Home বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি কী হবে যদি কেউ ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি চলে যায়

কী হবে যদি কেউ ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি চলে যায়

33

ডেস্ক রিপোর্ট: আমাদের জ্ঞানের পরিধি অনুযায়ী এই মহাবিশ্বের সবচেয়ে রহস্যময় এবং চরম জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়বস্তু হলো ব্ল্যাক হোল। ব্ল্যাক হোল এমন একটি জায়গা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতটাই চরম যে কোনো বস্তু দূরে থাক, আলোও সেখানে হারিয়ে যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্ল্যাক হোল গুলি তারাদের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে তৈরি হয় যেটি সুপারনোভা নামে পরিচিতি এবং মহাজাগতিক বিস্ফোরণে তা ধ্বংস হয়ে যায়।

একটি ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে রয়েছে সিঙ্গুলারিটি—যা এক-মাত্রিক বিন্দু এবং সেখানে মাধ্যাকর্ষণ অসীম। এমনকি সেখানে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলিও কাজ করেনা। ব্ল্যাক হোলের আশেপাশে ‘ঘটনা দিগন্ত’ নামে পরিচিত সীমানা রয়েছে। সেই সীমানার মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ টানের কারণে কিছুই পালাতে পারে না। এর নাম ঘটনা দিগন্ত রাখা হয়েছে কারণ এর ভিতরে ঘটছে এমন কোনো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করা একবারেই অসম্ভব।

ব্ল্যাক হোলকে দুটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন গবেষকরা। শ্রেণি দুটি স্টারলার এবং সুপারম্যাসিভ নামে পরিচিত। যদিও সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে একটি মধ্যবর্তী শ্রেণিও থাকতে পারে। নক্ষত্র থেকে সৃষ্ট ব্ল্যাক হোলের ভর আমাদের সূর্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ভর লক্ষ লক্ষ থেকে বিলিয়ন সৌর ভরের সমান হতে পারে।

আপনি যদি একটি ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে যান তবে কী ঘটবে?

চলুন, একটি অনুমানমূলক পরিস্থিতি কল্পনা করা যাক যেখানে মানব সভ্যতা আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণ আয়ত্ত করেছে (আমাদের সৌর জগতের সবচেয়ে কাছের ব্ল্যাক হোল হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরে বলে মনে করা হয়) এবং একজন মহাকাশচারী কোনো এক মহাকাশযানে বা মহাকাশে ভ্রমণের সময় একটি ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি পথভ্রষ্ট হয়েছেন। কি হবে তখন?

ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং পদার্থবিদ বেন ফার বলেছেন, ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন’ হল ঘটনা দিগন্ত। এটি সেই বিন্দু যেখানে ব্ল্যাক হোলের কারণে সৃষ্ট স্থানের বক্রতা এতটাই চরম মহাবিশ্বের দ্রুততম গতিশীল আলোর কণাও ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্র ছাড়া যে কোনো জায়গায় যেতে পারে।

ফারের মতে, একটি সাধারণ ‘নাক্ষত্রিক ভর’ হলো ব্ল্যাক হোলের ঘটনা দিগন্ত। এর ভরও আমাদের সূর্যের ভরের দশগুণ। ঘটনা দিগন্ত নামে পরিচিত এই স্থানটি তার কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে। আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রে অবস্থিত একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের আকার অনেক বড় এবং এটি প্রায় ১২ মিলিয়ন কিলোমিটার।

আপনি যদি একটি ব্ল্যাক হোলের খুব কাছাকাছি আসেন তাহলে আপনি কেন্দ্রের দিকে মুক্তভাবে পতিত হবেন। যতই এর কাছে যাবেন ততই মহাকর্ষীয় শক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং আপনার শরীরের ওপর একটি টান শক্তি তৈরি হবে।

কিন্তু ব্ল্যাক হোলের ‘ঘটনা দিগন্তের’ কাছাকাছি চলে কোনো নভোচারী চলে গেলে তার ওপর কি রকম প্রভাব পড়বে সেটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে ব্ল্যাক হোলের আকারের ওপর। সম্ভবত কাউন্টারটেইটিভলি, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল অন্তত স্বল্প সময়ের জন্য নাক্ষত্রিক ভরের চেয়ে বেশি নিরাপদ হতে পারে।

ফার বলেছেন, একটি নাক্ষত্রিক ভরের সমান ব্ল্যাক হোলের ‘ঘটনা দিগন্তের’ বাইরে চরম জোয়ার রয়েছে। সে জোয়ারের শক্তি এতটাই প্রকট যে একজন নভোচারির দেহ ‘ঘটনা দিগন্ত’ পৌঁছানোর আগেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। নভোচারীরা প্রথমে পায়ের দিকে তারপর আস্তে আস্তে মাথার দিকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি অনুভব করবে।

চরম জোয়ারের কারণে মহাকাশচারীরা ‘স্প্যাগেটিফিকেশন’ নামে এক ধরণের প্রভাব অনুভব করবেন। জ্যোতির্পদার্থবিদ্যায় স্প্যাগেটিফিকেশন হল খুব শক্তিশালী একটি অ-সমজাতীয় মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রের মধ্যে দীর্ঘ পাতলা আকারে বস্তুর উল্লম্ব প্রসারিত এবং অনুভূমিক সংকোচন। এটা চরম জোয়ারের শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট হয়। সহজভাবে বুঝালে বাড়িতে ময়দার রুটি বানানোর সময় আমরা যেভাবে ময়দার বল ইচ্ছামতো প্রসারিত করতে পারি ‘স্প্যাগেটিফিকেশন’-এর প্রভাবে ঠিক তেমনটাই ঘটবে একজন নভোচারীরর সঙ্গে।

কেস ওয়েস্টার্ন রিজার্ভ ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্লেন স্টারকম্যান বলেন, ‘ঘটনা দিগন্ত’ নামক জায়গাটি বড় ব্ল্যাক হোলের চেয়ে ছোট ব্ল্যাক হোলের অনেক কাছাকাছি, তাই এর প্রভাবটি ছোট ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে অনেক বেশি হবে।

প্রকৃতপক্ষে একটি নাক্ষত্রিক ভরের সমান ব্ল্যাক হোলের চারপাশে জোয়ার মহাকাশচারী এবং তাদের মহাকাশযানকে কয়েকশ কিলোমিটার দূরে থেকে স্প্যাগেটিফাই করতে যথেষ্ট শক্তিশালী হবে।

ফারের মতে, আশ্চর্যজনক বিষয় হলো একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের কাছে যাওয়া প্রাথমিকভাবে শান্তিপূর্ণ হবে। সেসময় মুক্তভাবে পতিত হওয়া মহাকাশচারী বিশেষ কিছু লক্ষ্য না করেই সেটির ‘ঘটনা দিগন্তে’ পৌঁছাবে এবং এটি অতিক্রম করতে সক্ষমও হতে পারে। তারা সম্ভবত অস্বাভাবিক কিছু অনুভব করবে না।

স্টারকম্যান বলেন, আপনি যদি বড় আকারের ব্ল্যাক হোলের ‘ঘটনা দিগন্তে’ পৌঁছে যান সে সময় আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করা কিছুটা অদ্ভূত হয়ে উঠবে। এর কারণ আপনার কাছ থেকে আসা বার্তাগুলি ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে আরও বেশি সময় নিচ্ছে। এই ঘটনা স্টারলার এবং সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল উভয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। বাড়ি থেকে আপনার বন্ধুরা আপনাকে ‘ঘটনা দিগন্তের’ কাছাকাছি আসতে দেখবে, কিন্তু কখনই আপনাকে এটি অতিক্রম করতে দেখবে না। প্রকৃতপক্ষে আপনি সংক্ষিপ্ত ক্রমে অতিক্রম করবেন।

ফার জানান, সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে, মহাকাশচারী তাদের মহাকাশযানের জন্য ঘটনা দিগন্তের ২৪ মিলিয়ন কিলোমিটার কাছাকাছি একটি স্থিতিশীল কক্ষপথ খুঁজে পেতে সক্ষম হবেন। তখন এটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো জ্বালানীর প্রয়োজন হবে না। এখানেই ব্ল্যাক হোলের চারপাশের মাধ্যাকর্ষণ লক্ষণীয়ভাবে আলাদা হয়ে যায়। ব্ল্যাক হোলে পতিত হওয়া থেকে বাঁচতে সেসময় মহাকাশচারীকে তার মহাকাশযানের ইঞ্জিন ব্যবহার করতে হবে।

তখন ঘটনাটি এমন হবে যে, সে ‘ঘটনা দিগন্তের’ যত কাছে আসবে ততই বৃহত্তর ব্ল্যাক হোল থেকে পালানোর জন্য তার স্পেসশিপের ইঞ্জিনগুলি তার প্রয়োজন হবে এবং ‘ঘটনা দিগন্ত’ অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে তার যাত্রাপথ অসীম হয়ে যাবে।

আপনি যদি ‘ঘটনা দিগন্ত’ অতিক্রম করে ফেলেন তারপের কী ঘটবে?

মহাকাশচারী যদি কোনোভাবে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ‘ঘটনা দিগন্তে’ পৌঁছে যায় তারপরের ঘটনাগুলি সত্যিই অদ্ভুত হতে পারে।

গ্লেন স্টারকম্যান বলেন, আমি এতক্ষণ যা বলেছি তা ‘ঘটনা দিগন্তের’ সাধারণ আপেক্ষিক তত্তের ওপর ভিত্তি করে। এ ব্যাপারে সবাই অবশ্য একমত নাও হতে পারে। কিছু লোক মনে করে ‘ঘটনা দিগন্তে’ প্রচলিত পদার্থবিদ্যা কাজ করে না এবং নানা রকম অদ্ভুত জিনিস আপনার সাথে ঘটবে। এমনও হতে পারে আপনি সম্ভবত কখনোই ‘ঘটনা দিগন্ত’ পারই হতে পারবেন না।

কিন্তু কেউ যদি ঘটনা দিগন্ত অতিক্রম করে, তাহলে সে কি দেখতে পারে? প্রশ্নটি আসতে পারে।

ফার বলেন, একবার ‘ঘটনা দিগন্ত’ পেরিয়ে গেলে মহাকাশচারীর ভাগ্য সম্ভবত এখানেই শেষ হয়ে যাবে। তারা সিঙ্গুলারিটিতে পৌঁছানোর আগেই স্প্যাগেটিফাইড হবে। সম্ভবত সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোলের ক্ষেত্রে এটি অতিক্রম করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা হবে।-আমাদের সময়.কম