Home মতামত এই দুনিয়ায় নয়ন মেলে মাগো তোমায় দেখেছি! তোমার বুকে হেসে খেলে তোমার...

এই দুনিয়ায় নয়ন মেলে মাগো তোমায় দেখেছি! তোমার বুকে হেসে খেলে তোমার কথাই শিখেছি!!

104

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন:

মাকে নিয়ে চমৎকার এবং জনপ্রিয় গানের এই কলি দু’টো ‘দিন যায় কথা থাকে’ ছবির। অনেক অনেক দিন আগের ছবি। ফারুক-কবরীর ছায়াছবি। ছবির নামের সাথে মিলিয়ে জনপ্রিয় একটি গানও তখন সমাদৃত ছিল। সুবীর নন্দীর কণ্ঠে তোলা অমর সেই গান, “দিন যায়, কথা থাকে। সে যে কথা দিয়ে রাখলো না! ভুলে যাওয়ার আগে ভাবলো না!!” ছবিটা দু’বার দেখার সুযোগ পাইনি। একবার দেখতে পেরেছি এটাই বিশাল। চুরি করে দু’বার দেখার চেষ্টা করা ডাকাতি ছাড়া আর কিছু না।

তখনকার দিনে সবাইকে জানিয়ে কিংবা কারো অনুমতি নিয়ে ছবি দেখাটা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনার মত ছিল। অস্বীকার করবো না; বড়ভাই বা মায়ের সাথে দু’চারটি ছবি দেখার সুযোগ জীবনে হয়েছে। কিন্তু এর বেশি না। বাকী যতশত ছবি দেখেছি সব চুরি করে কিংবা অভিভাবকদের নোটিশ না করে। কোন না কোন কাজের ছুঁতোয় ছবি দেখার সময়টা বের করেই ফেলতাম। বেষ্ট টাইম ছিল প্রাইভেট পড়তে যাবার সময়। প্রাইভেট পড়তে যাবার সময়টা ছিল চুরি করে ছবি দেখার উত্তম সময়।

এই উত্তম কাজে ধরা খেলে উত্তম মধ্যম যা দেবার, সবই দিতেন আমার সেজভাইয়া। চুরি করে ছবি দেখার প্রধান বাঁধা ছিলেন তিনি। বাহার ভাইয়ার যন্ত্রণায় ছবি দেখে যত না মজা পেয়েছি, টেনশানে টেনশানে অস্থির থেকেছি তার চেয়ে ঢের বেশি। তিনি নিজে ছিলেন ছবির পোকা। বছরে ৫২ সপ্তাহে ৫২টা ছবি মুক্তি পেত তখন। তিনি সবগুলোই দেখতেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। পড়াশুনা বাদ দিয়েই দেখতেন। কিন্তু আমাদের দেখতে দিতেন না।

এমন অবিবেচক দজ্জাল ভাইয়ের জ্বালায় নতুন কোন ছবি মুক্তি পাবার দু’মাস আগে থেকেই পরিকল্পনায় নামতাম, কিভাবে এবং কেমন করে গোপনে গাপনে ছবিটি দেখবো। প্রথমে ঢাকার হলে ছবি মুক্তি পেয়ে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ হয়ে উপজেলা লেভেলে যেত। এসবের আগাম সব খবর থাকতো ইত্তেফাক পত্রিকায়। অন্তত এই একটি কারণে হলেও পত্রিকাটা আমার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে ছিল। কোনদিন অন্যসব পত্রিকা পড়তে না পারলেও ইত্তেফাক না পড়ে ঘুমুতাম না। ইত্তেফাক প্রতিদিন পড়া চাইই চাই।

ইত্তেফাকের শেষের পাতার আগের পাতাভর্তি থাকতো সিনেমার খবর। কোন্টা কোন্ হলে চলছে, কত সপ্তাহ চলছে কিংবা আরো কত সপ্তাহ চলবে; সব খবর। সিনেমা হলগুলোর প্রতি ছিল আমার প্রচন্ড আগ্রহ। ঢাকার এমন কোন সিনেমা হল ছিল না, যেখানে ছবি দেখিনি। গাবতলীর বিউটি থেকে হাটখোলার অভিসার; সদরঘাটের চিত্রামহল থেকে গাজীপুরের ঝুমুর। বাদ পড়েনি কোনটাই। তবে আমার ফেভারিট ছিল ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা।

আনন্দ থেকে ‘দিন যায় কথা থাকে’ ছবিটি দেখে বাসায় ফিরেছি। বাসার পরিস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। আল্লাহপাকের বিশেষ রহমত; দজ্জাল ভাইয়া বাসায় নেই। যারা আছে, তারাও কেউ আমাকে সন্দেহ করছে বলে মনে হচ্ছে না। আমিও খুব স্বাভাবিক চেহারা মেলে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছি। ফেইস থেকে চোরচোর ভাবটা সরাবার চেষ্টা। বলা যায়, ফেইসে একটা সাধুতার ভাব আনার চেষ্টা করছি। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে যে ভাব নিয়ে সব সময় ফিরি, সেই ভাব।

তবে ভাবসাব যেমন তেমন; মন তো আর তা বোঝে না। ভাবকে ধরে রাখা যায়। কিন্তু মনকে তো আর ধরে রাখা যায় না। মনে দোলা দেয়া গান তো আর থামিয়ে রাখতে পারছি না। বারবার মনের গান মুখে চলে আসে। কোনমতে থামিয়ে রাখি। এভাবে শত চেষ্টার পরেও এক সময় গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠেছি; “মা জননী নাইরে যাহার, ত্রিভুবনে তাহার কেহই নাইরে!! মায়ের মত আপন কেহ নাই!”

সদ্য দেখে আসা ছবির গানটা আনমনে গেয়েই চলেছিলাম বিছানায় আধা শোয়া হয়ে। কখন যেন মা এসে পাশে বসলেন। আমার মা। আমার গর্ভধারিনী মা। তিনি নিজেও গানটা ধরলেন। হালকা গলা। একেবারে বেসুরে নয়। যতটুকু পারলেন গাইলেন। গাওয়া শেষে পাশেই শুয়ে পড়লেন। আমায় জড়িয়ে ধরে এত্তগুলা চুমু খেলেন। চুমুশেষে মুখটা আমার কানের কাছে এনে ভারী গলায় জানতে চাইলেন, আমার জন্যে তোর মায়া লাগে বাবা?

হুম, মায়া লাগে। কিন্তু কতটা লাগে সেদিন সেটা বুঝিনি। শুধু মায়া লাগে এটা বুঝেছি। তবে মায়ের জন্যে এতটা যে মায়া লাগতে পারে তা বুঝিনি। বিষয়টা প্রথম বুঝতে শুরু করেছি মায়ের চলে যাবার দিন। চিরদিনের জন্যে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যাবার দিন। দিন যতই যাচ্ছে মায়াটা যেমনি বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে মায়াটা অনুধাবন করার শক্তিও। মা যার নেই, তার এই ত্রিভুবনে আসলেই যে কেউ নেই, তা আমি হাঁড়ে হাঁড়ে উপলব্ধি করছি।

মা না থাকার কষ্টটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করি যেদিন দেশে ফিরি। প্রবাস জীবনের কারণে ঘনঘন দেশের বাইরে আসা যাওয়া হয় আমার। এখনও দেশে ফেরার দিন মনে হয়, মা আমার জেগে আছেন। অপেক্ষায় আছেন। আমি কাছে না যাওয়া পর্যন্ত ঘুমুবেন না। আমি যাবো; সিড়িঘর থেকে মা, মা ডাকতে ডাকতে দোতলায় উঠবো। দরজা পেরিয়ে মায়ের রুমে ঢুকবো। মশারী উঁচিয়ে মাকে আগলে ধরবো।

আমাকে দেখেও মা আমার শিশুর মত শুয়ে থাকতেন। শুয়ে থাকতেন আমার আদর নেবার জন্যে। মানুষের বয়স যত বাড়ে মানুষ ততই শিশুর মত আচরণ করে। মাও ঠিক তেমনই। ঘরে ঢুকেই এই শিশুটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে কয়েকটা চুমু খাবো। ব্যাস! শান্তি। এটা আমার শান্তি। এবার শিশুটির পালা। এবার তিনি শান্তি নেবেন। তিনি তাঁর মত করে আদর করবেন। আদরের ধরণ অবিকল সেই ছোট্ট শাহীনকে আদর করার মত। চোখ, কপাল, গাল আর ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়ে আদর করতেন আমায়।

তারপরই চোখ বাঁকিয়ে প্রথম প্রশ্ন, এত শুকনো লাগে কেন তোমায়! খাওনি কিছু? তারপরই শুরু। বড় গলায় বউদের ডাকাডাকি শুরু। কোথায় তোমরা? আসো তাড়াতাড়ি। আমার পক্ষীটারে খাবার দাও। দেখ, পক্ষীটা কেমন শুকিয়ে গেছে। মায়ের ডাকাডাকির জ্বালায় বউদের জান ঝালাপালা। তবুও মা থামছেন না। খেতে হবে তাঁর বিছানায় বসে বসেই। কেবল আমার নিজের হাতে খেলেই হবে না। তাঁর হাতেও খেতে হবে। বিছানায় বসে একটা একটা কমলা ছিলে আমার মুখে পুরে দেবেন। আর আমি খাবো।

সে সব দিন আর আসবে না! মা নেই, তাই আসবে কেমন করে! জুলাইয়ের ১৯ তারিখে পূর্ণ হলো মা চলে যাবার দশম বছর। এক বছর না, দুই বছর না; গুণে গুণে দশ বছর! দশটা বছর আমি মা ছাড়া! মায়ের আদর, সোহাগ আর ভালবাসা ছাড়া। মা যখন ছিল, কি ছিল না তখন! সবকিছুই ছিল। তবে একটা ভয়ও ছিল। মা যখন থাকবে না, তখন সেই সব কিছুর কি হবে? কে থাকবে আমার সাথে! আমার পাশে! কে ভাববে আমার কথা!

কেউ ভাববে না। ভাবতে পারে না। পৃথিবীতে মা একজনই হয়। মায়ের মত মরমী আর কেউ হয় না। আপন কেউ হয় না। আদিকাল থেকেই সমাজ ব্যবস্থায় মায়ের বিকল্প বানাবার চেষ্টা আছে বটে। তবে সবই বৃথা চেষ্টা। মা রূপী কেউ কেউ জীবনে আসেও বটে। ভালবাসার ডালি সাজিয়ে নিয়ে আসে। তারা আদরও করে। আপন হবার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনভাবেই আপন হতে পারে না। তারা মা হতে পারে না! মা হওয়া এত সহজ না!!!!