Home মতামত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ১২

একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ১২

38

সাইফুল ইসলাম শিশিরঃ দেখতে দেখতেই অনেক দিন হয়ে গেল। চাঁদপুর এখন আমার ভালো লাগার- নির্ভরতার একটা জায়গা। এ গ্রাম আমাকে দারুণ ভাবে আকৃষ্ট করে। আজ অবদি গ্রামের কেউ কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত করেনি। কোন প্রকার সন্দেহের আঙ্গুল তোলেনি। আমিও অন্তর দিয়ে তাদের সাথে মিশে আছি। এখন তারাই আমার অন্তরের বাসিন্দা- আমার স্বজন।

প্রকৃতিতে এখন শীতের বিদায় বেলা। বেলা না বাড়তেই সূর্যের উত্তাপ প্রখর হতে থাকে। কদিন আগেও বৈঠকখানার পাশে প্রকাণ্ড গাছ ভর্তি কাঁচা- পাকা বরই ছিল। সবুজ পাতার পাশে থোকা থোকা কুল-বরই ঝুলছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ঢিল ছুড়ে, ডাল ঝাঁকিয়ে বরই কুড়াতো। দিনমান যেন শিশুমেলা লেগেই থাকতো। ৮/৯ বছর বয়স, মাথা ভর্তি উসকো খুসকো চুল। ভাসাভাসা চোখ। নাম তার গেন্দী। কতদিন গেন্দীর মাথায় তেল পড়েনি তার কোন ইয়ত্তা নেই। কোঁচড় ভর্তি বরই এনে বলে, “মেহমান এই নেন বরই। আপনার জন্য এনেছি।” নাম জিজ্ঞেস করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে যায়। ইতোমধ্যেই বরই গাছের পাতাগুলো ঝরে গেছে। দু’একটা পাখি মরা ডালে বসে ইতি-উতি চায়। শুধুই বিবর্ণতার ছোয়া।

গেন্দী ‘নুরু পুশি আয়সা সফি’ মিলে কলার পাতায় মরিচ লবন তেল মেখে বরই মাখিয়ে খেয়েছি। কখন যে বয়সের পার্থক্যটা ভুলে গেছি তা টেরই পাইনি। ওরা সবাই মিলে এক্কাদোক্কা খেলে, গোল্লা ছুট খেলে। আমি বারান্দায় বসে খেলা দেখি, উৎসাহ দেই। পলান টুকটুক খেলার ফাঁকে গেন্দী দুষ্টুমি করে চুপিসারে বাড়ি ফিরে গেছে। কেউ টেরই পায়নি। সবাই মিলে সেকি খোঁজাখুজি- গেন্দীকে কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা। সবাই এসে আমাকে ঘিরে ধরে, “মেহমান বলেন না গেন্দী কোথায়? আপনি জানেন গেন্দী কোথায়?” আমি জানিনা তবে অনুমান করেই হাসি। সবাই রহস্য মনে করে আমাকে আরও ঘিরে ধরে। আমি দারুণ মজা উপভোগ করি।

চেয়ারম্যান চাচার বৈঠকখানা মূলত একটি পান্থশালা। রাতবিরেতে মানুষ এখানে এসে প্রায়শই পরবাস থাকে। রোদেলা দুপুরে ক্লান্ত হয়ে এসে অনেকেই শুয়ে- বসে থাকে। চওড়া বারান্দায় বড় বড় ৪টা হেলান দেয়া বেঞ্চ পাতা আছে। পথিক- রাখাল- মুনিষরা এখানে ঘুমায়, দুদণ্ড বিশ্রাম নেয়।

একদা রাতে বুটের মচমচ আওয়াজ কানে আসে। তড়িৎ বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে কাকজ্যোৎস্নার মতো আলো। ৪/৫ জন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। আত্মারাম খাচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম। দরজায় নক করে। ডাকতে থাকে, “কে আছেন? একটু ওঠেন।” কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছিলামনা। দুরুদুরু বক্ষে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম কে? “আমরা গাংনী থানা থেকে এসেছি।” দরজা খুলে দিতেই টর্চ লাইটের তীব্র আলো এসে চোখে পড়লো। সামলে নিয়ে বললাম চোখে লাইট মেরেছেন কেন? দুপা পিছিয়ে গিয়ে লাইট অফ করে বললো, চেয়ারম্যান সাহেবকে খবর দিতে হবে।
আমি এবাড়ির লোকনা। বিটিসি’র ব্লক সুপারভাইজার। এখানে সাময়িক ভাবে আছি। বাড়ির ভিতর আমি যেতে পারবো না। আর এত রাতে দরজাও খুলবে না। ভোর হোক তখন ডাকা যাবে। শুনে গলার স্বরটা একটু নামিয়ে নিল। আমি লণ্ঠন জ্বালালাম। আমার বিছানার বিপরিত চৌকিতে দুজন গিয়ে বসলো। বাকিরা বাইরের বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। বুটের ঠক ঠক আওয়াজ, বুকের ভিতর টিক টিক শব্দ যেন এক তালে বাজছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন বুকের ভিতর ড্রাম পিটাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি নিশ্চিত হলাম উনারা আমাকে ধরতে আসেনি। এসআই সাহেব পানি খেতে চাইলেন। জগ-গ্লাস এগিয়ে দিলাম, বোয়াম এ বিস্কুট ছিলো বের করে দিলাম। কিছুটা ঘুম, কিছুটা ঝিমানি, কিছুক্ষণ গল্প করে ভোরনা হতেই উনারা বিদায় নিলেন। যাক – ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল। ভোর না হতেই চারিদিকে চাউর হয়ে যায়, পাশের গ্রামের এক পলাতক আসামিকে গতরাতে পুলিশ পাকড়াও করে নিয়ে গেছে।

চাঁদপুর গ্রামের ছেলে মিন্টু। দারিদ্রের সাথে তার আজন্ম বসবাস। চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ির আঙ্গিনার ঢালুতে কখানা টিন দিয়ে ছাপড়া করে থাকে। লম্বা ছিপছিপে বাটামের মতো শরীর। দেহের চেয়ে মাথাটা একটু ছোট। কথা বলতে বেধে বেধে আসে। ভয়- ডর হীন এক সহজ সরল মানুষ। কুড়ি পর্যন্ত সে গুণতে পারে। অধিকাংশ সময় নিরহ গোবেচারার মতো থাকে। কিন্তু একবার রেগে গেলে রোখা দায়।
আমি চাঁদপুর আসার পর থেকে যতবার তাকে দেখেছি, খালি গায়েই দেখেছি। শরীরে এক ছটাক মেদ নেই। গলা থেকে নাভি পর্যন্ত একদম স্ট্রেইট- সমান। পেটের চামড়ার নিচে রগগুলো পর্যন্ত দেখা যায়। পেটের উপর গরুর ভূড়ির ‘টেমটেমি’ টানটান করে কে যেন সাঁটিয়ে দিয়েছে।

মাঠ থেকে মাথায় করে ফসলের বোঝা বহন করাই তার প্রধান কাজ। কায়িক পরিশ্রমে সে বেশ পারঙ্গম। নিজের শরীরের চেয়ে দিগুণ বোঝা সে বইতে পারে। সংসারে সে একা। বিয়েসাদী হয়েছিল সেই কবে। দারিদ্রতা- ক্ষুধা ভাগাভাগি করে নিতে পারেনি। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বৌ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। বৌ এর কথা মনে করিয়ে দিলে এখনো সে চোখের পানি ফেলে। শশুর বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘোরে। মিন্টু জানেনা, “সে এখন ঘোমটা পরা কাজল বধু দূরের কোন গাঁয়/ যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরিয়ে পাওয়া যায়।”

একদিন সে সন্ধ্যা বেলা আমার রুমে সামনে এসে নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। লালাভোলা এক প্রকৃতির সন্তান। সরল হাসি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কি যেন সে বলতে চায়। ভিতরে আসতে বললাম। না আজ না। কাল সে আসবে। সে কথাই সে বলতে এসেছে।

চলবে —


১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ সাল
থানা রোড, সিরাজগঞ্জ– ৬৭০০