Home মতামত তিনজোটের রূপরেখা ও নব্বইয়ের মহান গণ-অভ্যুত্থান

তিনজোটের রূপরেখা ও নব্বইয়ের মহান গণ-অভ্যুত্থান

43

সৈয়দ আমিরুজ্জামানঃ

উনিশ শ’ নব্বইয়ের ১৯ নভেম্বর তিন জোটের রূপরেখা ঘোষিত হয়েছিল। অাজকের দিনটি অামাদের জন্য ঐতিহাসিক ও গুরত্বপূর্ণ দিন।
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে উনিশ শ’ নব্বই-এর মহান গণঅভ্যুত্থান একটা বড় ঘটনা। আমি শুধু এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তি নই, এ ঘটনার হাজারো নায়কের মাঝে আমিও একজন সংগঠক। কারণ একটি ছাত্র সংগঠনের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি আশির দশকে আমি এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছি। অংশ নিয়েছি বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভে। শুধু অংশগ্রহণই করিনি, এরশাদবিরোধী আন্দোলন সংঘটিতও করেছি ওয়ার্কার্স পার্টির সহযোগী গণ সংগঠন ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র ইউনিয়নের একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক ও কুমিল্লা জেলার নেতা হিসেবে। এমনকি সামরিক শাসনে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ অবস্থার মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছি। শুধু তাই নয়, কারফিউয়ের ভেতরেও সমাবেশ ও বিক্ষোভে অংশ নিয়েছি, বিক্ষোভ সংঘটিত করেছি। এ ক্ষেত্রে ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন কুমিল্লা জেলা সম্পাদক কমরেড সাজ্জাদুর রহমান মাসুম, পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড হাবিবুর রহমান,কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য কমরেড সুভাষ ভৌমিক, কমরেড রুস্তম অালী, কমরেড নাজিম অালী প্রমুখ সাহসী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র বিক্ষোভের মধ্যদিয়ে এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনের যে সূচনা হয়, সেই আন্দোলন অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নব্বইয়ের মহান গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আর এ গণ-অভ্যুত্থানে জেনারেল এরশাদের পতন হয়। এ জন্য দীর্ঘ ৯ বছর শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র-জনতাকে সাহসী লড়াই করতে হয়েছে। আর অসংখ্য ছাত্র, শ্রমিক-কৃষক নেতাকে জীবন দিতে হয়েছে।
ছাত্র-জনতার এ জানবাজি লড়াইয়ের শুরুতেই ৮৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ড. কামাল হোসেনের বাড়িতে বৈঠকরত জাতীয় নেতাদের গ্রেফতার করে চোখ বেঁধে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে নির্যাতন করা হয়। পরে তাদের সবাইকে দেশের বিভিন্ন কারাগারে প্রেরণ করা হয়। আর গণতন্ত্রের মানসকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তার বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ড. কামাল হোসেনের বাড়ি থেকে যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন ড. কামাল হোসেন, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, কমরেড রাশেদ খান মেনন, কমরেড দিলীপ বড়ুয়া, মহিউদ্দিন আহমেদ, কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান, কমরেড খালেকুজ্জামান, সিদ্দিকুর রহমান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুল মান্নান, আব্দুস সামাদ আজাদ প্রমুখ।
এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এরপর আরো অনেকবার জাতীয় নেতাদেরকে গণগ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। সেই সাথে ঢাকা-কুমিল্লাসহ সারাদেশে বিভিন্ন সময় হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।
’৮৭ সালে এত বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয় যে দেশের কারাগারগুলোতে স্থান সংকুলান হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরও আন্দোলন থেমে থাকেনি। তবে দীর্ঘ আন্দোলনের মাঝ পথে কখনো কখনো ভাটার টান দেখা গেছে। কিন্তু তারপরই আবার জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। ’৮৭ সালে আন্দোলনের এ জোয়ার অনেক উচ্চতায় পৌঁছে। দেখে শুনে মনে হচ্ছিল এরশাদ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পতন থেকে রক্ষা পায় সরকার। এরপর ’৮৮ সালে আ স ম আব্দুর রবসহ কিছু দালালকে জুটিয়ে একটা নির্বাচন দিয়ে শেষরক্ষার চেষ্টা করে এরশাদ। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ’৮৮-এর নির্বাচনও হয় ৮৬ সালের নির্বাচনের মতো ভোটারবিহীন। ওই নির্বাচনে অনেক প্রার্থী তার এলাকাতেই যেতে পারেনি। জনতা ধাওয়া দিয়ে প্রার্থীদের এলাকা ছাড়া করে। এমন কি কোনো কোনো প্রার্থীর কান কেটে নেয়ার খবর পাওয়া যায়। এই অবস্থায় এরশাদবিরোধী আন্দোলন নতুন মাত্রা লাভ করে। এর কারণ ’৮৬ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে গিয়ে সংসদে বসায় আন্দোলনের শক্তির মাঝে যে বিভক্তি ও দুর্বলতা দেখা ’৮৭ সালে আওয়ামী লীগ আন্দোলনে ফেরায় ওই বিভ্রান্তি ও দুর্বলতা দূর হয়। ’৮৮ সালে আন্দোলন জোরদার হয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তিন জোট ৮, ৭ ও ৫ দল একাট্টা হয়ে কোমর বেঁধে আন্দোলনে নামে। এ সময় তিন জোটের ঐক্য ও সংহতি জোরদার করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে ৫ দলীয় বাম জোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে এ আন্দোলন ’৯০ সালে আরো বেগবান হয়। ’৯০ সালের শেষ দিকে ১৯ নভেম্বরে তিন জোটের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। ওই ঘোষণার পর ৫, ৭ ও ৮ দলের আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয় এবং নব্বইয়ের ডিসেম্বরে দেশে গণ-অভ্যুত্থান হয়ে যায়। আর এই গণ-অভ্যুাত্থানে এরশাদের পতন হয়।
নব্বইয়ের ডিসেম্বরে এরশাদ পতনের আগে ছাত্র ও গণ-আন্দোলনে সাংবাদিকরাও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। সাংবাদিকরা সব সংবাদপত্রে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট আহ্বান করেন। এক কথায় সাংবাদিকরা বলে দেন এরশাদের পতন না হলে সংবাদপত্র বের হবে না। এ ঘোষণা দিয়েই সাংবাদিকরা ক্ষ্যান্ত হননি। তারা এরশাদ পতনের দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভও করেন।
এরশাদ পতনের কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি জঙ্গি মিছিল বের হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ওই মিছিলে অংশ নেন। মিছিলের সংবাদ পেয়ে একজন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিক তার বর্ণনায় লিখেছেন, ‘অফিস থেকে বেরিয়ে তোপখানা রোডের মোড়ে গিয়ে দেখলাম, প্রেসক্লাবের দিক থেকে একটা মিছিল আসছে। ভীষণ জঙ্গি মিছিল। কোনো ভয়-ডর নেই।’ তিনি অারও লিখেছেন, ‘দেখে মনে হলো সব কিছু ভেঙে-চুরে ওরা আজ এরশাদের পতন ঘটিয়ে ছাড়বে এবং তাই হয়েছিল। ওই মিছিলের পর এরশাদ সরকার ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ঢাকা মহানগরীতে কারফিউ জারি করে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি।’ শেষ পর্যন্ত এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হয়। এই গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। এই গণ-অভ্যুত্থানে ঢাকা মহানগরীর মানুষ মধ্যরাতে রাজপথে নেমে আসেন। পর দিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত নগরীর কেন্দ্রস্থল পল্টন, গুলিস্তান, মতিঝিল ছিল লোকে লোকারণ্য। এ অবস্থা ছিল আরো কয়েক দিন বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত।

তিন জোটের রূপরেখা:
এখানে একটা কথা বলা দরকার বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অফিসে সিরিজ বৈঠকের পর এই রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়। এই রূপরেখার খসড়া প্রস্তুত করেন ৫ দলীয় বাম জোটের শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জননেতা কমরেড রাশেদ খান মেনন।
জননন্দিত নেতা কমরেড রাশেদ খান মেননের হাতে লেখা সেই খসড়া সম্ভবত আজো সংরক্ষিত আছে। যা হোক খসড়া চূড়ান্ত হবার পর ১৯ নভেম্বর তা সাংবাদিকদের সামনে পাঠ করা হয় এবং সংবাদপত্র অফিসে প্রেরণ করা হয়। সেই সময় আজকের মতো এতো সংবাদপত্র ছিলো না। তারপরও রাজধানী ঢাকা থেকে অনেকগুলো দৈনিক, সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক সেই দিন একটি মাত্র দৈনিক ও একটি মাত্র সাপ্তাহিকে তিন জোটের রূপরেখা প্রকাশিত হয়। দৈনিক পত্রিকাটি ছিল ‘সংবাদ’ আর সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ছিল- ‘নতুন কথা’। আমার মনে আছে, নতুন কথায় তিন কলাম বক্স করে তিন জোটের রূপরেখা ছাপা হয়েছিল। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর তিন জোটের এই রূপরেখা ঐতিহাসিক দলিলের মর্যাদা লাভ করে। কারণ এই রূপরেখার ভিত্তিতেই গণ-অভ্যুত্থান হয়। এই রূপরেখার ভিত্তিতে গণ-অভ্যুত্থান হলেও গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি ক্ষমতায় গিয়ে ওই রূপরেখা বাস্তবায়ন করেনি। (চলবে)

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।