Home মতামত ছিন্নভিন্ন করো ধর্মীয় উন্মাদনায় উগ্রবাদের চাষাবাদ !

ছিন্নভিন্ন করো ধর্মীয় উন্মাদনায় উগ্রবাদের চাষাবাদ !

77

আহমেদ জালাল : পুরনোকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণ করে নেওয়াই মানুষের সহজাত প্রবণতা। মহাকালের অমোঘ নিয়মে ইতিহাসের পাতা থেকে বিদায় নিল আরেকটি বছর। বিদায়ী বছরে রেখে যাওয়া স্মৃতি-বিস্মৃতি আলোড়িত হবে প্রকৃতি-পরিবেশ-মনুষ্য সভ্যতায়। বিদায়ী বছরে দেশবাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, সহিংসতা, নৃশংসতা, নির্মমতা। নানা ঘটন-অঘটন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, চড়াই-উতরাই, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হয়ে কালের গর্ভে সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেল গেল বছরটি। নানা ক্ষেত্রে উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে পার হয়েছে বছরটি। বিশ্বজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল করোনা মহামারি, করোনার ধরন ডেলটা-অমিক্রন, টিকা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা, আফগানিস্তান পরিস্থিতি, মহাকাশ পর্যটনসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। দেশে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা দামামা বাজিয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা সবখানেই চরম ভীতিকর অবস্থা। এ যেনো সবখানেই যুদ্ধের দামামা। এ অবস্থায় পুরো সভ্যতাই হুমকির মুখে পড়েছে। দেশে দেশে চলছে বোমা হামলা। দেশে দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সহিংস উগ্রবাদ আর কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা। এই বঙ্গদেশজুড়ে জোরেশোরেই চলছে ধর্মীয় উন্মাদনার বিষবাষ্প। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি ধর্মান্ধের বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। বীরপদর্পে ধর্মের নামে ব্যবসা চালিয়ে আসছে। ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। যত সময় এগিয়েছে, ততই বিভিন্ন দল ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়েছে। এ কারণে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সেই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠি আবারো ফণা তুলছে।
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বাংলাদেশ গড়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করে সুবিধা নেওয়ার জন্য একটি বিশেষ মহল সবসময় উদগ্রীব থাকে। ধর্মীয় উন্মাদনা সাম্প্রদায়িকতাকে তীব্রভাবে উসকে দেয়। মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা না করে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্র ইত্যাদিতে পার্থক্য করে দেখাই সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা এমন এক উগ্র সংস্কৃতি যা এক গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ও জাতির ওপর অন্য গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ও জাতির আধিপত্যের লড়াই। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ও আক্রোশের জন্ম দেয়। বাংলার মধ্যযুগীয় কবি বড়ু চণ্ডীদাসের বাণী, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। শৈশব থেকে এই মাটির দার্শনিকতার সঙ্গে পরিচয় যদি আন্তরিকভাবে করানো যায়, তবে শ্রেষ্ঠত্বের জঙ্গিবাদী ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ খুন করার কথা না। আমাদের চলমান সংস্কৃতিকে যদি আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের যে দলিলবদ্ধ রূপ, তার নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক অংশের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়, সেখানেই দেখা মিলবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের বর্ণিল রূপ। অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বসহই ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বাস ও সংস্কৃতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের শত ঝর্ণার জল।
গাহি সাম্যের গান/যেখানে আসিয়া থেমে গেছে সব বাধা-ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান-এভাবেই মানুষে মানুষে সমতার স্বপ্ন জাগিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সৃষ্টির আলোয় ধারণ করেছিলেন প্রেম ও মানবতাকে। সত্য ও সুন্দরের আরাধনা ছিল তাঁর সৃষ্টিশীলতার মন্ত্র। অন্যায় কিংবা শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে বিদ্রোহী কবির কলম। গান ও কবিতায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে স্বদেশমুক্তির আকাঙ্খা ও অসাম্প্রদায়িকতা।
প্রাচীন গ্রিক সোফিস্টরা সবার উপরে মানুষকে স্থান দিয়েছেন। তাঁদের মতে মানুষ সবকিছুর পরিমাপক। সমাজবদ্ধ মানুষ নানা ধর্মে বিভক্ত থাকে। কিন্তু সব ধর্মের মানুষ একইসঙ্গে শান্তিতে বসবাস করবে, এ জন্যই অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেওয়া হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা হলো এমন একটি বিষয় বা আদর্শিক ভাবাদর্শ, যেটি দেশ-কাল-পাত্রভেদে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ঐক্য, শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে।
মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ থাকতে পারে না, সেটাই ফুটে উঠেছে মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক ও মরমি কবি লালনের উক্তিতে-
‘হিন্দু খ্রিস্টান আর মুসলমান
রক্তে বর্ণে নেই ব্যবধান
সুন্নত দিলে হয় মুসলমান
বামুন চিনি পৈতার প্রমাণ
বামুনি চিনি কি ধরে।’
যাইহোক-সময়ের চক্রে আর কখনোই ফিরবে না ২০২১ খৃষ্টাব্দ। সময় বহমান স্রোতের মতো। সময়কে কখনো বেঁধে রাখা যায় না। তাই একের পর এক পঞ্জিকার পাতা উল্টে চলে যায় দিন, মাস, বছর, যুগের পর যুগ। কালের পরিক্রমায় এভাবেই দিনপঞ্জির পাতা উল্টাতে উল্টাতে দোরগোড়ায় হাজির হলো নতুন বছর ২০২২ খ্রিস্টাব্দ। শুভ ইংরেজি নববর্ষ। নতুন বছরে নতুনভাবে চলতে। নতুনভাবে জীবনযাপন করতে, নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গীকারের মধ্যে প্রধান হয়ে ওঠে। ব্যক্তিচরিত্র বদলেরও অঙ্গীকার করি আমরা। এসবই বিগত বছরের ভুলত্রুটি শুধরে নিয়ে নতুনভাবে, স্বচ্ছ ও সঠিকভাবে পথচলার অঙ্গীকার। আনন্দ-বেদনা, সাফল্য-ব্যর্থতা, আশা-নিরাশা, প্রাপ্তি-প্রবঞ্চনার হিসেব-নিকাশ পেছনে ফেলে নতুন বছরকে স্বাগত। বিশ্ববাসীর সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষও এই খ্রিষ্টীয় বছরকে বরণ করবে নতুন আশা, স্বপ্ন ও উদ্দীপনা নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, ‘বন্ধু হও, শত্রু হও, যেখানে যে কেহ রও,/ ক্ষমা করো আজিকার মতো,/পুরাতন বর্ষের সাথে/পুরাতন অপরাধ যত।’ আমাদেরও প্রত্যাশা পুরনো বছরের যত ব্যর্থতা-বেদনা, হতাশা-নিরাশা এমনি করে ক্ষয় হোক আবর্ত আঘাতে।
কবি সুফিয়া কামাল লিখেছেন,‘অনন্ত সূর্যাস্ত-অন্তে আজিকার সূর্যাস্তের কালে/সুন্দর দক্ষিণ হস্তে পশ্চিমের দিকপ্রান্ত-ভালে/দক্ষিণা দানিয়া গেল, বিচিত্র রঙের তুলি তার/বুঝি আজি দিনশেষে নিঃশেষে সে করিয়া উজাড়/দানের আনন্দ গেল শেষ করি মহাসমারোহে।
সংগ্রামী, লড়াকু ও আশাবাদী মানুষের প্রত্যাশা সব ধরণের স্থবিরতা কাটিয়ে নতুন বছর সবার জীবনে বয়ে আনবে অনাবিল আনন্দ। শান্তি, সমৃদ্ধি, স্বস্তি, গতিময়তায় নতুন আশার আলো প্লাবিত করবে দিক-দিগন্ত। আর নতুনের মধ্যেই যে নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ নিতে বিদায়ী বছরের ভুলগুলো শুধরে ইতিহাস থেকে ভালো ভালো শিক্ষা গ্রহণ করে ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের প্রত্যাশা। অসম্প্রদায়িক,বাঙ্গালি সংস্কৃতি নির্ভর সমাজ কাঠামোতে প্রতিটা মানুষ তার ধর্ম,বর্ণ, গোত্র ও বিশ্বাস নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করার স্বপ্নে মহান মুক্তি সংগ্রামে দেশের অগণিত মানুষ আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন। মুক্তিকামী মানুষের স্বপ্ন ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। কথা ছিল বৈষম্যমুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক, অন্যায়, অবিচার, শোষণ, নিষ্পেষণমুক্ত সামাজিক ন্যায় বিচার ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এরফলে এখানকার রাজনীতি, সংস্কৃতি, দর্শন, আদর্শ, মূল্যবোধ, তথা যাবতীয় কর্মধারা আবর্তিত হওয়ার কথা সেই আদর্শ-কে ঘিরে। প্রশ্ন হচ্ছে- স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিক্রম হলেও আদর্শবাদী সমাজ ব্যবস্থার পথ বয়ে কি চলছে? নাকি আবহমান বাঙ্গালী সংস্কৃতির বিপরীতে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনায় উগ্রবাদের চাষাবাদ হচ্ছে? একটা সমাজের বাস্তবতা ঠিক করে দেয় সমাজে বাসকারী মানুষের সাথে মানুষের কি সম্পর্ক দাঁড়াবে, কোন মতাদর্শের মাঝ দিয়ে সমাজটা এগুবে।
সংস্কৃতি হলো মানুষের আচার-আচরণের সমষ্টি, মানুষের জাগতিক নৈপুণ্য ও কর্মকুশলতা। তার বিশ্বাস, আশা-আকাঙ্ক্ষা, নৈতিকতা, রাজনীতির ভাষা, কলা, মূল্যবোধ সবকিছুই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায়, বিচিত্র মানুষ, বিচিত্রভাবে বসবাস করে। এটাও এদেশের সংস্কৃতি। সময়ের পরিক্রমায় অনেক গ্রহণ, বর্জন, পরিবর্তন, পরিমার্জনের মধ্যদিয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে অনেক নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে, আবার হারিয়ে গেছে অনেক উপাদান। যুগে যুগে মানবের কল্যাণ কামনায় গীত হয় সাম্যের গান। জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সংস্কৃতি হয়ে ওঠে মানুষের জীবন ও জাতিসত্তা নির্মাণের প্রধানতম নিয়ামক। সম্প্রদায় ও সাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা বিলুপ্ত হয় মানবজীবন থেকে উৎসারিত ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে। ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় বিভাজন অনুমোদন করে না। আর তাই এই অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ অনেক মানবিক ও শান্তি মুখাপেক্ষী।
বলাবাহুল্য : বাঙালিদের একটি নিজস্ব বর্ণমালা এবং একটি বর্ষপঞ্জি রয়েছে। নিজস্ব বর্ষপঞ্জি থাকার কারণে বাঙালি বছরে দু’বার বর্ষবরণ করে, তার একটি পয়লা বৈশাখ। আরেকটা হলো ১লা জানুয়ারি। বাঙালি একবার বলে শুভ নববর্ষ। আরেকবার বলে হ্যাপি নিউ ইয়ার। হে প্রজন্মের মানুষ।
পরিশেষে মানুষের হাতেই তো সকল শক্তি ন্যস্ত করেছে মহাকাল। নতুনের মধ্যে নিহিত থাকে অমিত সম্ভাবনা, জ্বলে ওঠো। বন্ধ হোক ধর্মীয় উন্মাদনায় উগ্রবাদের চাষাবাদ। ছিন্নভিন্ন করো বাঙালি সংস্কৃতিবিরোধী মৌলবাদের হিংস্র থাবা। উপরে ফেলা হোক ধর্মীয় উন্মাদনা। ছিন্নভিন্ন করো দুর্নীতি-অনিয়মের যাতাকল। বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার প্রত্যায়ে….
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক ও বার্তা প্রধান, রণাঙ্গণের মুখপত্র “বিপ্লবী বাংলাদেশ”।

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।