Home জাতীয় করোনার দানবীয় তাণ্ডবে বেহাল বাংলাদেশ

করোনার দানবীয় তাণ্ডবে বেহাল বাংলাদেশ

47

এম এইচ নাহিদ: দেশজুড়ে করোনার দানবীয় তাণ্ডব চলছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নামক অদৃশ্য এই দানবের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবে নাকাল গোটা বাংলাদেশ। শহর থেকে গ্রাম-উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় কাটছে দিন। মৃত্যুর মিছিল একদিন কমছে তো পরের দিনই আবার ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছে। শনাক্তের সংখ্যাও তাই। একের পর এক রেকর্ড ভাঙছে শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড। বাড়ছে লাশের সারি। এক সাথে এত মৃত্যু মানুষ এর আগে দেখেন নি। মরণঘাতী করোনা তা দেখিয়ে দিল। কোনো কিছুতেই করোনার দানবীয় তাণ্ডবলীলা থামছে না। ৯ জুলাই করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ২১২ জনের। পরদিন ১০ জুলাই মৃত্যু নেমে আছে ১৮৫-তে। মানুষ ভাবতে শুরু করে করোনা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু ১১ জুলাই সে ধারণাকে পাল্টে দিয়ে মৃত্যু সংখ্যা বিগত দিনের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে পৌঁছে যায় ২৩০-এর কোঠায়। ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে মৃত্যুর মিছিলে আগের দিনের চেয়ে ৪৫ জন বেশি যুক্ত হন। ১০ জুলাই শনাক্ত’ও আগের দিনের চেয়ে ২৫৯২ জন কমে দাঁড়ায় ৮৭৭২ জনে। কিন্তু ১১ জুলাই আবার শনাক্ত বেড়ে দাঁড়ায় ১১৮৭৪ জনে। গত সাত দিনে মুত্যু ও শনাক্ত সবচেয়ে বেশি। এই এক সপ্তাহে মরণঘাতী করোনায় মৃত্যুযাত্রী হয়েছেন সাড়ে ১৩ শ’র বেশি। এ সপ্তাহে গড় মৃত্যু ১৯৩ জন। আর করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে ৭৬ হাজারের ওপরে। দৈনিক গড় শনাক্ত ১০ হাজার ৮৯৪ জন। এখন পর্যন্ত দেশে মৃত্যুর মিছিল প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার যুক্ত হয়েছেন। শনাক্ত ১০ লাখের ওপরে। বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশের বাংলাদেশের সনাক্তের হার ৫ গুণের বেশি।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন ফিল্ড হাসপাতালের বিকল্প নেই। সরকারও সেটাই ভাবছেন। অন্যদিকে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সামনের দিনে আরো পারবে না। ভুলে ভুলে দিন পার! স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বেহাল দশা অনেক আগে থেকেই। কোভিড তা দৃশ্যমান করে দিয়েছে। এখন পাড়ার চায়ের দোকান থেকে সংসদ-সর্বত্র ‘স্বাস্থ্যে’র সমালোচনা। কিন্তু তাতে কী ‘স্বাস্থ্য’ চলছে ‘স্বাস্থ্যে’র মতো। দেশের সকল জেলায় আইসিইউ-এর ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে মানা হয়নি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও। দেশজুড়ে আইসিইউ সংকট, সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলার ঘাটতি। অক্সিজেন সংকটও দিন দিন বাড়ছে।
‘স্বাস্থ্যে’র অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতার কারণে এই সংকট বাড়লেও মানুষের মধ্যে সচেতনতা মোটেও বাড়ছে না। কঠোর বিধিনিষেধ দিয়েও মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না। জরিমানা দেওয়ার পরেও তারা ঘরে থাকছে না। পাড়া-মহল্লায় মানুষের জটলা বাড়ছে। সড়কেও মানুষের ভীড় কম নয়। চিরচেনা যানজটের দৃশ্য কমে নি। আর গ্রামের মানুষের কথা তো বলাই যাবে না। হাট-বাজার ও চায়ের দোকানে না আসলে তারা শান্তি পান না। অন্যদিকে জ¦র-সর্দিকে তারা মৌসুমী রোগ বলে অবহেলা করছেন। পরীক্ষা করছেন না। ফলে একজন থেকে পুরো পরিবার করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। সামনে গ্রামের পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিন সুত্রে জানাগেছে, গত গতকাল ১১ জুলাই এক দিনে ২৩০ জন করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। এ নিয়ে গত ৭ দিনে মোট মৃত্যু দাঁড়াল ১৩৫৪ জনে। এদিনের মৃত্যু আগের ২১২ জনে মৃত্যুর রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১৬ হাজার ৪১৯ জন মানুষের প্রাণ কেড়েছে মরণঘাতী করোনা। আর এ দিন শনাক্ত হয়েছে ১১ হাজার ৮৭৪ জন। গত ৭ দিনে মোট শনাক্ত ৭৬ হাজার ২৬২ জন। শেষ ১০দিনে শনাক্ত লাখ ছাড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত অদৃশ্য এই দানবের থাবায় মোট আক্রান্ত হয়েছে ১০ লাখ ২১ হাজার ১৮৯ জন। অবশ্য সুস্থ্য হয়েছে ৮ লাখ ৬৮ হাজার ১৩৯ জন। কিন্তু এখনো ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৩১ জন করোনা রোগী মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। এ হিসাব সরকারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে পাওয়া। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। কারণ বহু মানুষ করোনা টেস্ট’ই করছেন না। গ্রামের মানুষ তো সাধারণ সর্দি-জ¦র বলেই চালিয়ে দিচ্ছেন।
বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো দেশে সংক্রমণ দুই সপ্তাহের বেশি সময় ৫ শতাংশের এর নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে করোনায় শনাক্তের দৈনিক হার ৩০ শতাংশের উপরে এবং তা ১ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে আছে। আর গড় শনাক্ত প্রায় ১৫ শতাংশ। অতএব পরিস্থিতি মোটেও ভালো নেই। এ যাত্রায় করোনা মোকাবেলায় সরকার প্রথম দিকে আক্রান্ত জেলাসমূহ এবং পরে রাজধানী ঢাকা ও পাশ^বর্তী জেলাগুলোতে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় সরকার দেশজুড়েই কঠোর লকডাউনের ঘোষণা দেন। পরিস্থি নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নের জন্য সরকার পুলিশের পাশাপাশি সেনা ও বিজিবিও নামায়। তারা দিন-রাত মানুষকে সচেতন করে এবং বিনাপ্রয়োজনে ঘর থেকে না বাহির হওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছেন। কিন্তু শুনছে কে? মানুষ শোনেন না। শুনলে কী আর পাড়া-মহল্লায় মানুষের এত জটলা হয়! সড়কে এত ভিড় বাড়ে! গণপরিবহণ বন্ধ হলে সড়কে যানজট মোটেও কমে নি। মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক নেই। শহরেরই এই অবস্থা। গ্রামের মানুষ তো করোনা আছে বলে এখনো স্বীকার করতে চান না। জ¦র-সর্দি হলে তারা সাধারণত মৌসুমী জ¦র বলেই চালিয়ে দিচ্ছেন। মোটেও হাসপাতালে যাচ্ছেন না। পরীক্ষাও করাচ্ছেন না। ফলে একজন আক্রান্ত হলে পুরো পরিবার আক্রান্ত হচ্ছেন। চায়ের দোকানো আড্ডার কারণে পুরো গ্রামেই করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। তাই গ্রামের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরো ভয়ঙ্কর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
দেশ যখন করোনা ঝরে দিশেহারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসাধু দুষ্টচক্র তখন অক্সিজেন জেনারেটর ক্রয়ের কমিশন লোভে ব্যস্ত। করোনার শুরু থেকে অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে চলছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের অব্যবস্থাপনার কারণে ভুগছেন সাধারণ মানুষ। আরো অনেক আগে প্রধানমন্ত্রী একনেক সভায় বলেছিলেন, “সকল জেলায় আইসিইউ ব্যবস্থা করতে হবে।” কিন্তু এখনো তা করা হয় নি। সারাদেশে ৩৫ টি জেলায় আইসিইউ নেই। যেসব জেলায় আইসিইউ আছে তার মধ্যে ৮২ শতাংশ হাসপাতালে আইসিইউ বেড ফাঁকা নেই। দেশের ১২৯ হাসপাতালে সাধারণ বেড ১৫ হাজারেরও কম। আইসিইউ বেড সংখ্যাও অত্যন্ত নগন্য। কোভিড হাসপাতালগুলোর মধ্যে ৫৪ টিতে আইসিইউ-এর ব্যবস্থা নেই। দেশের ১৬ হাজার হাসপাতালে এখন সক্ষমতার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বেশি। সারাদেশে ১৫ হাসপাতালে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা নেই। মাত্র ৫৬ টি হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। এখনই করোনা রোগীর চিকিৎসা দিতে হাসপাতালগুলো হিমশিম খাচ্ছে। পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হলে এমন নাজুক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে কিভাবে তা সামাল দিবে সেটাই মানুষের চিন্তার বিষয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে ভুল থেকে বেরিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে দ্রুত। পাশাপাশি দেশের ১২ কোটি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। কারণ বেশি দিন বিধিনিষেধ থাকলে অর্থনীতি রক্তশূন্য হবে। হাহাকার উঠে যাবে চার দিকে। একই সাথে জীবনের জন্য জীবিকা এই বিবেচনায় জীবন রক্ষায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অবহেলা না করে মহামারী করোনা প্রতিরোধে সম্মিলিতভাবে লড়াইয়ে নামতে হবে। সে লড়াই বাঁচার লড়াই। ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার লড়াই-বলছেন বিশ্লেষকরা।