ডেস্ক রিপোর্ট : ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস। তখন মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে নরেন্দ্র মোদী। লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্রমেই বাড়ছে উত্তাপ। হঠাৎই বিজেপি নেতা থেকে ব্র্যান্ড মোদী হয়ে ওঠা নরেন্দ্র ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’-এর ডাক দিয়েছিলে। বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারতের ডাক কেবলই একটা স্লোগান নয়, এটা দেশবাসীর সংকল্প।’

এরপর পেরিয়ে গিয়েছে ৮ বছর। ২০১৯ সালে হাত শিবিরকে ধরাশায়ী করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে দেশের ক্ষমতায় বিজেপি। প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে ফের নমো। এরমধ্যেই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নানা চমক দিয়েছে পদ্ম বাহিনী। ২০১৪ সালে দেশের ৭টি রাজ্যের ক্ষমতায় ছিল গেরুয়া দলটি। আর এখন রাজ্য ও কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল মিলিয়ে মোট ১৭টি পরিচালনায় বিজেপি। কংগ্রেস কমতে কমতে শিবরাত্রির সলতে। তাদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ শুধু ছত্তিশগড় ও রাজস্থানে। এছাড়া, তামিলনাড়ু ও ঝাড়খণ্ডে শাসক জোটের শরিক সনিয়ার দল।

গত লোকসভায় ভোটের ফলাফলের নিরিখে প্রায় অর্ধেক দেশবাসীর সমর্থন রয়েছে বিজেপির সঙ্গে। প্রশ্ন এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের মোদীর কংগ্রেস মুক্ত ভারতের ডাক কতটা প্রাসঙ্গিক? নির্বাচনী রাজনীতিতে ২০১৪-র মতই কী এখনও এই স্লোগানের গুরুত্ব রয়েছে?

বিজেপিরই একাংশের নেতৃত্ব মনে করেন যে, এবার ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ স্লোগানে ইতি টানা প্রয়োজন। এমনকী আরএসএস শীর্ষ নেতাদেরও এই স্লোগান নিয়ে আর কথা বলার দরকার নেই।
সম্প্রতি গোয়ায় দলীয় এক সভায় কেন্দ্রীয়মন্ত্রী হরদীপ সিং পুরী বলেছিলেন যে, ‘কংগ্রেসে দেশ থেকে সম্পূর্ণ মুছে যাক সেটা আমরা চাই না। আমাদের বিরোধী প্রয়োজন।’

২০১৪-কে মাথায় রেখে পুরীর মন্তব্যে বিজেপির নয়া রাজনীতির ইঙ্গিত? বিজেপি যা ভাবছে সেটাই কী কৌশলে গোয়ায় বলে দিয়েছেন মোদী মন্ত্রিসভার বর্ষীয়ান এই মন্ত্রী? এই প্রশ্নেই এখন চর্চা চলছে।
এসবের মধ্যেই আবার আঞ্চলিক দল নিয়ে নিজের মতামত সাফ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। অনেক বেশি আঞ্চলিক দল দেশের স্বার্থের পক্ষে ভালো নয় বলে দাবি করেছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরে একটি অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায় মোদী বলেছিলেন যে, ‘সম্পূর্ণ কংগ্রেস মুক্ত ভারত একটি সম্ভাব্য ধারণা নাও হতে পারে।’ তাঁর সংযোজন ছিল, কংগ্রেস ছাড়া ভারতের ধারণা সম্পূর্ণ নয়, কারণ কংগ্রেস দেশের সর্বত্র রয়েছে।

পরে একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি যখন ‘কংগ্রেস মুক্ত’ অভিব্যক্তিটি ব্যবহার করেছিলেন, তখন তিনি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলটিকে নির্মূল করার কথা বলেননি বরং কংগ্রেসী সংস্কৃতি এবং ভাবধারা থেকে মুক্ত করার কথা বলছিলেন।

কংগ্রেসের বদলে আপের উত্থান বিজেপির ধারণা ক্রমশ বদলে দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। সংসদের শেষ বাজেট অধিবেশন চলাকালীন দলের নেতাদের সঙ্গে একটি অনানুষ্ঠানিক আলাপচারিতায়, এক প্রবীণ বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আমরা আর কংগ্রেস মুক্ত ভারত স্লোগান বহন করতে পারি না। আমরা আপের মতো দলগুলিকে রাজ্যে বাড়তে এবং জিততে দিতে পারি না। এটা ভারতের জন্য ভালো নয়।’

বিজেপি নেতাদের উদ্বেগের বিষয় হল আপ এমন একটি দল যার কোনও রাজনৈতিক আদর্শ নেই। অর্থাৎ আদর্শকেন্দ্রীক দল নয়। ইস্যুর ভিত্তিতে লড়াই করে। যা অনেক সময়ই করে থাকে বিজেপি। কিন্তু, গেরুয়া দলের নেপথ্যে রয়েছে আরদর্শও। যা তাঁকে অনেক ভোটারের থেকে দূরে সরিয়েছে। কিন্তু, আপের মতো আঞ্চলিক দলগুলির সেই সমস্যা নেই। এতেই ডরাচ্ছে বিজেপি।

ইতিমধ্যেই দুই রাজ্যের ক্ষমতায় আপ। গোয়ায় দলের বিধায়ক রয়েছে। এবার তাঁদের লক্ষ্য গুজরাট, হিমাচল প্রদেশ, হরিয়া সহ দক্ষিণের কেরলও। এতেই চিন্তা বাড়ছে কেন্দ্রীয় শাসক দলের। নিজেদের উত্থানের পথ মনে করছে পদ্ম বাহিনী। ১৯৮৪ সালে ২টি সাংসদ থেকে এখন বিজেপির সাংসদ সংখ্যা ৩০০-র বেশি। আগামিতে আপের যে তেমনটা হবে না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই বলেই মনে করে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা। আরও মাথা ব্যথা হল যে, আপ মডেল এখন মানুষকে আকর্ষণ করছে।
গেরুয়া শিবিরের অন্দরের খবর, ২০২৪ সালের প্রচারে ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ স্লোগানকে ততটা প্রকট করবে না দল। তবে, যেসব জায়গায় বিজেপির সরাসরি লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গে যেমন, রাজস্থান, ছত্তিশগড় এবং মধ্যপ্রদেশে সেখানে ভোট পর্যন্ত এই স্লোগান জারি রাখা হবে।

বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে কংগ্রেস দলকে নির্মূল করা এখন বিজেপির লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। একটি জাতীয় দলের শক্তিশালী বিরোধী হওয়া দরকার।’

কেন্দ্রীয় শাসক দলের পুরনো কয়েকজন নেতার কথায়, কংগ্রেসের মর্যাদা ও ক্ষমতা কমেছে। বহু রাজ্যে এই দল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রায় ১০টি বেশি রাজ্যে কংগ্রেসের শক্তি যত কমেছে ততই আঞ্চলিক দলগুলি রাজনৈতিক জমি দখল করেছে। যেমন, বাংলা, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু, ওডিশা, কেরলের মতো রাজ্য। নির্বাচনী পাটিগণিত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে বিজেপির সেরা জয়ের সম্ভাবনা সেই রাজ্যগুলিতে যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী এবং বিজেপির সঙ্গে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে।

বিজেপির যা দরকার তা হল প্রতিদ্বন্দ্বী– যাকে দলের প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে রাখা যেতে পারে। আর এখানেই আপ বা অন্য কোনও আঞ্চলিক দলের চেয়ে কংগ্রেস বেশি কার্যকরী প্রমাণিত হবে।-আমাদের সময়.কম