Home স্বাস্থ্য জলবায়ু কেড়ে নিচ্ছে মাতৃত্বের অধিকার

জলবায়ু কেড়ে নিচ্ছে মাতৃত্বের অধিকার

29

ডেস্ক রিপোর্ট: বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। সমুদ্র পৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুণ, ফলে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ভুগছেন নানান রকম রোগে। বিশেষ করে নারী, কিশোরী এবং শিশুরা। লবণাক্ততার উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো জরায়ুর সংক্রমণ সমস্যা যা এখন উপকূলের অনেক এলাকাতেই বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হয়ে উঠেছে।

খুলনার কয়রা উপজেলাসহ আশপাশের উপকূলীয় এলাকার পানিতে, জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে, বিশেষভাবে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতের পর এই দুর্দশা বেড়েছে বহুগুন। নারী ও কিশোরীরা প্রায় ছয় ঘণ্টারও বেশি সময় লবণ পানিতে কাটায় মাছ ধরার জন্য, এ সব এলাকায় ১ লিটার পানিতে লবণের পরিমাণ প্রায় ২০ গ্রাম, যা নারী ও কিশোরীদের জননেন্দ্রিয় দিয়ে প্রবেশ করে এবং স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এর ফলে যে কোনো সংক্রমণ খুব দ্রুত এবং সহজে ছড়ায়। এই লবণাক্ততার কারণে এই এলাকার নারীদের যে রোগব্যাধিগুলো সাধারণভাবে দেখা যায় তা হলো জরায়ু টিউমার, লিউপেরিয়া, জনন অঙ্গ পথে রক্ত পড়া ও চুলকানি।

২০১৮ সালের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবে লবণাক্ততার প্রভাব শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় উপকূলীয় এলাকার নারী ও কিশোরীরা তাদের ঋতুর সময় যে কাপড় ব্যবহার করে এবং পরবর্তীতে তা পুনরায় পানিতে ধুয়ে ব্যবহার করার কারণে পানির লবণাক্ততার জন্য তারা নানান অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে।

প্রমীলা সরদার (২৬) খুলনার কয়রা উপজেলার কলাপোতা গ্রামের বাসিন্দা, তিনি জানান, এখানে এখন আর কৃষির আবাদ হয় না বললেই চলে, লবণের কারণে জমির উর্বরতা শেষ হয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন, লবণাক্ততা আমার সংসারও প্রায় শেষ করে দিচ্ছে। আমার বিয়ের ১১ বছর পার হলেও আমরা এখনো কোনো সন্তানের মুখ দেখিনি। আমি জরায়ু সমস্যায় ভুগছি। ডাক্তার দেখিয়েছি কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এলাকার বহু নারী এই সমস্যায় ভুগছেন। কান্না চেপে রেখে চোখের কোণ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি মুছতে মুছতে প্রমিলা বলেন ‘আমি নিজেও খুব ভয়ে থাকি সারাক্ষণ স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করি সবসময়। আমার সংসার যেন ভেঙে না যায়’।

লবণ পানি এলাকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুরো ভেঙে দিচ্ছে। তপতী আরো বলেন, ‘আশপাশে মিঠা পানি নাই আর খাওয়ার জন্য যে পানি আমরা বয়ে আনি তা দিয়ে গোসল করা বা হাত মুখ ধোঁয়ার কোনো সুযোগ নাই। তাই বাড়ির কাছের নোনা পানির পুকুরেই বাচ্চাদের গোসল করাই। বাচ্চাগুলোর চুলকানি প্রায় সারা বছরই লেগে থাকে। খুব কষ্ট পায় আমার বাচ্চাগুলো, ভগবানের কাছে মিনতি করি এই দুর্দশা থেকে তিনি যেন আমাদের রক্ষা করেন।’

পানিতে লবণাক্ততার কারণে মহিলাদের স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য এবং তাদের উর্বরতা বিষয়টি নিয়ে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল এর গাইনোকোলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. এলিজাবেথ সরকার এর সাথে কথা হলে তিনি জানান ‘লবণাক্ততা পানিতে বেশি থাকার কারণে বিশেষ করে মহিলারা বিভিন্ন গাইনোকোলজি সমস্যায় ভুগছেন। যেমন সব বয়সের নারী, শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত ভ্যাজাইনাল ইনফেকশনের শিকার। এ ছাড়াও আমরা লক্ষ্য করেছি যে, এই এলাকার মহিলাদের মধ্যে পেলভিস ইনফ্লামেটরি ডিজিস খুবই কমন যা পরবর্তী সময়ে রোগীকে ক্যানসার এর দিকে নিয়ে যায়।’

তিনি আরো বলেন ‘আমাদের এখানে যে নারী রোগীরা আসেন তার ৮০% শতাংশই ওয়াটার স্যালাইনিটির কারণেই আসেন। এই এলাকার খাবার পানিতেও লবণাক্ততার পরিমাণ বেশি। ক্রমাগত এই পানি পান করতে থাকলে রোগীর মধ্যে হাইপার টেনশন দেখা দেয় এবং গর্ভবতী মায়েদের প্রেশার অনেক বেড়ে যায়। এর ফলাফল হলো গর্ভবতী মায়েদের এক্লামশিয়া এমনকি গর্ভপাতের মতো ঘটনাও ঘটে। নারীদের এই সব জটিল রোগব্যাধির উৎস সম্পর্কে ড. এলিজাবেথ বলেন ‘পুকুরের পানি আবদ্ধ অবস্থায় থাকার কারণে এর দূষণ বেশি এবং এর সঙ্গে পানিতে থাকে বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র পরজীবী। তার উপর আবার পানির লবণাক্ততা পরজীবীগুলোকে আরো শক্তিশালী করে তোলে। এর ফলে ইনফেকশন খুব দ্রুত ছড়ায়। আর এই লবণাক্ত পানিই স্থানীয় নারী ও শিশুরা ব্যবহার করেন প্রতিনিয়ত।’

উপকূলীয় এলাকার মানুষের সুস্বাস্থ্য, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে এবং নারীদের মাতৃত্বের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে মিঠা পানির ব্যবস্থা করতে হবে। করে দিতে হবে জীবিকার নতুন পথ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রামে গ্রামে গভীর নলকূপ স্থাপন, বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে বড় বড় চৌবাচ্চা নির্মাণ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণ ও মানুষকে সচেতন করে তোলা এখন সময়ের দাবি। নচেৎ উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুর্দশা বাড়বে বৈ কমবে না। -ইত্তেফাক