সাইফুল ইসলাম শিশির: কেস পার্টনাররা কে কোথায় আছে জানিনা। রায় হওয়ার পর থেকে যে যার মতো করে দূরে সরে আছে। সবার মাথার উপর খড়গ ঝুলছে। সমূহ বিপদ। মাঝে মাঝে সর্বগ্রাসী চিন্তা এসে মাথায় ভর করে। সারারাত চোখে ঘুম আদেনা।
মধ্য ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩ সাল। এদেশে ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন। গুণগত পরিবর্তনের সুচনা মাত্র। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সমাজ সেদিন লেজুড়বৃত্তির বাইরে এসে সামরিক- স্বৈরশাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পথে নামে। যা ছিল সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এক কঠিন চপেটাঘাত।
সেদিন ছাত্র সংগঠনের যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁরা অত্যন্ত দক্ষ এবং আন্দোলন সংগ্রামে পরিক্ষীত। ‘জ্বলে উঠি সাহসী মানুষ।’ এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে এমপি, মন্ত্রী হয়েছেন। জাতীয় নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আখতারুজ্জামান- জিয়া উদ্দিন বাবলু, ফজলে হোসেন বাদশা- আতাউর রহমান ঢালি, ফজলুর রহমান- বাহলুল মজনু চুন্নু, খন্দকার ফারুক আহমেদ- আনোয়ার হোসেন, মুনির উদ্দিন- হাসিব খান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন- খ ম জাহাঙ্গীর হোসেন প্রমুখ। মধ্য ফেব্রুয়ারির ঘটনার মধ্যদিয়ে পাদপ্রদীপের সামনে চলে আসেন কবি মোহন রায়হান।
৭ দল- ২২ দল, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের উপর্যপরি আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক এরশাদ বেশামাল হয়ে পড়েন। তখন মধুর ক্যানটিন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি চুটকি বেশ চাউর ছিল। এক নাপিত এরশাদের চুলদাড়ি কাটতেন। প্রতিবার চুল কাটার সময় নাপিত একটা করে গল্প জুড়ে দিত। “স্যার! শুনলাম ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অমক তারিখে কর্মসূচি দিয়েছে – – তারা এবার মিছিল নিয়ে রাজপথে নামবে।” এরশাদ চুপ করে শুনেন। নাপিতের মুখ আর কাঁচি একসাথে চলে। এভাবে নাপিত প্রতিবার একটা করে নুতন নুতন আন্দোলনের গল্প ফাঁদে আর চুল কাটে। দিনতো সবার এক রকম যায়না।
একদিন গল্প শুরুর সাথে সাথে এরশাদ রাগতস্বরে ধমক দিয়ে উঠলেন। “বেত্তমিজ! প্রতিদিন আমাকে সংগ্রাম পরিষদের গল্প শোনাও — আজ বেটার সাড়ে রারটা বাজিয়ে ছাড়বো।”
নাপিত ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কাঁচুমাঁচু করে বলে, “স্যার! আপনার চুল ভীষণ ঘন এবং কোঁকড়া। কাঁচি চালাতে কষ্ট হয়। খেয়াল করেছি স্যার! সংগ্রাম পরিষদের কথা শুনলেই আপনার চুলগুলি কেন যেন খাড়া হয়ে যায়। তখন আমার কাঁচি চালাতে সুবিধা হয়। তাই — আমার পেটে লাথি মারবেন না স্যার, গোস্তাকি মাফ করবেন স্যার!”
‘৮৪ সালের মে মাসের দিকে আন্দোলন সামাল দিতে জেনারেল এরশাদ নানা টালবাহানা শুরু করে। বিরোধী দলকে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেয়। বহু দেন দরবার- অবশেষে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ রাজনৈতিক দল- জোট সমূহকে শর্ত জুড়ে দেয়। “আলোচনায় যেতে পারেন, তবে আলোচনার প্রথম এজেন্ডা হবে ১৪ জন ছাত্রনেতার দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার করতে হবে।”
বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট আলোচনায় অংশ গ্রহণের জন্য প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সদ্য আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে সরকারের সাথে হাত মিলিয়েছেন জনাব আতাউর রহমান খান। তিনি তখন স্বৈরশাসক এরশাদের প্রধানমন্ত্রী। বেগম খালেদা জিয়া এবং ৭ দলীয় জোট তাঁর উপস্থিতিতে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানান। বৈঠক ত্যাগ করে চলে আসেন।
এই ঘটনা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নুতন মাত্রা যোগ করে। মাঠ তাঁতিয়ে ওঠে। একদিন পর ২২ দলীয় জোটের সাথে বৈঠক। অবস্থা বেগতিক দেখে আগে থেকেই আতাউর রহমান খান সে বৈঠকে অনুপস্থিত ছিলেন।
এদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মুকুল বোস ঘোষণা দেন, ‘১৪ জন ছাত্রনেতার দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার না করলে তাঁরা অনশনে যাবেন।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে ছাত্ররা সমবেত হতে শুরু করে। ২২ দলীয় জোট নেত্রী শেখ হাসিনাসহ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে উপস্থিত হন। ইতোমধ্যে টেবিলে চা-পানি চলে আসে। জোট নেত্রী শেখ হাসিনা বলেন,”ছাত্রনেতাদের দণ্ডাদেশ প্রত্যাহার না করলে তাঁরা চা পান করবেন না।” এরশাদ ও তাঁর পারিষদবর্গ একটু নড়েচড়ে বসেন।
কর্তাব্যক্তিরা তখন ছোটাছুটি শুরু করেন। এক সময়ের এনএসএফ নেতা ব্যারিস্টার এ আর ইউসুফ তখন প্রেসিডেন্টের তথ্য উপদেষ্টা। তিনি এসে প্রেসিডেন্টের কানে কানে কীযেন বলেন।
চলবে—–
১৫ ডিসেম্বর, ২০২১ সাল
লেক সার্কাস উত্তর ধানমন্ডি
ঢাকা- ১২০৫