জিয়াউল হক মুক্তা:
এক.
আজ ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস। স্পষ্টভাবে ও প্রচ্ছন্নভাবে দিনটির রয়েছে তিনটি আলাদা আলাদা নাম, অবশ্যই আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণসমেত। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলো কখনো উর্বর মস্তিস্কের কল্পনার আকাশ-কুসুম, কখনো বিকৃতিজাত আর কখনও মিথ্যাচারপ্রসূত।
দুই.
জাসদ দিনটিকে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান দিবস হিসেবে চিহ্নিত করলেও দলটির অনেক সদস্য-সমর্থক বলে ও লিখে থাকেন যে ১৯৭৫ সালের এ দিনে জাসদ নাকি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে চেয়েছিল। জাসদের এসব অত্যুৎসাহী সদস্য-সমর্থকদের পথ ধরে সাধারণভাবে খুব জ্ঞানী-গুণি হিসেবে পরিচিত নামি-দামি অনেকে জাসদকে নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন যে জাসদ সিপাহিদের নিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে গিয়েছিল এবং এরকম আজব ঘটনা নাকি দুনিয়ার কোথাও দেখা যায়নি। এরা বিপ্লব বিষয়ে নিজেদের অগাধ পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করলেও সাধারণ তথ্যটি জানেন না যে জগতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, যা রাশিয়ার অক্টোবর সমাজতান্দ্রিক মহাবিপ্লব নামে বিশ্বব্যাপি পরিচিত, তা থেকে শুরু করে দুনিয়ার অনেক দেশে সিপাহি ও সেনাবাহিনী সমাজতান্ত্রিক দলের সাথে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে।এটা নিছক একটি তথ্য হিসেবে তাদের জ্ঞানভাণ্ডারে পুনঃসংযোজনের জন্য পুনর্ব্যক্ত করে রাখা হলো।
কিন্তু যে আসল কথাটি সবার জানা উচিত, তা হলো, জাসদ ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কোনো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে যায়নি; এমনকি কোন সাধারণ গণতান্ত্রিক বিপ্লবও সম্পাদন করেনি; এমনকি এটা কোনো সিপাহি-বিপ্লবও ছিলনা; জাসদের কোনো দলীয় সাহিত্যে ভুল করেও এমন কোনো দাবি কোনোদিন করা হয়নি। এটা ছিল একটি সিপাহি অভ্যুত্থান। ‘অভ্যুত্থান’ হলো সাধারণ ‘বিদ্রোহ’ থেকে ‘গুণগতভাবে’ উচ্চতর পর্যায়ের এবং ‘বিপ্লব’ থেকে ‘নিম্নতর’ স্তরের। এই অভ্যুত্থানের পরিকল্পনায় অর্ন্তভুক্ত ছিল ব্যাপক পরিমাণে সাধারণ জনগণকে যুক্ত করার। জাসদ নিজের কার্মক্রমকে অতিরঞ্জিত করে একে বিপ্লব হিসেবে যেমন বলেনি, তেমনি এই অভ্যুত্থানের মহান-মানবিকতার দিকটি বিবেচনা করে একে বিদ্রোহও বলেনি। ৭ নভেম্বর একটি খাঁটি সিপাহি-অভ্যুত্থানের দিন; বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ও স্বার্থপর অফিসারদের ধারাবাহিক উচ্ছৃঙ্খলতার বিপরীতে সাধারণ সিপাহিদের একটি শৃঙ্খলামূলক অভ্যুত্থান।
তিন.
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারগণ বাকশাল পলিটব্যুরোর ৫ নম্বর সদস্য খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের নারী ও শিশু সদস্যসহ কুড়ি জনকে হত্যা করেন। এটা ছিল পাকিস্তানপন্থা পুনরুত্থানের হীন রাজনৈতিক অপপ্রয়াসের এক চরম নিষ্ঠুর ঘটনা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আরো কিছু অফিসার ব্যক্তিগত পদ-পদবি-ক্ষমতালিপ্সা থেকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সংঘটিত করেন আরো একটি ক্যু। ক্যুর প্রধান সংগঠক খালেদ মোশাররফ বঙ্গবন্ধুর হত্যার রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে দেনদরবার করেন নিজের প্রমোশনের জন্য; তিনি কারাগারে অন্তরীণ চার আওয়ামী লীগ নেতার হত্যাকাণ্ড নিয়ে টু-শব্দটি করেননি; সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যাকারী অফিসারদের সাথে আলোচনা করে তাদেরকে নিরাপদে দেশত্যাগের সকল আয়োজন করে দেন; এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য ঢাকায় নিজের সামরিক শক্তির সমাবেশ করতে থাকেন।
১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসারগণ চরম উচ্ছৃঙ্খলতার পরিচয় দেন। উভয় ক্ষেত্রে তারা সাধারণ সিপাহিদের কোনো কিছু অবহিত না করে তাদেরকে ব্যবহার করেন হীন রাজনৈতিক ও নিচ ব্যক্তিস্বার্থে। সাধারণ সিপাহিগণ এটা মেনে নেননি; তারা মেনে নেননি তাদেরকে ব্যবহার করে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা, তারা মেনে নেননি তাদেরকে ব্যবহার করে অফিসারদের পদ-পদবি-ক্ষমতা দখলের উন্মত্ততা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সকল সাধারণ সিপাহি, যারা প্রায় সকলে ছিলেন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা, এমনকি যারা নিজেদের কমান্ডিং অফিসারদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছেন ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর, তারা সকলে রুখে দাঁড়ান তাদের কমান্ডিং অফিসারদের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর।
ইতিহাসের পাঠককে এখানে দেখতে হবে কোন দাবির ভিত্তিতে সিপাহিগণ লিফলেট বিতরণ করেছিলেন এবং ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন। লিফলেটে সাধারণ সিপাহিদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার পাশাপাশি বেতন-ভাতা-সুবিধার বিষয় ছিল। অভ্যুত্থান সফল হবার পর বন্দিদশা থেকে মুক্ত জিয়াউর রহমানের কাছে তারা যে ১২ দফা দাবিনামা পেশ করেছিলেন তাতেও অধিকার-মর্যাদা ও বেতন-ভাতা-সুবিধার দাবি ছিল, সাথে ছিল রাজনৈতিক দাবি— একটি সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন ও সকল রাজবন্দির মুক্তি।
চার.
সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অতি দ্রুত প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করেন জিয়াউর রহমান। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারগণ সমবেত হন তার চারপাশে। জিয়ার মধ্যে সমন্বয় ঘটে তিনটি গণবিরোধী স্বার্থের; প্রথমত নিজের ক্ষমতা-মোহের ব্যক্তিস্বার্থ, অফিসারদের গোষ্ঠিস্বার্থ আর পাকিস্তানপন্থার রাজনীতি।
বিএনপি ও বাংলাদেশের দক্ষিনপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো ৭ নভেম্বরকে পালন করে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে। দিনটিকে তারা এমন নামকরণ করেছে কারণ জিয়াউর রহমান মুক্তিযদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করেছেন এবং তিনি পাকিস্তানপন্থি দল-গোষ্ঠি-রাজনীতিকে সংহত করেছেন যতোদিন বেঁচে ছিলেন। জিয়া একাত্তরের ও পঁচাত্তরের খুনিদের পুনর্বাসন করেছেন চাকুরিতে, সমাজে, সরকারে, রাজনীতিতে ও সংস্কৃতিতে।
পাঁচ.
আওয়ামী লীগ ৭ নভেম্বরকে দলীয়ভাবে কোন বিশেষ দিবস হিসেবে চিহ্নিত করেনা। দলটি ক্ষমতায় এসে ৭ নভেম্বরকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন বন্ধ করে ও এদিনের সরকারি ছুটি বাতিল করে। বিএনপি ও দক্ষিনপন্থিদের ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে এটা একটা ভালো পদক্ষেপ।
তবে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি প্রভাববলয়ের অনেকে দিনটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের চেষ্টা করেছিলেন ১৯৯০ সালের পর বেশ কয়েক বছর। জিয়ার অপকর্মকে সাধারণ সিপাহি ও জাসদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার একটি প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা তাদের মধ্যে ছিল; কিন্তু তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল খালেদ মোশররফ, এটিএম হায়দার ও নাজমুল হুদা হত্যাকাণ্ডের সাথে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটনকারী সিপাহিদের ও জাসদকে কোনোভাবে জড়ানো যায় কিনা সে চেষ্টা করা। অথচ আজ এই ইতিহাস পুরোপুরি উন্মোচিত হয়েছে যে খালেদ-হায়দার-হুদা আশ্রয় নিয়েছিলেন খালেদের নিজের গঠন করা ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে, এই রেজেমেন্টর সবাই তার চেনাজানা ও ভীষণ আপন, তারা ভেবেছিলেন এখানে তারা নিরাপদ। নিজেদের বিশ্বস্ত আপনজনের হাতে খুন হন এই তিন সেনাকর্মকর্তা। তাদের খুনি মেজর জলিল ও মেজর আসাদ ছিলেন তাদের অনুসারী; এরা কোনো দিন বিপ্লবী গণবাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেননা, জাসদের সাথে যুক্ত থাকার তো প্রশ্নই আসেনা।
জিয়াউর রহমান চরম বর্বরতার সাথে কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তমকে হত্যা করেছেন, হত্যা করেছেন আড়াই হাজারের বেশি মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ও সিপাহিকে; তিনি তাকে বন্দি করার অপরাধে খালেদ-হায়দার-হুদার অনুসারী জলিল-আসাদের মাধ্যমে তাদেরকে হত্যা করান। জিয়ার এই ব্যাপক-বিস্তৃত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে যথাযথ বক্তব্য প্রদান না করে এবং বিপরীতক্রমে সাধারণ সিপাহি ও জাসদকে মিনমিনে কণ্ঠে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিযুক্তকারীরা আসলে খালেদের ক্ষতালিপ্সাকে মহিমান্বিত করতে চান। অথচ কর্নেল তাহের বারবার টেলিফোনে বঙ্গভবনে অবস্থানরক খালেদ মোশাররফকে বলেছিলেন, খালেদ পাগলামো কোরোনা, যেখানে আছো সেখানেই থাকো, কেউ তোমার কিছু করবে না। কিন্তু খালেদ কর্নেল তাহেরকে বিশ্বাস না করে বঙ্গভবন ত্যাগ করে নিজের নিরাপদ আশ্রয়ে গিয়ে নিজের বিশ্বস্ত আপনজনের হাতে খুন হলেন।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটনকালে জাসদ বা বিপ্লবী গণবাহিনী বা বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যগণ এক ফোঁটা রক্তও ঝরাননি। এটাই কি জাসদ-গণবাহিনী-সৈনিকসংস্থার সবচেয়ে বড় ভুল? ঐতিহাসিকভাবে সকল বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান-বিপ্লব হচ্ছে রক্তাক্ত। কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ও তাঁর সহযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু কি ভুল করেছেন?
ছয়.
পণ্ডিতদের মনে রাখতেই হবে যে প্রায় দেড়শত বছর ধরে সিপাহিদের অসংখ্য-অগণিত বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান ও বিপ্লবে পরিপূর্ণ এমনকি বাংলার ইতিহাস, ভারত উপমহাদেশের ইতিহাস।
অফিসারদের ব্যক্তি-গোষ্ঠি-রাজনৈতিক স্বার্থের ক্যু-গুলো যেমন রক্তাক্ত; তেমনি রক্তাক্ত হচ্ছে সাধারণ সিপাহিদের সকল বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান-বিপ্লব।
বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র রক্তপাতহীন সামরিক উত্থান হচ্ছে ৭ নভেম্বরের মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান। বিপ্লবী গণবাহিনীর প্রধান শহিদ কর্নেল আবু তাহের বীরউত্তম ও উপপ্রধান হাসানুল হক ইনু হচ্ছেন বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশের এমন মহান মানবিক নেতা যাঁরা বিপুল সুযোগ ও বাস্তবতা থাকার পরও ৭ নভেম্বর কোনো হত্যাকাণ্ড তো দূরের কথা, সামান্য রক্তপাত হতে দেননি। এ বিষয়ে পরে বিস্তারিত বলা হচ্ছে। আপাতত বাংলা-ভারতের তিনটি সিপাহি বিদ্রোহ-বিপ্লবের কেইস স্টাডি করা যাক।
প্রথমটি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ। ঔপনিবেশিক বৃটিশ শাসকগণ এটাকে বিদ্রোহ বলেছেন, সেই ধারায় অন্যরাও একে বিদ্রোহ বলেছেন; কিন্তু কার্ল মার্কস ও আরো কেউ কেউ তাঁকে অনুসরণ করে এ ঘটনাকে বলেছেন ‘প্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন’। এক্ষেত্রে সিপাহিদের অধিকার-মর্যাদা-সুবিধার সাথে সাথে উপমহাদেশের স্বাধীনতার দাবি যুক্ত হয়েছিল। অফিসার হত্যা, জেল ভেঙে কয়েদিদের ছেড়ে দেয়া, সরকারি তোপখানা দখল, টেলিগ্রাফের তার কাটা, রেল লাইন উপড়ে ফেলা, বারুদখানা-ঘাঁটি-দুর্গ দখল ইত্যাদি ছিল কথিত বিদ্রোহের স্বাভাবিক কার্যক্রম। আগের বেশ অনেকগুলো বছরে সংঘটিত অনেকগুলো সিপাহি বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৭ সালের কথিত বিদ্রোহ ছিল ভারতবর্ষব্যাপ্ত; এর ব্যাপক গণসম্পৃক্ততা ছিল; সন্যাসি-ফকির বিদ্রোহের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা ছিল; সামন্ত হলেও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল। আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকার পরও সিপাহিগণ ইংরেজ অফিসারদের কচুকাটা করতে পিছিয়ে থাকেননি।
দ্বিতীয়টি ছেচল্লিশের নৌ-বিদ্রোহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এই বিদ্রোহের সূচনা হয়। বিশ হাজারের বেশি নাবিকের অংশগ্রহণে ৭৮টি জাহাজ ও উপকূলের অগণিত স্থাপনায় এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। সিপাহিদের বিদ্রোহের দাবির মধ্যে অধিকার-মর্যাদা-সুবিধার সাথে যুক্ত হয়েছিল বৃটিশদের ভারত উপমহাদের ছাড়ার দাবি। তাদের দাবিনামার বিষয়াবলি ছিল: রাজবন্দিদের মুক্তি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশের সাথে যুদ্ধরত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সদস্যদের মুক্তি, ইন্দোনেশিয়া ও মিশর থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার, বৃটিশদের ভারত থেকে বহিষ্কার, দুর্ব্যবহারকারি অফিসারদের বিচার, নেভির সিপাহিদের মুক্তি, বেতন-ভাতা-সুবিধা বৃদ্ধি, খাবারের গুণগত মান বৃদ্ধি, অবসরকালে পোশাক ফেরত দেয়ার বিধান বাতিল, সিপাহিদের সাথে অফিসারদের ভালো আচরণ এবং অফিসার ও কর্মকর্তা হিসেবে ভারতীয়দের নিয়োগ। বিদ্রোহ সংঘটনের সভাপতি এসএম খান কংগ্রেস নেতা বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে আলোচনা করে বিদ্রোহ সংগঠিত করেন। তারা অফিসারদের বাম হাতে স্যালুট দেন, আদেশ অমান্য করেন, মারধর করেন, হকিস্টিক নিয়ে শহরে বের হয়ে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেন, ট্রাক থেকে তেল নিয়ে গাড়িতে আগুন দেন, মার্কিন ও বৃটিশ স্থাপনায় হামলা করেন, তাদের পতাকায় আগুন দেন, সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাইফেল ও মেশিনগানের গুলি ছোঁড়েন, এন্টি এয়ারক্রাফট গান তাক করেন ইত্যাদি। প্যাটেল ও জিন্নাহর অনুরোধে বিদ্রোহ স্তিমিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি; কিন্তু এর মধ্যে ইংরেজ অফিসারদের সাথে সাথে মারা যান ৩ জন পুলিশ ও ২২৭ জন সিভিলিয়ান। আহত হন ৯১ জন পুলিশ ও ১০৪৬ জন সিভিলিয়ান। যে কথা বলতে চাচ্ছি, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ থাকার পরও ছেচল্লিশের নৌবিদ্রোহও ছিল রক্তাক্ত।
তৃতীয় কেইস হচ্ছে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সংঘটিত বিডিআর বিদ্রোহ। এ বিদ্রোহ আরো ১২টি শহরে ছড়িয়ে পরেছিল। বাইশ দফা দাবিতে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। দাবির মধ্যে ছিল: বিডিআর-এর উচ্চ পদ থেকে সেনাবাহিনিকে সরিয়ে বিডিআর সদস্যদের সেগুলোতে পদোন্নতি দেয়া, বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে বিডিআর কর্মকর্তা নিয়োগ, অপারেশন ডাল-ভাত কর্মসূচিতে সেনাবাহিনীর অফিসারদের লুটপাট-দুর্নীতির হিসেব নেয়া, শতভাগ রেশন চালু করা, শান্তিরক্ষা মিশনে বিডিআর সদস্যদের অংশগ্রহণের সুযোগ, বিডিআর সদস্যদের সামগ্রিক কল্যাণ ইত্যাদি। বিদ্রোহকালে বিডিআর সদস্যগণ সেনাকর্মকর্তাদের পরিবার সদস্যদের জিম্মি ও অবমাননা করেছেন, স্থাপনা ও সম্পদ ধ্বংস করেছেন। তারা ১৭ জন বেসামরিক নাগরিক ও ৫৭ জন সেনা কর্মকতাকে হত্যা করেন, লাশ লুকিয়ে ও পুঁতে রাখেন। মৃত সেনাকর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন একজন ক্যাপ্টেন, ২৫ জন মেজর, ২৮ জন কর্নেল, দুইজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ও একজন মেজর জেনারেল। মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ বিডিআর প্রধানের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সাম্প্রতিক কালের এ বিডিআর বিদ্রোহ ছিল অপরিমেয় নৃশংশতার ভরপুর; ভয়ঙ্করভাবে রক্তাক্ত।
অসংখ্য সিপাহি বিদ্রোহ-অভ্যুত্থান-বিপ্লবের মধ্য থেকে উপস্থাপিত তিনটি কেইস দেখাচ্ছে যে সিপাহিরা তাদের অধিকার-মর্যাদা-সুবিধার দাবির সাথে সাথে কখনও কখনও দেশপ্রেমের মহান দাবিগুলোও যুক্ত করেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের সাথে সংশ্লিষ্টতা ও যোগাযোগ থাকার পরও তারা রক্তপাত ঘটান— সম্ভবত এটাই সিপাহি বিদ্রোহের বৈশ্বিক চরিত্র। বাংলাদেশের ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা প্রমাণ করে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছাড়া একটি সাধারণ সিপাহি বিদ্রোহ কতোটা মরীয়া, কতোটা মর্মান্তিক, কতোটা ভয়ঙ্কর, কতোটা অমানবিক ও কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানে এক ফোঁটা রক্ত ঝরেনি। এই অভ্যুত্থানকে যিনি মহান না বলবেন— বিষয়গতভাবে বিবেচনা করতে না চাইলেও অন্তত মানবিকতার বিবেচনায় হলেও— তিনি কি তাহলে হত্যা-খুনের রক্তপিচ্ছিল পথের যাত্রী?
সাত.
ঢাকার এলিফ্যান্ট রোডের একাধিক বাসায় তিন ও চার নভেম্বরের একাধিক সভা থেকে জাসদ নেতৃবৃন্দ অভ্যুত্থানের অনুমোদন দেন। ইতোমধ্যে সূচিত প্রস্তুতি অনুসরণ করে চূড়ান্ত সভা হচ্ছে ৫ নভেম্বর; ঢাকার গুলশানে; প্রকৌশলি আনোয়ার সিদ্দিকীর বাসার বিশাল ছাদে। শত শত সিপাহি, কেউ ইউনিফর্মে, কেউ সাধারণ পোশাকে, কেউ লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে, এমনকি কেউ কেউ খালি গায়ে। সকল ধরনের সিপাহিগণ সেখানে উপস্থিত; যারা কোন অফিসার দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে ব্যবহৃত হননি, ৩ আগস্ট যাদের ব্যবহার করা হয়েছে তাদের অজানিতে, ১৫ আগস্ট যাদের ব্যবহার করা হয়েছে তাদের অজানিতে, সকলে। তারা উত্তেজিত। তারা বিপ্লব করবেন, অভ্যুত্থান করবেন, বিদ্রোহ করবেন। তারা ঘোষণা করলেন তাদেরকে গণবিরোধী ও দেশবিরোধী কাজে ব্যবহারকারী উচ্চপদস্থ অফিসারদের তারা হত্যা করবেন, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা যায়না, তাঁদেরকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত না; তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখলে তারা আবার জোট বেঁধে ক্ষতালিপ্সার হত্যা-খুনে মেতে উঠবে।
বিপ্লবী গণবাহিনীর অধিনায়ক কর্নেল তাহের ও উপপ্রধান হাসানুল হক ইনু দীর্ঘ সময় নিয়ে তাদের পইপই করে বোঝালেন যে কোনো ধরনের হত্যাকাণ্ড বা রক্তপাতে যাওয়া যাবেনা। প্রয়োজনে গ্রেফতার করা যেতে পারে; কিন্তু এক ফোঁটা রক্তপাত ঘটানো যাবে না।
ছয় নভেম্বর দিনশেষের রাতে ৭ নভেম্বর সংঘঠিত হলো মহান সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থান। অস্ত্রাগারের সকল অস্ত্র সিপাহিদের হাতে। আকাশে লক্ষ লক্ষ গুলি। গুলির শব্দে মুখরিত আকাশ-বাতাস। ক্যান্টমেন্টের গুলির শব্দ সরাসরি না শুনে, কেবল টেলিফোনে গুলির শব্দ শুনে, বঙ্গভবনে অবস্থানরত ক্ষমতালিপ্সু অফিসাররা দেয়াল টপকে পালাতে গিয়ে নিজেদের পা ভেঙে ফেললেন।
অভ্যুত্থানের সামরিক দিক সফল হলো। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হলো। জিয়াকে মুক্ত করে এলিফ্যান্ট রোডে আনতে ব্যর্থ হলেন দায়িত্বপ্রাপ্ত হাবিলদার। ধীরে জিয়ার চারপাশে ভিড় করলো অফিসাররা, তারা সবাই মিলে জিয়ার নেতৃত্বে সিপাহিদের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করলো।
সিপাহিগণ অফিসারদের হত্যা করতে চেয়েছিলেন। কর্নেল তাহের ও হাসানুল হক ইনু রক্তপাত নাকচ করলেন। সিপাহিগণ যদি অন্তত কিছু অফিসারকেও হত্যা করতেন, বাকিদের কি জিয়ার চারপাশে সমবেত হয়ে প্রতিবিপ্লব সংঘটিত করার সাহস হতো? কে জানে?
কে জানে, কেউ হয়তো একদিন তাহের ও ইনুকে দুষবেন যে তারা বিপ্লবী ছিলেন না। অভ্যুত্থান কি ছেলে খেলা নাকি? তা ভোজসভা বা সূচিকর্ম নাকি? প্রতিপক্ষের রক্তে স্নান না করে অভ্যুত্থান সফল হয় নাকি? ইত্যাদি।
কিন্তু আমার মনে হয়, এই অসম্ভব রোমান্টিক মহান মানুষ দুটি মানুষকে ভালোবাসতেন অপরিমেয়।
৭ নভেম্বর ২০২২
শার্ম আল-শেখ, মিশর
- লেখক জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক; জাসদের মুখপত্র লড়াই-এর সম্পাদক ও প্রকাশক।