়াউদারনৈতিক অর্থনীতি। এই নীতিতে ভোগবাদ ছাত্র সমাজকে গ্রাস করছে। তাদের চিন্তা শক্তিকে ক্রমশ্য ভোঁতা করা হচ্ছে। ছাত্ররা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। ফলে ছাত্র সমাজ জাতীয় রাজনীতি কিংবা ছাত্রদের অধিকার আদায়ের রাজনীতি নিয়ে খুব কমই ভাবে। অথচ ৯০-এর দশক পর্যন্ত জাতীয় রাজনীতির নাটাই ছিল ছাত্র রাজনীতির হাতে।
রাজনীতির এই দৈন্যতা ঘুচিয়ে গণমানুষের কল্যাণে প্রকৃত গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পরিবারতন্ত্রের হাত থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন করা এখনই জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হলো পরিবর্তনের যাত্রা শুরু করবে কে? এই ব্যাবস্থা পরিবর্তনের লড়াইয়ে নামবেন কারা!
এক্ষেত্রে আমি বলব, এখনো বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখে, তাদেরকেই জাগতে হবে।
পরিবর্তনের জন্য সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার সংবাদের অপেক্ষায় না থেকে সংবাদ তৈরির লড়াইয়ে নামতে হবে। অতীতের মতো আবারো ছাত্র রাজনীতির গৌরবাজ্জ্বোল ধারাবাহিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
অনেকেই রাজনীতির চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ক্যারিয়ারের কথা ভাবছেন। অনেক অভিভাবকও এমনটা ভাবেন যে, “আমার সন্তান যুদ্ধে যাবে না, আর সবাই যাক।” এই নীতিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয় নি। মনে রাখতে হবে উত্তমের পরাজয় মানেই অধমের জয়। রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র মেনে নেয়ার মানসিকতা যদি ছাত্র নেতাদের মধ্যে দেখা দেয় তবে সেই তরুণ নেতৃত্বের মাঝে নির্বীর্যের অভিশাপ লাগে। এর মানে হলো এই নেতৃত্ব দ্বারা সংগঠন সেখানেই ধ্বংসের সূচনা হয়। পারিবারিক রাজনীতির ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা তখনই পরম শ্রদ্ধার আসনে পৌঁছায়, যখন উত্তরসূরিরা পূর্বসূরিদের ছাপিয়ে যেতে পারে নিজ যোগ্যতায়। তবে আমার যতটা মনে হয় রাজনীতিতে সেই উদাহরণ খুবই কম রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে যা দেখি তার পেছনের কারণ হলো রাজনৈতিক উত্তরসূরিদের জন্য অসাধারণ প্ল্যাটফর্ম সুকৌশলে সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রস্তুত করা থাকে। কিন্তু নিজে অসাধারণ না হলে সেই সাজানো-গোছানো প্ল্যাটফর্মটি হয়ে ওঠে অস্বস্তিকর। সাধারণদের মধ্য দিয়ে অসাধারণ নেতৃত্ব বের হয়ে আসার যে প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়া যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। এ দৃষ্টি প্রগতিশীল তরুণ নেতৃত্বকেই রাখতে হবে। অন্যদিকে তরুণ সমাজ বা ছাত্রসমাজকে রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব দেয়ার স্বপ্ন দেখতে হবে। অন্যথায় শক্তিশালী রাজনীতি গড়ে উঠবে না। রাজনীতির এই পরিবর্তনের জন্য রাজনীতিতে যুক্ত হতে হবে। রাজনীতি ছাড়া কোনো কিছুই পরিবর্তন করা বা অর্জন করা সম্ভব না। আমাদের যা কিছু অর্জন সবই রাজনীতির ফসল।
সেই আদিকাল থেকেই মানুষ বিভিন্নভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। বেঁচে থাকার তাগিদেই মানুষকে রাজনীতি বুঝতে হয়, রাজনীতি করতে হয়। আর ধীরে ধীরে বর্তমানে সামাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, উন্নয়ন, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যা কিছু সবই রাজনীতির সাথে জড়িত। আমরা যে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড বা রাষ্ট্র পেয়েছি সেটিও কিন্তু রাজনীতির মধ্য দিয়েই অর্জন করেছি। প্রকৃত অর্থেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ, অস্তিত্বের লড়াই। এই যুদ্ধে সমগ্র বাঙালি জাতির শুধু স্বাধীনতাই অর্জন করেনি বরং রাজনীতিকীকরনও ঘটেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র জাতির সকল রাজনৈতিক সমীকরণে মিলিত হয়েছে ইতহাসের এক মোহনায়। তাই শ্লোগান উঠেছিল, “পদ্মা-মেঘনা-যমুনা- তোমার আমার ঠিকানা”। লক্ষ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। বাঙালি হিসেবে বিশ্বের দরবারে আত্মপরিচয়ে গর্বিত হওয়ার দিন।
অন্যদিকে ছাত্র রাজনীতি হলো রাজনীতির প্রাণ। বায়ান্নো থেকে একাত্তর-লড়াইয়ের মূল কারিগর ছাত্র সমাজ। প্রতিটি সংগ্রামে জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও ছাত্রদের ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। স্বাধীনতাপরবর্তী সময়েও এমনকি ’৯০-এর আন্দোলনেও ছাত্র সমাজ সাহসী ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে দাবিতে এবং শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডবের বিরুদ্ধেও লড়াই ছাত্ররাই শুরু করেছে। ছাত্ররা লড়াই করেছে বলেই বিশ্বের দরবারে আজ আমরা গর্বিত জাতি। আমরা পেয়েছি মাতৃভাষার মর্যাদা, স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকা। এই গৌরবময় ইতিহাসে নারীর ভূমিকাও কম নয়।
অথচ দুঃখের বিষয় হলো, আজ যখন আমরা ডিজিটাল যুগে পা দিয়েছি, যখন ঘরে ঘরে শিক্ষার হার বেড়েছে, তখন আমাদের দেশের তথাকথিত মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ছেন। আজকে তারা মনে করছেন, রাজনীতি করা মানে নষ্ট হয়ে যাওয়া, রাজনীতি করা মানে সময় অপচয় করা। এখন অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের মূল লক্ষ্যই থাকে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল ও পেশাগত ভালো অবস্থান। তাদের মধ্যে সমাজ ও দেশ নিয়ে কোনো দায়বদ্ধতা তৈরি হচ্ছে না।
এছাড়া সাধারণ মানুষ মনে করে রাজনীতি নষ্টদের দখলে চলে গিয়েছে। সত্যিই রাজনীতি আজ নষ্টদের দখলে। রাজনীতি এখন আর জনগণের কল্যাণে নয়, টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হয়েছে। সংসদ থেকে স্থানীয় সরকার-জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হচ্ছেন আমলা-ব্যবসায়ী ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি। টাকার জোরে নেতা বনে যাচ্ছে। তৈরি হয়েছে বিশাল এক সিন্ডিকেট। সেই সিন্ডিকেটের দৌরত্ম্যে রাজনীতিবিদরাই এখন কোণঠাষা। স্বার্থান্বেষীরা নিজের স্বার্থ কায়েমের জন্য রাজনীতিকে ব্যবহার করছে। অধিকাংশ জনগণকে বঞ্চিত রেখে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র কায়েম করছে। অন্যদিকে রাজনীতির দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তি। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ওরা জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বরং সংকটে পড়েছে প্রগতিশীল-মুক্তচিন্তা। কথা বললেই বাড়িতে হামলা হচ্ছে, হত্যা ও হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফলে রাজনীতির নামে অরাজনৈতিক চর্চায় সকলে রাজনীতি থেকেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে। দেশ চলে যাচ্ছে উল্টোপথে। রাজনীতিতে যদি নীতিবান, আদর্শবান ও মেধাবীরা না থাকে তবে রাজনীতির এই উল্টোযাত্রা ফেরানো সম্ভব হবেনা।
এক্ষেত্রে করণীয় ভাবতে হবে। আমাদের স্বার্থপরতা জায়গা থেকে বেরিয়ে সামগ্রিক স্বার্থের কথা ভাবতে হবে। ব্যক্তিস্বার্থের লড়াইয়ের ফল দ্রুত আসে। কিন্তু সামগ্রিক স্বার্থের জন্য লড়াই করলে তার ফল আসে দেরিতে। নিজের হাসি নিয়ে ব্যস্ত থাকলে কখনোই অন্যের কান্না ছুঁয়ে দেখার সময় হয় না। তাই সামগ্রীক বাস্তবতায় রাজনীতির হাল ফেরাতে ছাত্র সমাজকেই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ছাত্ররাই পারে সময়ের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়াতে। জাতীয় রাজনীতির হাল ধরতে। কারণ ছাত্র রাজনীতি হলো জাতীয় রাজনীতির নেতা তৈরির কারখানা। সে কারখানা সচল করতে হবে। নাটাইটা তাদের হাতেই রাখতে হবে।

-লেখক: একজন রাজনৈতিক কর্মী ও মুক্ত চিন্তার নারী।