Home জাতীয় জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্লিন এনার্জির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে এবং দ্বৈতনীতি পরিহার...

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ক্লিন এনার্জির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে এবং দ্বৈতনীতি পরিহার করতে হবে

44

সৈয়দ আমিরুজ্জামান, বিশেষ প্রতিনিধি | : আজ বৃহস্পতিবার (২৩শে ফেব্রুয়ারি) সকালে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-এর অডিটোরিয়ামে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; বাংলাদেশ সেন্টার ফর গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি; সেন্টার ফর পার্টিসিপেটরী রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট (সিপিআরডি) এবং দ্যা আর্থ কর্তৃক আয়োজিত Global Policy Narrative of Climate Change and National Environmental Situation (জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক নীতি বিবরণ এবং জাতীয় পরিবেশ পরিস্থিতি) শীর্ষক একটি জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে উক্ত সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ক্লাইমেট পার্লামেন্ট বাংলাদেশের সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি এবং বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমী।

সেমিনারের প্রথম অধিবেশনে ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ এর সহ-সভাপতি স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী-র সভাপতিত্বে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সিপিআরডি’র প্রধান নির্বাহী মোঃ শামসুদ্দোহা। এবং দ্বিতীয় অধিবেশনে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমী’র সভাপতিত্বে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্টামফোর্ড বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

উক্ত সেমিনারের আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ডিআইইউ-এর উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গনেশ চন্দ্র সাহা; দ্যা আর্থ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মামুন মিয়া, USAID বাংলাদেশ-এর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিষ্ট মোঃ সাইয়েদুল ইসলাম। সেমিনারের সার্বিক সঞ্চালনায় ছিলেন ডিআইইউ-এর পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক মোঃ ফজলুল হক (পলাশ) এবং স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন ডিআইইউ-এর পলিটিক্যাল সাইন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শরিফুল আলম।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি বলেন, ঢাকার বায়ু দূষণ যেভাবে বাড়ছে এভাবে ক্রমাগত চলতে থাকলে ভবিষ্যতে বায়ু দূষণজনিত বিশেষ স্বাস্থ্য সেবা প্রদান করতে হবে। উপকূলীয় অঞ্চলে পানির লবনাক্ততা বৃদ্ধির কারণে নবাগত শিশুদের মাঝে নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে এবং নারীদের বন্ধাত্ত্বতা বাড়ছে। সংকট মোকাবেলায় সমাজের সকল স্তরের সবাইকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় তরুণ, একাডেমিশিয়ান, এডভোকেট সহ সর্বস্তরের মানুষের বিষয়টিকে বুঝতে হবে এবং এ থেকে পরিত্রাণের উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে সাধারণ জনগণকে সহযোগিতা করে এগিয়ে যেতে হবে।

প্রথম অধিবেশনের মূল বক্তব্যে সিপিআরডি-এর প্রধান নির্বাহী মোঃ শামসুদ্দোহা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার একমাত্র উপায় হচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতা শিল্প বিপ্লব শুরুর সময় হতে বর্তমানে যেন তা ১.৫° সে. এর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে তা নিশ্চিত রাখা। দুঃখের বিষয় হলো অধিক গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন না করে জলবায়ু ফান্ডের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কম গ্রীন হাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য প্রণোদনা প্রদান করছেন। বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতির এ দ্বিমুখীতা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার পরিবর্তে জলবায়ু ঝুঁকিগ্রন্থ জনগোষ্ঠি ও দেশসমূহের বিপদাপন্নতা ক্রমেই বাড়াচ্ছে। তবে কপ২৬ ও কপ২৭ এ জীবাশ্ম জ্বালানী হতে সরে এসে পরিচ্ছন্ন জ্বালানী ব্যবহারের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সবাই একমত হয়েছে।

দ্বিতীয় অধিবেশনের মূল বক্তব্যে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এর বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার তার মূল প্রবন্ধে বলেন, বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রণীত বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২-এ নির্ধারিত পরিবেষ্টক বায়ুর মানমাত্রা বিশ্বের উন্নত দেশ এমনকি অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী। পূর্বে বায়ুর দূষক বস্তুকনা২.৫ এর বার্ষিক মান প্রতিঘনমিটার বায়ুতে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থাকলেও বর্তমানে এটি ৩৫ মাইক্রোগ্রাম নির্ধারন হয়েছে, যা দেশের বায়ুদূষণের বর্তমান খারাপ অবস্থা থেকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রন) বিধিমালা ২০২২-এ তাপ বিদুৎ কেন্দ্র-এর জন্য নির্ধারিত স্ট্যাক নি:সরণ মান চীন, জাপান, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি। যারা বাংলাদেশের পাওয়ার সেক্টরের জন্য পলিসি প্রণয়নে ও প্লান্ট স্থাপনে সহায়তা করছেন তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশের আদর্শমান অনেক বেশী, এই দ্বিমুখীতা অনাগত দিনগুলোতে বায়ুদূষণ বৃদ্ধিসহ বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও জীববৈচিত্রের বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। তাই, সরকার কর্তৃক প্রণীত বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ পুনরায় বিবেচনা জরুরী এবং আন্তর্জাতিকভাবে অতিসত্ত্বর ক্লিন এনার্জির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, কপ সম্মেলনগুলো নিঃসন্দেহে একটি ভাল উদ্যোগ-এর ফলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য অনেক ইতিবাচক জিনিস উঠে এসেছে। বিশেষত কপ২৭-এ লস এন্ড ড্যামেজ ও কার্বন ইমিশন এর মত যে সকল আর্থিক বিষয়গুলো নিয়ে ঘোলাটে মনোভাব ছিল তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারোয়ার ইমতিয়াজ হাশমী বলেন, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদেরকেই কাজ করতে হবে। স্টেক ইমিশনের মত সংবেদনশীল বিষয়ে মানমাত্রা নির্ধারনের পূর্বে আমাদের দেশীয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত হয়ে কাজ করতে হবে, বিশেষকরে তরুণদের নিয়ে সামাজিক সচেতনতা কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্ট বাংলাদেশ এর সহ-সভাপতি স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ আলী নকী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি আন্তর্জাতিক বিষয়, এটি কারও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য কোন দেশ নিমজ্জিত হয় তবে ক্ষতি শুধু ঐদেশের নয়, আন্তর্জাতিকভাবে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হবে কারণ গ্লোবালাইজেশনের এই যুগে এক দেশ অপর দেশের উপর নির্ভরশীল।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখন চিন্তা করব যে জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের থেকেই শুরু হয়েছে তখনই আমরা সমস্যার সমাধানের ব্যবস্থা করতে পারবো।

ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. গনেশ চন্দ্র সাহা বলেন, আমরা উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির মূল ভুক্তভোগী কিন্তু আমরা এর জন্য মূলত দায়ী নই। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সংকট মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। জলবায়ু নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যা কিছু আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় তার অধিকাংশই বাস্তবায়ন হয় না; তাই বর্তমানে আমাদের বাস্তবায়নের দিকে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে।

দ্যা আর্থ সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ মামুন মিয়া বলেন, “বাংলাদেশের পরিবেশ ও জ্বালানি নীতিগুলোতে একটু কঠোরতা রয়েছে যদিও বাজার-ভিত্তিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এখানে নমনীয়তার সুযোগ আছে। আমাদের পরিবেশ ও জ্বালানি নীতির চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা করতে এবং সুযোগগুলিকে কাজে লাগাতে, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার উন্নতি, জনসচেতনতা ও শিক্ষা বৃদ্ধি এবং টেকসই পদ্ধতি গ্রহণ ও প্রচারের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

USAID বাংলাদেশ এর প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিষ্ট মোঃ সাইয়েদুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে বিষয়ে বাংলাদেশের নগরায়ন এবং উন্নয়ন কার্যক্রমের ভূমিকা সচেতনভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং টেকসই পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে।

উক্ত সেমিনারে আরো উপস্থিত ছিলেন স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ও ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীগণ, বিভিন্ন সংস্থার গবেষকগণ, সামাজিক ও পরিবেশবাদি বিভিন্ন সংস্থার সদস্যগণ।

সেমিনারের সমাপ্তি অংশে বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’র মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। এবং আগামী ৩ মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গনে ক্যাপস এবং ইয়ূথনেট-এর উদ্যোগে ফ্রাইডেস ফর ফিউচার এর আহবানে গ্লোবাল ক্লাইমেট স্ট্রাইক-২০২৩ এর সবাইকে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়।