Home Uncategorized গল্প : নোনা জলের কাব্য

গল্প : নোনা জলের কাব্য

59

পলাশ কলি হোসেন শোভা: এত বড় উঠানটা ঝাড়ু দিতে দিতে কোমর ধরে যায় মদিনার। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই সামনের দিকে চোখ যায়। ইকটু হতচকিয়ে যায় মদিনা একি শফি মোল্লা ওভাবে তাকিয়ে তার দিকেই কি দেখছে! গতরটা ভালো করে আঁচল দিয়ে ঢেকে নেয় সে।

চাচা জান কিছু কইবেন? এমন প্রশ্ন শুনে সম্বিৎ ফিরে পায় শফি মোল্লা। আরে না, তোর কাম দেখতাছিলাম,ভালা কইরা আজ উঠানডা লেইপা দিস। একথা বলেই ঘরের ভিতরে চলে যায় মোল্লা।
সেই দশ বারো বছর থেকেই নবীনগরের চেয়ারম্যান শফি মোল্লার বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। এখন তার বয়স উনিশ বছর হতে চললো। বাড়িতে অসুস্থ বাবা আর ছোট ছোট ভাইবোন মা সবই আছে। দুটো ছোট ভাইকে লস্কর বাড়িতে কাজে দিয়েছে।

তারপরও অভাব যেন পিছু ছাড়তে চায় না মদিনার।
দেশের অবস্থা ভালো নয়। মদিনা ইকটু ইকটু শোনে দ্যাশ ভাগ হইয়া যাইতে পারে। মুজিব গরীবের অধিকার আদায়ের লাইগা লড়তাছে এরচে বেশি মদিনা বোঝেনা।

সকাল সকাল মোল্লা বাড়িতে কাজে গিয়েই দেখে বেশ অনেক লোকজন বাড়ি ভর্তি। তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়ে সে। শফি মোল্লার বউ খুব ব্যস্ত মদিনাকেও কাজের তাড়া দিচ্ছে। মদিনা কানাঘুষায় শুনতে পায় দ্যাশে যুদ্ধ লাগছে শেখ সাহেবরে বন্দী করছে। শহরের মানুষ গ্রামে আসতাছে। মদিনা এসবের কিছুই বোঝে না।

দিন যায় শফি মোল্লারও পরিবর্তন হতে থাকে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়ে মিলিটারীদের সাহায্য করে গ্রামে রাজাকার বাহিনী তৈরী করে। মদিনা ভয়ে ভয়ে থাকে চাচী বলে, ও মদিনা এত ডরাস কেন? আমাগো বাড়িতে মিলিটারী আইবো না। তুই মন দিয়া কাম কর্।

দিনটা ছিলো আষাঢ় মাসের ৩ তারিখ। রাতে বাড়িতে ঘুমায়ছিলো মা বাবারে নিয়া মদিনা। হঠাৎ ফিসফিস শব্দে ঘুম ভেঙে যায় মদিনার দেখে তার চারপাশে কয়েকজন মুখ বাধা। মদিনাকে তুলে নিলো। কোন বাধাই টিকলো না
জঙ্গলের দিকে একটা মাটির ঘরে নিয়ে ঢুকে রাজকাররা।

চমকে উঠে মদিনা, চাচা আফনে? আমারে এহানে আনছেন ক্য?
চুপ একদম চুপ। সে রাতের ঘটনা বা বর্ণনা এক জীবনে ভোলার নয়। তারপর আর কোনদিন মদিনাকে মোল্লা বাড়িতে কামে দেখে নাই কেউ।
দিন যায় বছর যায়, আর যায়……..

মদিনা ও মদিনা, গোস্বা করনের কাম কি? আমি তো আছি না কি?
সাপের ফনার মত ফোঁস করে উঠে মদিনা, চাচা জান আফনে আমার এত বড় সর্বনাশ ক্যান করছেন কন তো? কথা শেষ করার আগেই শফি মোল্লা খেজি দিয়ে উঠে, ওই তোরে না মানা করছি চাচা কবি না।
চাচা রে চাচা কমু বা তো কি কমু?

ওই তোর আমি কোন জম্মের…. কথা শেষ করার আগেই নিজেকে সামলে নেয় শফি মোল্লা, নাহ্! এভাবে নয়
গলার সুর টারে নরম কইরা কয়, শোন মদিনা, তোরে আমার বড়ই পছন্দ । তুই অহন থেইক্কা এহানেই থাকবি গেদু তোর দেহা শোনা করবো। আমি তোরে বিয়া করমু, তয় কেউ যেন জানতে না পারে তুই এহানে আছোস। ওই গেদু হালার পো থাহস কই, লেংড়া কাজী রে খবর দে, আজ রাইতেই বিয়া অইবো। দেইখা শুইনা রাখবি। আমি অহন যাইতাছি রাইতে আইমু। একথা বলেই মদিনার মাথায় হাত দিতে চায়, এক ঝটকায় মদিনা কুওার বাচ্চা বলে সরে যায়। বিচ্ছিরি ভাবে হেসে উঠে শফি মোল্ল্লা। ঘর থেকে বের হতে হতে ভাবে ফণা তোলা সাপ রে বশ করাই তো আমার কাজ।

বাড়ির উঠানে পা দিতেই দেখতে পায় অনেক লোকজন বসা। মোল্লা গলা খাখারি দিয়ে বলে, এক রাইত বাড়িত আছিলাম না আর সব বেইড়া দিয়া বইছো কারণডা কি?
গায়ে গতরে সুঠাম দেহের লতিফ ফকির বলে, আছিলেন কই কন তো? এদিকে আমরা খুইজা মরি।
কি দরকার পড়লো তোগো?
কন কি চেয়ারম্যান সাব কমিটির মিটিং আছিলো গত রাইতে, ভুইলা গেলেন কেমতে?
জানো তো তোমরা শান্তি কমিটির কত কাজ। ক্যাপটেন সাব খবর দিসিলো। আইতে বেলা হইয়া গেলো কথা গুলো ঠিক মত গুছিয়ে বলতে পারে না। নিজেকে কেমন চোর চোর লাগে মোল্লার।

চেয়ারম্যান সাব এদিকে তো মুক্তি গো ঢুসঠাস বাইড়া যাইতাছে, কিছু একটা করেন। লইত্যা বেশি কথা কস। মুখেও আনবি হেগো কথা। আমরা কি বইয়া রইছি? আমার রাজাকার বদর এরা তো আছে না কি?
এর মধ্যে রোগা পটকা বয়স্ক একজন বলে বসে, চেয়ারম্যান ক্যাপটেন সাবগো একবার আইতে কন সব ঢুসঠাস বন্ধ অইয়া যাইবো
ওই ফহিন্নি না বুইজা কতা কস ক্যান? মিলিটারী আইলে গ্রামের কিছু থাকবো? মা বইনগো লইয়া টানা টানি পরলে শালা কেমনে সামাল দিবি?

মোল্লা একজন দেশ বিরোধী লোক হলেও নিজ গ্রামের রক্ষা করতে যেন বন্ধ পরিকর। এই কতা কইতেই আইসোস বাড়িতে? যা অহন আমি ঘুমামু।
কন কি চেয়ারম্যান , পুব পাড়ার রইসউদ্দীনরে যে গতরাইতে মুক্তি রা মাইরা গেলো ওই হানে আপনি যাইবেন না? এইডা কি হয়? ইকটু চমকে উঠে শফি মোল্লা বলে কি! এত কাছে মুক্তি চইল্লা আইছে। ভয় পেলেও বলে, আরে দূর কত কি দ্যাখবা মিয়ারা এইসবে ডরাইলে চলবো? যাও উঠান ছাড়ো। একথা বলে ঘরের ভেতার ঢুকে পড়ে সে।

সেখানে শুরু হয় আরেক কাহিনি। যার নাম বউ কাহিনি ।
কই আছিলেন সারারাইত? চোখের পাতা এক করতে পারিনাই। ভোরে কে জানি খবর দিয়া গেলো মদিনা রে পাওয়া যাইতেছে না।
চুপ কর বেটি। সারারাত কাম কইরা আইছি, অহন তোর মদিনার কতা শুনতে?
আফনে তো হেরে মাইয়ার মতন আদর করতেন। ইকটু খোঁজ লাগান না, বলেই হু হু করে নাকি সুরে কাঁদতে লাগলো মোল্লার বউ বিলকিস বানু।
তুই থামবি? নাকি তোরেও….. কথাটা শেষ করে না চুপ হয়ে যায়। ভাবে…. (চলবে)

-লেখক : প্রফেসর (অব.) মীরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ।